নারী যতদিন পণ্য হবে…
দুর্দানা চৌধুরী।। কয়েকদিন ধরে ধর্ষণ নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়া সরব। ধর্ষণের প্রধান কারণ ধর্ষক। কিন্তু এই ধর্ষক সৃষ্টির প্রধান কারণ কী সেটা নিয়ে আমাদের সবার মাঝেই প্রশ্ন। ধর্ষণ নিয়ে আলোচনা অনেক ব্যাপক বিস্তৃত এবং আমার জ্ঞান অভিজ্ঞতায় এ নিয়ে কথা বলা মানায় না। তবে মেয়ে হিসেবে বড় হতে গিয়ে আমি পদে পদে যেটা বুঝতে পারি নারীকে মানুষ হিসেবে কখনোই দেখা হয় না। নারীর প্রতি মানুষ হিসেবে নূন্যতম যে শ্রদ্ধাবোধটুকু থাকা দরকার তা এ সমাজের নেই। অন্য নারীদেরই নেই আর পুরুষ কে কী বলবো!
নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ না থাকার পেছনে দায় সমাজব্যবস্থার। সমাজব্যবস্থা এ দায় এড়িয়ে যেতে পারেনা। নারীকে শুরু থেকেই ভোগপন্য হিসেবে দেখে আসা হয়েছে। নারীকে কখনোই তার মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে বিচার করা হয়নি।
খুব সহজ উদাহরণ দেই। আমরা ক্লিওপেট্রার কথা শুনেছি, কিন্তু প্রথমেই শুনেছি তার সৌন্দর্য প্রণয় এসব বিষয়ে।অথচ সমসাময়িক পুরুষ শাসনকর্তাদের কীর্তি সম্পর্কেই বিস্তারিত জানি আমরা। কে কেমন দেখতে ছিলেন তা নিয়ে প্রশ্ন আমাদের অনেকের মাথায়ই আসেনি। শারীরিক সৌন্দর্যই নারীর প্রধান শক্তি এমন ধারণা কেবল আজ বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান তৈরি করেনি। প্রাচীনকাল থেকেই এ ধারা চলে এসেছে। মধ্যযুগে শাসকেরা হেরেমে অসংখ্য নারীদের কেবল ভোগ করার জন্য রাখতেন। নারী বলতেই ভোগপন্য এ ধারণা তাই নতুন নয়। শিল্পসাহিত্যেও নারীকে বরাবরই উপস্থাপন করা হয়েছে কামনার বস্তু হিসেবে। নারীর শরীরকে পুঁজি করে ঔপন্যাসিকরা লিখেছেন দিস্তা দিস্তা উপন্যাস। কবিরা রাতজেগে কেবল নারীর দেহের বর্ণনায় খাতা ভর্তি করেছেন।
আমি ব্যক্তিগতভাবে শিল্প সাহিত্য নিয়ে পড়ে থাকতে পছন্দ করি। কিন্তু আমি এও বিশ্বাস করি শিল্পের নামে নারীর সস্তা উপস্থাপন নারীকে মানুষ কম মাংসের দলা বেশি বলে তুলে ধরে। নাটক, সিনেমা, গান সব জায়গায় আমরা বরাবরই দেখে এসেছি নারীর পরিচয় তার বাহ্যিক রূপে। সেই অর্থে পুরুষকে দেখানো হয়েছে সাহসী, মেধাবী এবং প্রজ্ঞাবান হিসেবে।
নারী যখনই মাংসের দলা থেকে মানুষে পরিণত হতে চেয়েছে তখনই তাকে দমিয়ে দেয়া হয়েছে। হাইপোশিয়া থেকে উপমহাদেশের খনা সবার পরিণতি তাই একই। অতীত ঘাটা বাদ দিয়ে যদি বর্তমানেও আসি তাও দেখি এ ধারা বেড়েছে বৈ কমেনি। শেভিং রেজরের অ্যাড থেকে শুরু করে হলিউডি সিনেমা সর্বত্র নারীকে দেখানো হচ্ছে কামনার বস্তু হিসেবে। নারীর শরীরই হয়ে উঠেছে তার আসল পরিচয়। দেশি বিদেশি সিনেমায় খুব সাধারণ দৃশ্যে নারীর অঙ্গ উদ্দেশ্যমূলকভাবে ক্লোজ শটে দেখানো হয়। অথচ কাহিনী সংলাপ কিছুই ফুটিয়ে তুলতে এ দৃশ্যের যে প্রয়োজন এমনটাও নয়। বলিউডি সিনেমায় তো দু একটা আইটেম গান হিট হলেই সিনেমা বক্স অফিসে বাজিমাত।আর আইটেম গানগুলোতে প্রচন্ডভাবে নারীকে অবজেক্টিফাই করা হয়। বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো তো একচেটিয়া ব্যবসাই চালিয়ে যাচ্ছে নারীকে ভোগপন্য হিসেবে উপস্থাপন করে। বিলবোর্ডে নারী আবেদনময়ী, টিভি, সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র নারীই প্রধান পণ্য। এতোসব কথা যে কারণে বলা, এই অবাধে নারীকে অব্জেক্টিফাই করার ফলে নারীর প্রতি শ্রদ্ধা ব্যাপারটিই সমাজে সৃষ্টি হবার সুযোগ পায়নি সেখানে উঠে যাওয়ার প্রশ্ন আসছে কই!। (যারা কলি যুগে এসব হচ্ছে বলছেন তাদের অতীত নিয়েও অল্প সল্প খোজ নিতে বলছি।)
ধর্ষক সৃষ্টির প্রধান কারণ কী তা আমার জানা নেই কিন্তু ধর্ষকের যে নারীর প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেই এতোটুকু হলফ করে বলতে পারি। মানুষ চারপাশ থেকেই শেখে এবং এই চারপাশে যাকে যেভাবে উপস্থাপন করা হয় তা তার মস্তিষ্কে আজীবন গেঁথে যায়। বড় হয়ে বিবেক বুদ্ধি খাটিয়ে এতোসব ভাবার সময় কিংবা ইচ্ছা বেশিরভাগেরই থাকে না।
খুব বাজে একটা কথা দিয়ে শেষ করি। একবার গার্লস গ্রুপে এক আপু পোস্ট করেছিলেন তার হাজবেন্ড পর্ন দেখে এবং তার সাথে সেরকম আচরণ করে। কি ভয়ানক প্রভাব দেখুন! স্ক্রিনের প্রভাবে স্ত্রীর প্রতি সম্মান ও শ্রদ্ধাবোধটুকুও দেখাচ্ছেন না। আমি তাই নারীকে পণ্য হিসেবে দেখানোর ঘোরবিরোধী। যতদিন না এ সংস্কৃতি বন্ধ হবে ততদিন পর্যন্ত নারী পৃথিবীর কোথাওই মানুষ হয়ে উঠতে পারবে না!
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]