নোয়াখালিতে ধর্ষণ এবং হাজার খানেক শব্দে ফারুক ওয়াসিফের কারণ আবিষ্কার
সাব্বির এ মুকীম।। ‘প্রথম আলোতে ধর্ষণের সংবাদ কেন বেশি বেশি ছাপা হয়?’- এই প্রশ্নটা যদি আমি এভাবে করি- ‘‘প্রথম আলোতে কেন ধর্ষণ বেশি?’’
না, আমি তা বলতে পারি না। ‘‘প্রথম আলো মানেই ধর্ষণ’’- এভাবেও বলা যাবে না। কিন্তুfআমি যদি গত ২৬শে অক্টোবর, ২০২০ প্রথম আলোর ওয়েব সাইটে ছাপা হওয়া জনাব ফারুক ওয়াসিফের “নোয়াখালীতে কেন ধর্ষণ বেশি?” (লিংক লেখার শেষে দেয়া) নামক মতামতের শিরোনামের ‘নোয়াখালীতে’ শব্দটিকে ‘প্রথম আলোতে’ শব্দ দ্বারা প্রতিস্থাপন করতে চাই, তবে তাও কি আসলে আমি চাইতে পারি?
কোল ছুঁয়ে হলেও আমার কোনো কিছুই নোয়াখালী জেলায় নয়। জন্মেছি ও বড় হয়ে এখন কাজ করে খাই কুমিল্লায়, আর পূর্বপুরুষের বাড়ি চাঁদপুরে। তবুও নোয়াখালী নিয়ে এমন হয় অসাবধান নয়তো বর্ণবাদী নয়তো মশলাদার শিরোনামের তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। নোয়াখালী শব্দের জায়গায় গুজরাট লেখা থাকলেও জানাতাম, ইসলামাবাদ লেখা থাকলেও জানাতাম।
ধর্ষণ এতো ভারি একটি বিষয় প্রত্যেকবার “ধর্ষণ” শব্দটা লেখার আগে শব্দটার আগে এবং পরে সকল শব্দ’কে মূল্যায়ন করে তবেই শব্দটা লিখতে হবে। আর ১০টা শব্দের মতো মেটাফর বা বিশেষণ বা উদাহরণ বা কাটতি বাড়ানোর মশলাদার উপকরণ হিসেবে ‘ধর্ষণ’ শব্দটা ব্যবহার করা যায় না।
শব্দ যে বিপননের মশলা হতে পারে তার একটি তুচ্ছ উদাহরণ হলো কলিকাতা হারবাল এর গোপন চিকিৎসার লিফলেটগুলো; কাশেম বিন আবু বকরের ফুটন্ত গোলাপ কিংবা শফিক রেহমানের মঈণ-মিলার সংলাপ কিবা সব্যসাচী হকের খেলারামেরা- আরও তিনটি উদাহরণ হতে পারে- মোট চারটি উদাহরণ মূল্যায়ন অনুপাতে চার বর্ণবাদী বর্ণের স্তরে শব্দ মসলা ব্যবহারের।
ফ্রয়েড পড়েন, জ্যাক দেরিদা পড়েন, ফ্রাঞ্জ ফ্যানো পড়েন, গ্রামসি পড়েন, ফারুক ওয়াসিফ বোঝান তিনি এমন অনেক কিছুই পড়েন। যদি সত্যি পড়ে থাকেন, তাহলে ফারুক ওয়াসিফ নিশ্চয়ই ওনাদের কাছে পড়েছেন যে শব্দ, শব্দ চয়ন এবং শব্দের ব্যবহার মিলে লেখকের অবচেতন মনের ছবি সুস্পষ্ট করে আঁকে।
ফারুক ওয়াসিফের এই শিরোনামটি বুঝে-অবুঝে যেভাবেই দেয়া হোক- লেখার কাটতি অনেক বাড়িয়ে দেবে। জেনে কিংবা না জেনেই এই শিরোনামে “ধর্ষণ” শব্দটিকে মসলা হিসেবে ব্যবহার করে তার সাথে একটি জেলার নাম জুড়ে দিয়ে অসাধারণ রসালো শিরোনাম তৈরি করা হয়েছে।
এই দেশের সংস্কৃতির মনস্তত্বে ধর্ষণ খুব গভীরভাবে প্রোথিত। আমরা ধর্ষণকে সিরিয়াসলি নেওয়ার ভান করি কারণ এতে সমাজে ভাইরাল হওয়া যায় কিন্তু আসলে আমাদের অবচেতন মনে ধর্ষণ আর ইভটিজিং আর প্রেম করার মধ্যে তফাৎ করি না। অবশ্য আমার নিজের বোন ধর্ষণ হলে ভিন্ন কথা। তার আগ পর্যন্ত মননের খুব গভীরে ধর্ষণ আসলে আমাদের কাছে এ ম্যাটার অব ফান আর ধর্ষণ নিয়ে কথা বলা হলো ম্যাটার অব পপুলারিটি।
প্রত্যেকটা উপমহাদেশীয় পুরুষ মানেই এক একজন পটেনশিয়াল রেপিস্ট- কথাটা আক্ষেপের হলেও এর ঐতিহাসিক ভিত্তি যুক্তি একেবারে উড়িয়ে দেয়ার মতো নয়।
উপমহাদেশের সংস্কৃতিতে একটা খুব নোংরা বিষয় হলো রাক্ষস বিবাহ। এখন আর শোনা যায় না, কারণ দলিল দস্তাবেজে আমরা আমাদেরকে সভ্য ঘোষণা করেছি।
ধর্ষণের একটা বৈধকরণ পন্থা হলো রাক্ষস বিবাহ।
ধর্ষণ করলেই এই বিবাহ হয়, ধর্ষণ করা মাত্র ধর্ষক স্বামী হয়ে যায় ধর্ষিতার। হয়তো এই অবচেতন ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়েই ধর্ষণ শব্দটা নিয়ে এতো সহজে এতো বেশি বেশি ট্রল করা হয় কেবল এই উপমহাদেশেই সম্ভবত।
৭১ সালে পাকিস্তান আর্মি তাদের ধর্মের লোক বাড়াতেই ধর্ষণ- সে যুক্তি দিয়েছিলো, এই দেশে যে যুক্তি এখনও অনেক মানুষ তা মানে। ফারুক ওয়াসিফকেও তাদের মতো দেখতাম ৭১ এর সোহাগপুরের ধর্ষণের বিচারে অনেক খুঁত খুঁজে পেতেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফ্রি সেক্স এর দেশ হতে পারে, তবে ডার্টি মাইন্ড মনে হয় উপমহাদেশ।
কেবল বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করতে করতে ফারুক ওয়াসিফরা যখন “ধর্ষণ” শব্দকেও ব্যবহার করেন, তখন তাঁরা ধর্ষণকেই উৎসাহিত করেন খুব সম্ভবত বোকার মতো না বুঝেই। আর সব বাদ দিলেও আলোচ্য শিরোনামটি প্রচণ্ড রকম সাবজেক্টিভ, মহাপুরুষের মতো, জাকির নায়েকের মতো মাত্র হাজার খানেক শব্দে লেখা রচনাতেই নোয়াখালীর ধর্ষণের কারণ আবিষ্কার করে ফেলেছেন ফারুক ওয়াসিফ। নৈর্ব্যক্তিক লেখা সবসময়ই নিজের মতকেই একমাত্র শুদ্ধ আবিষ্কার হিসেবে দেখায় না।
ফারুক ওয়াসিফের এই লেখাটিরই আমার মতে নৈর্ব্যক্তিক একটা বিকল্প শিরোনাম হতে পারতো- “নোয়াখালীতে ধর্ষণ কেন বেশি অনুসন্ধান।”
ফারুক ওয়াসিফের আলোচ্য লেখার লিংক: নোয়াখালীতে কেন ধর্ষণ বেশি?
সাব্বির এ মুকীম: আইনজীবী
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]