November 25, 2024
সাহিত্যফিচার ২বই নিয়ে আলাপ

মানালের ড্রাইভিং: পিতৃতান্ত্রিক ধর্মান্ধতার রূঢ় বাস্তবতা

রাহাত মুস্তাফিজ।। 

‘The Rain Begins with a Single Drop’

‘‘দিনটি ছিল মে মাসের ১৯, বৃহস্পতিবার, সৌদি সাপ্তাহিক ছুটির প্রথম দিন। ১৭ জুন অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া ‘উইমেন টু ড্রাইভ’ ইভেন্টের প্রায় এক মাস আগে। আমি গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ি। সেদিন রাতেই গাড়ি চালানোর ঘটনাটি ইউটিউবে আপলোড করি। ভিডিওটি ছিল সম্পূর্ণ আরবী ভাষায়, সাবটাইটেল ছাড়া। আমার চুল ঢাকা ছিল, চোখে ছিল বড়ো ফ্রেমের সানগ্লাস।”

মানাল আল শারিফ ২০১১ সালের ১৯ ও ২১ মে সৌদি আরবের রাস্তায় গাড়ি চালানোর ‘অপরাধে’ আটক হন, পরে তাঁকে জেলে পাঠানো হয়৷ তিনি টানা ৯ দিন একটি অপরিচ্ছন্ন, স্যাঁতসেঁতে, তেলাপোকা ঠাসা জেলের ঘিঞ্জি কামরায় অন্যান্য অসহায় নারী কয়েদীদের সাথে দিন কাটান। বইটি পাঠ করতে করতে সৌদি আরবের বর্তমান সংস্কৃতি, প্রথা, রীতিনীতির সাথে পাঠকের সম্যক পরিচয় ঘটতে থাকবে। বিশেষ করে সৌদি নারীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া কঠোর ধর্মীয় বিধিনিষেধ বিষয়ে অত্যন্ত প্রাঞ্জল ও সাবলীল ভাষায় মানাল লিখেছেন।

‘‘ওই মহিলা সুগন্ধি মেখেছে’’ – হ্যারাসমেন্টের শিকার তো সে হবেই।

মানাল আল শরিফ ‘Daring to Drive’ গ্রন্থে তাঁর অভিজ্ঞতার বয়ানে লিখেছেন। সৌদি পিতৃতন্ত্র ঠিক এ ভাষায় কথা বলে। অবশ্য সেক্সিস্ট বয়ান দেশ-কাল ও জাতি নির্বিশেষে এভাবেই ক্রিয়াশীল থাকে।

সৌদি কিং’কে রাষ্ট্রের সকল ছেলে ও মেয়ের পিতা হিসেবে মনে করা হয়। রাজাকে ভালবাসা ও রাজার প্রতি আনুগত্যকে ধরা হয় নাগরিকের দেশপ্রেম হিসেবে। ওদিকে নারীদেরকে তথাকথিত ‘কুইনের’ ‘সম্মানে’ ভূষিত করা হয়। মজার বিষয় হচ্ছে, রাজা একজন হলেও সৌদিতে আছে কোটি কোটি কুইন। কিন্তু হায়! পরিহাস! এই সমস্ত কুইনদের গাড়ি চালানোর অনুমতি নেই (২০১৮ সালে প্রিন্স সালমান নারীদের গাড়ি চালানোর বিপক্ষে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন)। এই অনুমতি না থাকা আইন কিংবা ট্রাফিক বিধি অনুসারে সমর্থিত নয়। বিষয়টি সৌদির কাস্টম তথা প্রথা দ্বারা সিদ্ধ।

সৌদির কালচার এটা। মানাল বলছেন,‘‘ওখানে হ্যারাসমেন্ট কোনো অপরাধ নয়। কর্তৃপক্ষ তথা ধর্মীয়/নৈতিকতা রক্ষাকারী পুলিশ সবসময় নারীকে দোষারোপ করে। ধর্মীয় পুলিশের মতে, সে হ্যারাসমেন্টের শিকার হয়েছে কারণ সে নিজেকে এমনভাবে দেখিয়েছে, তার হাঁটাচলা এমন অথবা সে এমন পারফিউম মেখেছে যার ফলে সে হ্যারাসড হয়েছে। অপরাধিকে নয়, অভিযোগকারিকেই উল্টো অপরাধী বানিয়ে ছাড়ে সেখানে।”

সৌদি আরবে একজন নারীর অবশ্যই একজন অফিসিয়াল অভিভাবক থাকতে হবে। ওই অভিভাবক অবশ্যই একজন পুরুষ হবে। সাধারণত স্বামী কিংবা পিতা নারীর স্বাভাবিক অভিভাবক হয়ে থাকেন। অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া পড়াশোনা, চাকরি, ভ্রমণ কিছুই করা সম্ভব নয়। স্বামী বা পিতার অবর্তমানে আরেক ধরনের অভিভাবকত্ব প্রচলিত আছে। একে বলা হয় ‘মাহরাম’। ঘনিষ্ঠ পারিবারিক সম্পর্কে আবদ্ধ এমন পুরুষ যাকে নারীটি বিয়ে করতে পারবে না- এরকম ব্যক্তি তথা পুরুষ একজন নারীর মাহরাম হবেন। যেমন, চাচা, ভাই, ছেলে। যেকোনো অফিসিয়াল বিষয়ে এদের মধ্যে যে কেউ নারীটিকে সঙ্গ দেবেন এবং অফিসিয়াল কাগজপত্রের সাক্ষী ও গ্যারান্টার হবেন।

এমনকি একজন গর্ভবতী নারী অভিভাবক কিংবা মাহরাম ছাড়া হাসপাতালে ভর্তি হতে পারবেন না। লেখক স্বয়ং জন্মগ্রহণ করেন মক্কায় তাঁদের ছোট্ট ঘুপচি ঘরের অন্ধকারাচ্ছন্ন কামরায়। কারণ, তাঁর পিতা কাজে বাইরে ছিলেন এবং যেহেতু একজন পুরুষের উপস্থিতি ও অনুমতি ছাড়া একজন নারী হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেন না, সেকারণে তাঁর গর্ভবতী মা জরুরি মুহুর্তে হাসপাতালে ভর্তি হতে পারেননি। ঘরে আগুন লাগলে, ডাকাত পড়লে অথবা জরুরি ডাক্তারি সেবার দরকার পড়লেও একজন পুরুষ পুলিশ বা পুরুষ সেবাদাতা মাহরামের উপস্থিতি ব্যতীত ঘরে প্রবেশ করতে পারবেন না।

২০০২ সালে সৌদির একটি মেয়েদের স্কুলে আগুন লাগে। ভীত-সন্ত্রস্ত, আতঙ্কিত মেয়েরা আগুন থেকে বাঁচতে বাইরে বের হওয়ার আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হন। তাঁদেরকে বাইরে বের হতে দেওয়া হয়নি। কারণ, তাদের মুখে ও মাথায় পর্দা ছিল না, তাঁরা তখন যথাযথ ইসলামি ড্রেসকোড অনুসারে ছিলেন না। এরফলে ১৫ জন ছাত্রী সংজ্ঞাহীন মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন!

২০১৪ সালে কিং সৌদ ইউনিভার্সিটিতে আমনা বেওয়াজির হার্ট অ্যাটাকের শিকার হন। তাৎক্ষণিক একজন পুরুষ প্যারামেডিক ক্যাম্পাসে প্রবেশ করে চিকিৎসা দিতে চাইলেও তাকে ঢুকতে দেওয়া হয় না। কারণ ওটা ছিলো নারীদের ক্যাম্পাস। পুরুষের মেডিকেল সেবা গ্রহণ কীভাবে সম্ভব? ২০১৬ সালে কাশেম ইউনিভার্সিটিতে একইরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। একজন পুরুষ প্যারামেডিককে ঢুকতে দেওয়া হয়নি ‘নারীদের ক্যাম্পাস’ অজুহাত তুলে। ফলে আমনা বেওয়াজির মতোই ধুহা আলমানেকে মৃত্যুবরণ করতে হয়।

পুলিশ কিংবা ফায়ার ফাইটাররা ঘরে ঢুকতে পারবে না যদি সেই ঘরে একজন নারী, মাহরাম ছাড়া একা থাকেন। বলাবাহুল্য, কঠোর অভিভাবকত্ব ও মাহরামের নিয়ম ভঙ্গ করার চেয়ে মৃত্যু ওখানে পছন্দনীয়।

১৯৯০ সালে রিয়াদের রাস্তায় ৪৭ জন নারীর গাড়ি চালানোর ঘটনার পর কখনো সখনোও এখানে সেখানে নারীরা গাড়ি চালানোর সাহস দেখিয়েছেন। এইসব প্রতিটি ঘটনার ক্ষেত্রে দেখা গেছে- নারীটিকে সৌদি ট্রাফিক পুলিশ স্টেশনে নিয়ে আসা হয়েছে এবং তাঁর অভিভাবককে তলব করা হয়েছে। ‘আর কখনো গাড়ি চালাবে না’ – এই মর্মে জোর করে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে নারীদের কাছ থেকে।

‘ডেয়ারিং টু ড্রাইভ’ বইটি মুসলিম দেশগুলোর নারীদের সপক্ষে, তাঁদের নীরব অশ্রু ও রুখে দাঁড়াবার কাহিনী সমৃদ্ধ এক প্রামাণ্য দলিল। সৌদি নারীরা কীভাবে তাঁদের সামাজিক- সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের জন্য লড়াই করছে – বইটি থেকে আমরা জানতে পারি।

মানাল আল শারিফ সৌদি সমাজে প্রচলিত সামাজিক প্রথা ভঙ্গ করে একজন নারী হয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় গাড়ি চালিয়ে  সংবাদ শিরোনাম হন। যে কারণে তাঁকে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়। যদিও সৌদি বিধিবদ্ধ ট্রাফিক কোডে নারীদের গাড়ি চালানোর বিপক্ষে কিছুই বলা হয়নি। কিন্তু রাষ্ট্রীয় আইন থাকা- না থাকা সেখানে খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। নৈতিকতা রক্ষার ঠিকাদার সৌদির ধর্ম পুলিশের সিদ্ধান্তই সেখানে আইনের মর্যাদায় ভূষিত হয়। প্রভাবশালি শেখদের নিয়ন্ত্রণাধীন তথাকথিত ধর্মবেত্তাদের (academics, religious scholar) ফতোয়া সৌদি সমাজে অন্যান্য প্রচলিত আইনের সমান গুরুত্ববহ এবং অবশ্য পালনীয়।। এরকমই মোরাল পুলিশের পুলিশিং – এর শিকার হয়ে মানাল আল শারিফকে জেলে ঢুকতে হয়।  ‘ডেয়ারিং টু ড্রাইভ’ মূলত মানালের জীবনস্মৃতি আলেখ্য। এই বই পাঠককে এমন এক ঘটনাবহুল, চিত্তাকর্ষক সৌদি সমাজ ও সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেবে-সাধারণত ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহারকারী পিতৃতান্ত্রিক সমাজ যা গোপন করতেই পছন্দ করে।

আমরা অনেকেই হয়তো জেনে থাকব যে সৌদি আরব বিভিন্ন বিধিবিধানের মাধ্যমে নারীদেরকে দমন- পীড়ন করে থাকে। বাধ্যতামূলক পুরুষ অভিভাবকত্ব, গাড়ি চালানোতে বাধা ছাড়াও নারীর জন্য আরও অনেক বাধানিষেধের দুস্তর প্রাচীর খাঁড়া করে রাখা হয়েছে সেখানে,  যা তাঁদের চলাফেরার স্বাধীনতাকে প্রতিনিয়ত খর্ব করছে। মানাল আল শারিফ বিদ্যমান এইসব আবহ ও প্রতিবন্ধকতাকে আঘাত করেন। এই বই থেকে তাঁর একটিভিটির খুব গুরুত্বপূর্ণ দু’টি উদ্দেশ্যে সম্পর্কে আমরা জানতে পারিঃ

এক, নারীর উপর আরোপিত সৌদি নিয়ম-নীতি ও বাধানিষেধের ধরন। যা মূলত পিতৃতান্ত্রিক। নারীর প্রাত্যহিক জীবনের উপর যা সরাসরি প্রভাব ফেলে;

দুই, ধর্মীয় পটভূমি ও ইসলামের কট্টর সালাফি ব্যাখ্যা/মতবাদ। বিভিন্ন সংস্থা তথা পরিবহন, শিক্ষা, কর্মসংস্থান ও আরও অনেক কিছুকে যা প্রতিনিয়ত ক্ষতিগ্রস্ত করছে;

যেসব পাঠক মনে করেন সৌদি আরব ইসলামি মূল্যবোধের পিতৃভূমি ও সৌদিরা সারা মুসলিম জাহানের প্রতিনিধিত্বকারী – ‘ডেয়ারিং টু ড্রাইভ’ পাঠ করতে গিয়ে তাঁরা তাঁদের ধারণার সাথে গভীর দ্বন্দ্বে লিপ্ত হবেন এবং পরিশেষে রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখী হবেন। আল–শারিফ সৌদি আরবের কঠোর সালাফি আদর্শের বেদনাবিধুর বিবরণ হাজির করেছেন বইটিতে, যা সৌদি নাগরিকদের ক্ষত ও ক্ষতির কারণ হিসেবে আজও দাঁড়িয়ে আছে, বিশেষ করে সমাজের অসহায় প্রান্তিক বর্গের মানুষ এর নিষ্ঠুর শিকার হয়ে আছেন।

মানাল আল শারিফ ১৯৭৯ সালে মক্কায় জন্ম গ্রহণ করেন। তরুণী বয়সে সে তাঁর ভাইয়ের সংগ্রহে থাকা ‘ব্যাকস্ট্রিট বয়েজ’ ব্যাণ্ড সঙ্গীতের সিডি পুড়িয়ে দেন, কারণ গান-বাজনা হারাম, ইসলামী আইনে সঙ্গীত  নিষিদ্ধ! তিনি মক্কার জীবন সংগ্রামরত পিছিয়ে থাকা (রাখা) শ্রেণিতে বড় হয়েছেন। ছোটবেলায় তাঁর মা-বাবা তাঁর উপর মারধরসহ খুবই কঠোর আচরণ করতেন, প্রায়শই তাঁর পিতার বর্বরতার শিকার হতে হতো তাঁকে। প্রতিদিনকার জরুরি মৌলিক চাহিদার অভাবে বাঁচতে হতো তাঁদেরকে।

প্রতিষ্ঠিত প্রতিকূল পরিবেশের ভেতরে তাঁকে ও তাঁর পরিবারকে জীবন সংগ্রাম করতে হয়েছে। যেখানে একজন ঘনিষ্ঠ ও নিকটবর্তী পুরুষ আত্মীয় ছাড়া একজন নারীর ঘরের বাইরে বের হওয়া নিষিদ্ধ, যেখানে একজন নারীকে পরিচয়পত্র প্রদানে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছে সৌদি পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা, যেখানে বয়ঃসন্ধির পর একজন মেয়ের যৌন অঙ্গচ্ছেদের (female genital mutilation) চর্চা প্রথা হিসেবে চলে আসছে। এছাড়াও পারিবার ও স্কুল জীবনে তাঁর উপর হওয়া সবরকমের দমন-পীড়নের ভয়াবহ চিত্র তিনি এঁকেছেন। এতদসত্ত্বেও, অবদমিত জটিল পারিবারিক ব্যবস্থার ভেতরেও আনন্দ-বেদনা ও ভালবাসার মিশ্র অভিজ্ঞতা ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুই অর্থেই ফুটে উঠেছে বইটিতে।

বিশেষ করে লেখকের সেই বিদঘুটে বছরগুলোর কথা আমরা জানতে পারি- যখন তিনি সালাফি ইসলামি চরমপন্থী আদর্শে দীক্ষিত হচ্ছেন এবং কঠোর ধর্মীয় অনুশাসনে নিজের জীবনকে সাজিয়ে নিচ্ছেন। বিশদ বয়ানে তিনি দেখাচ্ছেন  কীভাবে ইসলামি উগ্রপন্থা মানুষের জীবনের প্রতিটি দিনকে নিয়ন্ত্রণ করছে। ধর্মীয় আনুগত্যের নামে কল্পিত জাহান্নামের বিভীষিকাময় অবস্থার বর্ণনা দিয়ে শেখানো হচ্ছে- যারা ইসলামের এইসবকিছু (উগ্র সালাফি ইসলামি নিয়ম, রীতি-নীতি, দর্শন) অনুসরণ করবে না তাঁদেরকে ঘৃণা করতে হবে। মানাল একটি ঘটনার কথা বলেন- টেপ রেকর্ডিং-এ তিনি একটি খুতবা শুনেছিলেন যা কি না জাহান্নামের ভয়াবহ অত্যাচারের বিবরণ ঠাসা। তাঁর ভাষ্য থেকে আমরা জানতে পারি:

‘‘আমি অনুভব করতে শুরু করলাম, আদর্শ মুসলমান হওয়ার পথে আমার আগের সকল প্রচেষ্টা দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত ছিল। সেই দিন থেকে আমি ধর্মান্ধতাকে আঁকড়ে ধরি। ঘটনাটি আমার কাছে একেবারেই নতুন কিছু নয়। এইসব ঘটনা একটা পুরো প্রজন্মের মগজধোলাই করে দিয়েছে। প্রজন্মকে চরমপন্থী চেতনায় দীক্ষিত করেছে এবং ঘৃণাজীবী হিসেবে তৈরি করেছে। একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে সামাজিক কারাগারের ভেতরে– এই কারাগার তৈরি করা হয়েছে ধর্মীয় নেতাদের দ্বারা সামাজিক প্রতিবন্ধকতা আরোপ করে এবং পরে আমরা আমাদের নিজস্ব কার্যকলাপের মাধ্যমে তথা আমাদের নিজেদের চিন্তা-চেতনা ও মননের মধ্যদিয়ে একে গড়ে তুলেছি।” 

তাঁর সাম্প্রদায়িক চিন্তা-ভাবনা টিকে থাকেনি, ধীরে ধীরে সে এর থেকে নিজেকে বের করে নিয়ে আসেন। কলেজে তাঁর উচ্চ গ্রেড আরামকোর সাইবার নিরাপত্তা বিভাগে চাকরি পেতে সাহায্য করে। আরামকো সৌদি-আমেরিকান তেল কোম্পানি, যার চৌহদ্দিতে নারীদের উপর ক্রিয়াশীল নিয়মনীতি সৌদির অবশিষ্ট সমাজে চলা অনুশাসন থেকে ভিন্ন। আরামকোর বিস্তৃত চার দেয়ালের ভেতরে একজন নারী গাড়ি চালাতে পারেন, কোম্পানি কোয়ার্টারে থাকতে পারেন। এই অভিজ্ঞতা থেকে তিনি আলোকপ্রাপ্ত হন। তিনি আরামকো কম্পাউণ্ডের ভেতরে ও বাইরে বসবাসরত নারীদের তুলনামূলক পার্থক্য অনুধাবন করতে সক্ষম হন।

কম্পাউণ্ডের বাইরে তাঁর দেশের প্রধান সড়কে গাড়ি চালাতে না পারার ফলে নারীদের ভোগান্তি ও বিপদজনক পরিস্থিতির মুখে উপনীত হওয়ার বিষয়ে তিনি বইটির অনেকগুলো পৃষ্ঠা খরচ করেছেন। একজন নারীকে তিনি চিনতেন যে তাঁর পিতাকে ঘরের ভেতরে চোখের সামনে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়তে দেখেছেন। নারী হয়ে গাড়ি চালানোর অনুমোদন না থাকায় সে তাঁর পিতাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি। নারীদের গাড়ি চালাতে না দেওয়ার প্রতিবাদে তিনি সোচ্চার হয়েছেন। ট্রাফিক নীতিমালা ও আইন-কানুন ঘেটে তিনি দেখেছেন নারীরা গাড়ি চালাতে পারবে না এরকম কোনও আইনই নেই। এখান থেকেই শুরু হয় মানালের অ্যাকটিভিজম। আরামকো কম্পাউণ্ডের বাইরে প্রকাশ্য রাস্তায় গাড়ি চালাতে তিনি মনস্থির করেন। তাঁর অনলাইন অ্যাকটিভিজমের সাথে যুক্ত হন সৌদি আরবের বিভিন্ন প্রান্তে বসবাসরত নারীরা। তাঁরা এই ক্যাম্পেইনের নামকরণ করেন ‘উইমেন টু ড্রাইভ (Women2Drive)’। খুব দ্রুত তাঁদের এই ক্যাম্পেইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এভাবেই মানাল আল শারিফ ইতিহাস সৃষ্টি করেন কিন্তু এর পরিণামে সৌদি সরকারের প্রতিক্রিয়া হয় খুবই ক্ষিপ্র ও নিষ্ঠুর, যার শেষ হয় তাঁর জেলে যাওয়া দিয়ে।

টীকা: বইটি প্রকাশিত হয়েছে ২০১৭ সালে। ইংরেজিতে লেখা বইটির ভাষাশৈলী খুবই সহজ ও সাধারণ। ঢাকার স্বনামধন্য বুকশপে বইটি পাওয়া না গেলেও, অনলাইন থেকে হার্ডকপি/সফট কপি কিনে পাঠ করা যাবে। অবশ্য বইটির ফ্রি পিডিএফও সহজলভ্য। তবে আমি কিনে পড়াটাকেই উৎসাহিত করতে চাই।

রাহাত মুস্তাফিজ: লেখক, ব্লগার, অনলাইন একটিভিস্ট ও আইনজীবী