November 22, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

কতোটা জেন্ডারবান্ধব হলো আমাদের বাজেট?

আফরোজ ন্যান্সি।। এই অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটকে বলা হচ্ছে ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট। কিন্তু কতটা জেন্ডারবান্ধব হলো এই বাজেট?

প্রথমেই বলে রাখি, ২০২০-২১ অর্থবছরের বাজেটে নারী এবং বৃহন্নলাদের (আমি এখানে সচেতনভাবেই তৃতীয় লিঙ্গ শব্দটি ব্যবহার করছি না) জন্য সামান্য আকারে হলেও কিছু সুবিধা রাখা হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার। এবারের বাজেটেই প্রথম নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদাভাবে কর ছাড়ের প্রস্তাব রাখা হয়েছে। এর আগে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য আলাদা কোনো কর অব্যাহতি ছিল না। বর্তমানে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের (SME খাতের) বার্ষিক ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত আয়ের কোনো কর দিতে হয় না। এবারই প্রথম আলাদা করে নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ সুবিধা দেয়া হয়েছে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায় আরো বেশি সংখ্যক নারীকে আগ্রহী করে তোলার উদ্দেশ্যে বাজেটে প্রস্তাব রাখা হয়েছে যে, কোনো নারী উদ্যোক্তার বার্ষিক আয় যদি ৭০ লাখ টাকার কম হয়, তাহলে ওই উদ্যোক্তাকে কোনো কর দিতে হবে না। তবে ব্যক্তিগত আয়ের উপর নির্ধারিত কর আগের মতোই থাকছে। অন্যদিকে, ট্রান্সজেন্ডারদের জন্য ব্যক্তিগত করদাতা হিসেবে করমুক্ত সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তির বার্ষিক আয় সাড়ে তিন লাখ টাকা পর্যন্ত হলে তার আয়ের উপর কোনো কর ধার্য করা হবে না। এছাড়া কোনো  ট্রান্সজেন্ডার ব্যক্তিকে চাকুরি দিলে ওই প্রতিষ্ঠানকে কর ছাড় দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে সরকার। বলা হয়েছে, কোনো করদাতা প্রতিষ্ঠান যদি মোট জনবলের ১০% অথবা ১০০ জনের অধিক ট্রান্সজেন্ডার কর্মচারি  নিয়োগ করে তাহলে উক্ত করদাতা প্রতিষ্ঠানকে দুইভাবে কর অব্যহতি দেওয়া হতে পারে- প্রথমত, প্রদেয় করের ৫% অথবা ট্রান্স কর্মচারিদের পরিশোধিত বেতনের ৭৫% এই দুটির মধ্যে যেটি কম সেই পরিমান কর প্রদান করতে হবে। মূলত এই প্রস্তাব দেওয়ার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরোক্ষভাবে উৎসাহিত করা হয়েছে যেন তারা  বৃহন্নলা কর্মী নিয়োগ করে।

তবে আমাদের মতো রক্ষনশীল সমাজে এ ধরনের পরোক্ষ চেষ্টা কতটা কার্যকরী হবে তা বলাই বাহুল্য। শুধুমাত্র প্রতিষ্ঠানের কর কমিয়ে দিয়ে ট্রান্সজেন্ডারদের কর্মসংস্থান নিশ্চিত করা যাবে এটি ভাবা বোকামি। নিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাইলে অন্যান্য বিষয়র দিকে নজর দিতে হবে। বৃহন্নলা ব্যক্তিরা যেন চাঁদাবাজি, যৌন পেশাসহ সকল প্রকার অনৈতিক কর্মকাণ্ড থেকে বেরিয়ে আসতে পারে সেজন্য সবার প্রথমে তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন এবং এই খাতে বাজেট রাখাও অত্যাবশ্যক। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাজেটে এমন কোনো সুনির্দিষ্ট উল্লেখ নেই। পুনর্বাসন না করেই রাতারাতি তাদের চাকুরিতে নিয়োগ দেওয়ানোর চেষ্টা করাটা নিতান্তই ছেলেমানুষি বলা যায়। এর আগে সমাজসেবা অধিদপ্তরের তরফ থেকে সরকারি চাকুরিতে ট্রান্সজেন্ডাদের নিয়োগের কথা বলা হলেও প্রজ্ঞাপনটির সুনির্দিষ্টতার অভাব, ত্রুটিপুর্ন মৌখিক পরীক্ষা এবং মেডিকেল টেস্ট প্রক্রিয়ার কারণে পুরো প্রচেষ্টাটিই ব্যর্থ হয়। সমাজসেবা অধিদপ্তরের জরিপমতে বাংলাদেশে হিজড়ার সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। প্রকৃত সংখ্যাটি আরো বেশি। এই নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে উৎপাদনমূলক কাজে লাগানোর উদ্দেশ্যে ইতিপূর্বে হিজড়া জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন কর্মসূচী নীতিমালা ২০১৩ প্রণয়ন করা হয়েছে। এই কর্মসূচির আওতায় ছিল-

* বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে কর্মক্ষম হিজড়া জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বৃদ্ধি ও আয়বর্ধণমূলক  কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত করে তাদের সমাজের মূল স্রোতধারায় আনা।

* প্রশিক্ষণোত্তর আর্থিক সহায়তা অফেরতযোগ্য ১০,০০০/-( দশ হাজার) টাকা প্রদান।

* ৫০ বছর বা তদুর্ধ্ব বয়সের অক্ষম ও অসচ্ছল হিজড়াদের বিশেষ ভাতা জনপ্রতি মাসিক ৬০০ প্রদান।

সমাজসেবা অধিদপ্তরেরই আরেক জরিপ থেকে জানা যায়, ২০১৩ থেকে ২০২১ অব্দি এই ৮ বছরে মাত্র ১ হাজার ৯২০ জনকে প্রশিক্ষনের আওতায় আনা গেছে। অন্যদিকে, প্রশিক্ষণোত্তর যে সহযোগীতা দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল সেই কোটা এখন অব্দি শূন্য। বয়স্ক ও অসচ্ছল হিসেবে ভাতা উপকারভোগীর সংখ্যা মাত্র ১।

এমতাবস্থায়, বাজেটে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে কর ছাড়ের লোভ দেখিয়ে ট্রান্সজেন্ডারদেরকে মূলধারার শ্রমব্যবস্থার সাথে যুক্ত করানোর চেষ্টাটি রসিকতা বলে ভ্রম হয়।  বরং তাদের পুনর্বাসন খাতে, সাধারণ ও কারিগরি উভয় প্রকার শিক্ষার খাতে, প্রশিক্ষন ও দক্ষতাবৃদ্ধি খাতে বাজেট রাখলে অনেক যৌক্তিক মনে হতো। এসএমই খাতে আলাদা করে ট্রান্সজেন্ডারদের কথা উল্লেখ থাকতে পারতো। যদি তারা ব্যবসা করতে চায়, সেক্ষেত্রে যেন সহজে কম সুদে ব্যাংক লোন এবং অন্যন্য সুবিধাদি পায় সেটি স্পষ্টত উল্লেখ করা থাকতে হবে। এখানে উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশে যে মুসলিম ও হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের প্রয়োগ আছে, সেখানে পিতা-মাতার সম্পত্তিতে বৃহন্নলা সন্তানের কোনো অংশ নেই। ভূমিহীন মানুষের ব্যাংক লোন পাওয়ার যে জটিলতা তা থেকেও তাদের মুক্ত রাখার সুনির্দিষ্ট ঘোষণা থাকা আবশ্যক। পাশাপাশি উত্তরাধিকার আইনে তাদের অংশ নিশ্চিত করা এখন সময়ের দাবি। একইসাথে সমাজে তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে ব্যাপকভাবে সামাজিক প্রচারনা জরুরি। এই সমস্ত প্রত্যক্ষ সুবিধা প্রদান না করে কেবলমাত্র পরোক্ষভাবে নিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের কর হ্রাসের প্রণোদনা ফলপ্রসূ হবে না কখনোই। বরং মৌলিক অধিকার সম্পর্কে সুনিদিষ্ট নির্দেশনা না দিয়েই ভোটাধিকার প্রদানের মতোই আরো একটি ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে থেকে যাবে এটিও।

অন্যদিকে, নারী উদ্যোক্তাদের কর অব্যহতি দেওয়ার পাশাপাশি নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষার দিকেও বাজেটের সুনজর থাকা উচিৎ ছিলো। স্যানিটারি প্যাড, মেন্সট্রয়াল ক্যাপ ইত্যাদি পণ্য ও এগুলি তৈরির কাঁচামাল আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক অব্যাহতি দেওয়া যেতে পারতো। নারীর স্বাস্থ্যসুরক্ষা সম্পর্কিত পণ্য প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠানগুলিকে কাঁচামাল আমদানি শুল্ক ও নির্দিষ্ট বার্ষিক আয় পর্যন্ত কর অব্যাহতির সুবিধা প্রদান করলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের উদ্যক্তোরা এসব পণ্য তৈরিতে আগ্রহী হয়ে উঠতো ফলে দেশীয় বাজারে এই পণ্যগুলির মূল্য মধ্যবিত্ত ও প্রান্তিক নারীদের নাগালের মধ্যেই রাখা যেত। ফলত নিম্নবিত্ত ও প্রান্তিক নারীদের স্বাস্থ্যসুরক্ষা নিশ্চিত করা সম্ভব হতো।

ব্যবসায়ীবান্ধব বাজেট দেশের উন্নয়নের জন্য যতটা জরুরি ততটাই জরুরি জেন্ডারবান্ধব বাজেটও। শুধু বাজেটই নয়, একটি দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা, আইন-কানুন, নীতি-নির্ধারন কাঠামো যত বেশি জেন্ডারবান্ধব হবে তত দ্রুত এগিয়ে যাবে দেশ। শুধু নির্দিষ্ট একটা জেন্ডারের পৃষ্ঠপোষকতা করে দেশের সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব হবেনা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]