গ্রীক পুরাণের মেডিউসা থেকে পাওলা ডিবানা: বিদ্রোহী নারী ও এই সমাজ
রেহমান মুস্তাফিজ।। প্রাচীন গ্রীসে গর্গান তিন বোনের একজন ছিল মেডিউসা। গর্গানরা ছিল তারা, যাদের শরীর এবং মুখাবয়ব মেয়েদের মত হলেও নিচের দিক দিয়ে ছিল সাপের মতো। যদিও মেডিউসা ছিল সাধারণ বাচ্চাদের মতোই এবং সে ছিল অসম্ভব রূপবতী। বলা হয় দুনিয়াতে তার চেয়ে সুন্দর খুব কম মেয়েই এসেছে। সবচেয়ে সুন্দরী না হলেও সুন্দরীদের তালিকা করলে উপরের তিনজনের একজনই হওয়ার কথা মেডিউসার। মেডিউসার প্রিয় বন্ধুর নাম ছিল ইফিক্লিস। ছোট থেকেই তারা একসাথেই খেলতো তার বাকি বোনদের সাথে। ইফিক্লিস আর মেডিউসাকে আলাদা দেখতেই পাওয়া যেত না। দিন যত বাড়ছিল মেডিউসার রূপও তত বৃদ্ধি পাচ্ছিলো। এবং এটা অনুমেয় ছিল যে ইফিক্লিস তার হৃদয় মেডিউসাকেই দিবে। মেডিউসা ইফিক্লিসকে পছন্দ করলেও ইফিক্লিসের প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়৷ কারণ মেডিউসা ছিল দেবী ইথিনার ভক্ত। তার জীবনের লক্ষ্যই ছিল দেবী ইথিনার মন্দিরের রক্ষাকর্তা হওয়ার। আর ইথিনার মন্দিরের প্রিস্ট্রেস হতে হলে তাকে হতে হতো কুমারী এবং পবিত্র। তাই মেডিউসার কাছে আর কোনো পথই খোলা ছিল না।
মেডিউসা ইথিনার মন্দিরের প্রিস্ট্রেস হওয়ার পথে এগিয়ে যেতে লাগলো। মেডিউসাকে দেখে দেখে অনেকেই ইথিনার মন্দিরে আসতে লাগলো। অনেকে এটাও বলতে শুরু করে দিয়েছিল যে মেডিউসার চুল ইথিনার চেয়েও বেশি সুন্দর। এসব শুনে শুনে ইথিনার মেডিউসার প্রতি হিংসা জমতে থাকে। যদিও ইথিনা শুরুতে সেটা নিজের মধ্যেই গোপন করে রাখে৷
এদিকে দেবতাদের আবাসস্থল অলেম্পিয়াসে গডেস ইথিনা আর সমুদ্র দেবতা পেসাইডেনের মধ্যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলতে থাকে। কারণ তারা দুজনই চাইতো বর্তমান যে গ্রীস এথেন্স তা যেন তাদের অধিকারে থাকে। কিন্তু দিন দিন এখানে ইথিনার অনুসারী বাড়তে থাকে এবং তারা এখানে ইথিনার মন্দির বানায়, মুর্তি বানায়৷ যার ফলে এই অঞ্চলের নাম বদলে ইথিনার নামানুসারে হয়ে যায় এথেন্স৷ যা পেসাইডেন কখনোই মেনে নেয় নি। সেই থেকে পেসাইডেন এর মনে জমে থাকে ইথিনার প্রতি ক্রোধ আর প্রতিশোধের নেশা।
দিন দিন যখন মেডিউসার জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে তখন ইথিনার হিংসাও মেডিউসার প্রতি বাড়তে থাকে। যদিও ইথিনা নিজেকে বুঝাতো এই বলে যে এতে মেডিউসার কোনই দোষ নেই। সে তো ইচ্ছে করে কিছুই করছে না। বরং তাকে খুশি রাখতে মেডিউসা সাধ্যমতই চেষ্টা করে যাচ্ছে। সেসময় অলিম্পিয়াসে ইথিনার এই অস্থিরতা টের পেয়ে যায় পেসাইডেন। তাই সে ইথিনার উপর প্রতিশোধ নিয়ে নিজের সব দৈবিক মুগ্ধতা শরীরে লাগিয়ে হাজির হয় মেডিউসার সামনে। মেডিউসার প্রতি তার জৈবিক চাহিদার কথা জানায়। কিন্তু ইথিনাভক্ত মেডিউসা সে প্রস্তাব ফিরিয়ে দেয়। ক্রোধে মত্ত পেসাইডেনও পিছে ফেরার অবস্থায় ছিল না। তাই এবার শুরু করে জোর জবরদস্তি। কিন্তু মেডিউসা যেন তেন করে তার থেকে ছাড়া পেয়ে যায়৷ পেসাইডেন থেকে বাঁচতে মেডিউসা পেসাইডেনের মুখে ঘুসি দেয়৷ যা পেসাইডেনের রাগকে আর বাড়িয়ে দেয়।
পেসাইডেন থেকে বাঁচতে মেডিউসা যেখানে নিজেকে সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে সেই ইথিনার মন্দিরের সামনে আসে। ততক্ষনে পেসাইডেনও সেখানে এসে যায়৷ এবার মেডিউসাকে পেসাইডেন থেকে বাঁচাতে এগিয়ে আসে ইফিক্লিস। কিন্তু দেবতাকে আটকানোর সাধ্য কই মানুষের? ইফিক্লিসও তাই পেরে উঠে না। মেডিউসাও তাই মন্দিরের ভেতরে গিয়ে যে ইথিনার আরাধনা করে গেছে সারাজীবন, সেই ইথিনার কাছে নিজের পবিত্রতা ভিক্ষা চায়, রক্ষা পেতে যায় পেসাইডেন থেকে। কিন্তু ইথিনা বাঁচাতে এগিয়ে আসে না। পেসাইডেনও মেডিউসাকে কোনো রকম বাধ বিপত্তি ছাড়াই মন্দিরের ভেতরেই ধর্ষণ করে তবেই ক্ষান্ত হয়।
পেসাইডেন ধর্ষণ করে ফিরে চলে গেলে তবেই সেখানে আসে ইথিনা। বলা হয় ইথিনা আগে থেকেই সেখানে ছিল নিজের মুর্তির ভেতরেই। কিন্তু মেডিউসার প্রতি হিংসার বশবর্তী হয়ে সে ইচ্ছে করেই মেডিউসাকে বাঁচায় নি। কিন্তু এসেই মেডিউসাকে বলে দোষ সব মেডিউসার। মেডিউসাই তার রূপ তার সব কিছু দিয়ে পেসাইডেনকে দুর্নীতিগ্রস্থ করেছে৷ মেডিউসাই দায়ী তার মন্দিরকে অপবিত্র করার পেছেন। আর যেহেতু মেডিউসা ইথিনার মন্দিরের পবিত্রতা নষ্ট করেছে, করেছে ইথিনার প্রিস্ট্রেজ হবার শর্তভঙ্গ, তাই তাকে অভিশাপ দেয় ইথিনা। সারারাত ধরে সেই মন্দিরে বসে কাঁদে মেডিউসা। একসময় কান্নার শব্দ শুনে জ্ঞান ফিরলে সেখানে আসে ইফিক্লিস। মেডিউসা তাকে কাছে আসতে মানা করে। কিন্তু সান্তনা দিতে ইফিক্লিস তার কাধে হাত রাখলে যে মাথার চুলগুলোকে লোকে বলতো ইথিনার চেয়েও সুন্দর অভিশাপে তা ততক্ষনে সাপ হয়ে গেছে। সেই সাপ ইফিক্লিসকে ছোবল দেয়। মেডিউসা চায় না ইফিক্লিস মেডিউসার এই বিকৃত মুখ দেখুক। তাকে বারবার ফিরে যেতে বলে। তবুও ইফিক্লিস দেখতে চাইলে মেডিউসা ইফিক্লিসের দিকে ঘুরে দাঁড়ায়। অভিসপ্ত মেডিউসার মুখ দেখে ইফিক্লিস পাথর হয়ে যায়। নিজের সবচেয়ে কাছের, সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুকে পাথর হতে দেখে মেডিউসা ভেঙ্গে পড়ে। সে চায় আর কারো যেন তার কারণে ইফিক্লিসের পরিনতি বরণ করতে না হয়। পালিয়ে চলে যায় অনেক দূরে, অনেক অনেক দূরে। একটা জনমানবহীন ভাঙ্গা মন্দির দেখতে পেয়ে সেখানেই আশ্রয় নেয় মেডিউসা, যেন কেউই তার আর তাকে এবং তার অভিশপ্ত মুখ দেখতে না পায়।
কিছুদিনের মধ্যেই মেডিউসার খবর ছড়িয়ে পড়ে পুরো গ্রিসে। দলে দলে সব বীরেরা আসে মেডিউসাকে শিকার করতে। কিন্তু যারাই মেডিউসাকে মারতে আসে তাদের কারোই আর ঘরে ফেরা হয় না। মেডিউসাকে মারার জন্য উপহার ঘোষণা হয়, লোকে বীরত্বের প্রতীক হিসেবেও মারতে চায়৷ কিন্তু কেউই সফল হয় না। একদিন এক অজনপ্রিয় ছেলে আসে। যাকে লোকে তেমন জানতোও না। সে আসে মেডিউসাকে মারতে। হাতে যার ছিল চকচক করা এক ঢাল। সেই ঢালের সাহায্যেই মেডিউসার দিকে না তাকিয়েই সেই ছেলেটা মেডিউসার গলা কেটে দেয়। আইরোনি হচ্ছে সেই ঢালটা হলো গডেস ইথিনার যুদ্ধ ঢাল। ইথিনাই ছেলেটাকে ঢালটা দিয়েছিল মানুষের জন্য হুমকিস্বরূপ এই মেডিউসা নামের মনস্টারকে শেষ করে দিতে।
প্রয়োজনে বাঁচাতে আসে নি ইথিনা। যখন লোকের থেকে দূরে গিয়ে বাঁচতে চেয়েছিলো তখনো মেডিউসাকে মারতে সাহায্য করেছে ইথিনা। অথচ মারা যাবার পরে কিনা বললো তাকে এই অভিশাপের জীবন থেকে মুক্তি দিতেই নাকি এমনটা করেছে। মেডিউসাকে মেরে ফেললে তার রক্ত থেকে জন্ম নেয় তার সন্তান, পেগাসাসের। যে মেডিউসাকে অপবিত্র বলে অচ্ছুৎ করা হয়েছে সেই মেডিউসার সন্তানকেই কিনা বলা হলো দুনিয়ার সকল সৃষ্টির মাঝে সবচেয়ে পবিত্র সৃষ্টি। আর যুদ্ধ বা ক্ষমতা ধরে রাখতে নিজের ঢালে ইথিনা বসিয়ে নেয় মেডিউসার মাথাটাকে। কারণ মেডিউসা মারা গেলেও তার কার্যকারিতা একটুও কমে নি। এখনো যে কেউই মেডিউসার দিকে তাকালেই পাথর হয়ে যায়। নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে আবার সেটার নাম দিয়েছে, যেহেতু মেডিউসা ইথিনার একনিষ্ঠ ভক্ত ছিল তাই ইথিনা নিজের ঢালে ইথিনার কাটা মাথাটা রেখে তাকে সম্মানিত করেছে। হা হা হা।
আর মেডিউসাকে যে ছেলেটা মেরেছিলো সেও হয়েছে ইতিহাসে অমর বীর- দেবতা জিউসের পুত্র পার্সিয়াস যার নাম।
না, মিথোলজির গল্প শুনাতে মেডিউসাকে নিয়ে লিখি নি। প্রাচীন গ্রীক সভ্যতা পেরিয়ে গেছে আজ প্রায় ২০০০ বছরেরও বেশি। দুনিয়া আজ নাকি সভ্য হয়েছে। কিন্তু এগুলো কি আসলেই কল্পকাহিনী মাত্র? আজকাল কি আমরা আশেপাশে তাকালে এই মেডিউসা, ইথিনা বা পেসাইডেনদের দেখি না? এই যে ফুটবল ঈশ্বর মানা ম্যারাডোনাকেই দেখুন না। লোকে তাকে ফুটবলের দেবতা মানে। মারা যাবার পর দুনিয়া জুড়ে শোক পালন করেছে লোকে, এখনো করছে। কিন্তু এই ফুটবল ঈশ্বরকে সম্মান দেয় নি শুধুমাত্র একজন নারী। নাম তার পাওলা ডিবানা। স্প্যানিশ তৃতীয় বিভাগে খেলা অখ্যাত এক ক্লাবের অখ্যাত এক নাম। ম্যারাডোনার জন্য মাঠে যখন সবাই শোক পালন করে নিরবতা পালন করছিল, মেয়েটা তখন মাঠে বাকি খেলোয়ারদের মাঝে উল্টোদিক ঘুরে বসে ছিল। ম্যারাডোনার জন্য শোক পালনে সরাসরি না বলে দিয়েছে। কারণটা ছিল খুবই সাধারণ। সে কোন নির্যাতনকারীর জন্য শোক দেখাবে না। বলে রাখা ভাল কয়েক বছর আগে ম্যারাডোনার একটা ভিডিও সকলের সামনে আসে। সেখানে দেখা যায় ম্যারাডোনা তার তৎকালীন বান্ধবীর সাথে চিল্লাচ্ছিলো এবং তাকে শারীরিকভাবে আঘাতও করছিলো। মেয়েটাকে কয়েকটা লাথিও দিয়েছিলো এই ফুটবল ঈশ্বর। আর তাই নিজেকে ফেমিনিস্ট দাবি করা পাওলা শোক জানায় নি ম্যারাডোনাকে। উল্টো ম্যাচ শেষে ম্যারাডোনাকে পেডোফাইলও বলেছে। কারণ ম্যারাডোনার সেই বান্ধবী ছিল তার চেয়ে ৩০ বছরেরও ছোট। আবার ফিফাকে উদ্দেশ্য করে এটাও বলেছে “কই যখন ইন্টারন্যাশনাল ওম্যানস ডে যায় তখন তো তারা নির্যাতিত নারীদের জন্য এক মিনিটের নিরবতা দেয় না! আমি কোনো নির্যাতনকারী, পেডোফাইল, ধর্ষণকারীর জন্য শোক জানাবো না। খেলোয়ার হিসেবে ম্যারাডোনাকে আমি চিনি কিন্তু এটার বাইরেও সে একজন নির্যাতনকারী। আমি ফুটবলার হিসেবে জিদানকে সম্মান করি। আজ যদি জিদানও নির্যাতনকারী হয় তবে আমার জীবনে জিদান বলেও আর কেউ থাকবে না”।
এই শোক না জানানোটাই কাল হয়েছে মেয়েটার জন্য। ফিফা থেকে শুরু করে সবারই সমালোচনা শুনতে হচ্ছে। সোশাল মিডিয়া থেকে শুরু করে সবাই গালাগাল দিচ্ছে তাকে। এমনকি মৃত্যুর হুমকি পর্যন্ত এসেছে তার জন্য।
এবার ম্যারাডোনাকে ভাবুন পেসাইডেন, ফুটবলটাকে ভাবুন গডেস ইথিনা আর পাওলাকে ভাবুন মেডিউসা। আর যারা তার সমালোচনা করছে তাদের ভাবুন বীর পার্সিয়াস। কারণ সমালোচকারীদের যে সকলেই হিরো ভাবছে। অথচ কেউ এটুকু বলছে না পাওলার কোন দোষ নেই। সে কোন ভুল করে নি। ঠিক প্রতিবাদটা ঠিক মানুষের জন্যই করেছে সে।