November 3, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

‘‘তুমি মেয়ে, তুমি তো মেয়ে’’

তনুশ্রী মল্লিক।। বুদ্ধি হওয়ার পর থেকে মনে হয়েছে আমাদের সমাজটা অন্ধের দেশে চশমা বিক্রি করার মতো অদ্ভুত, উল্টো রাজার দেশের মতো মনে হয়েছে। হ্যাঁ এতটাই অন্ধ নিয়ম। আর এই নিয়ম জারি করা মানুষগুলো চশমা বিক্রেতা। বেটার হাফ বা অর্ধাঙ্গিনী কথাটা শুনে বড় হওয়া মেয়েটি কি আসলেই পুরুষের ‘বেটার হাফ’ হতে পারে কোনোদিন? কর্মজীবী নারীকে অবশ্যই ভালো গৃহিণী হতে হবে কিন্তু শর্ত একটাই তাকে রোবটের মতো কাজ করে যেতে হবে। স্বামীর কাছে রক্ত-মাংসের রোবটের যদি শরীর খারাপ হয় তাহলে রাজ্যের অস্বস্তি, অবহেলার মধ্য দিয়ে যেতে হবে, খুব বেশি হলে এক-আধটা অষুধের পাতা তার দিকে ছুড়ে ফেলে বলবে – ‘খেয়ে নিও’। কী অদ্ভুত তাই না? যে মানুষটার একটুখানি জ্বরে আপনি অস্থির হয়ে যান, সারারাত মাথার কাছে বসে থাকেন, কখন কী দরকার হয় মানুষটার, কী রান্না করলে সে কিছুটা ভাত বেশি খেতে পারবে ভাবতে ভাবতে নিজের কথাই ভুলে যান, সেই মানুষটা তার কথাকথিত ‘বেটার হাফ’-কে সব রকম চাহিদা পূর্ণ করা রোবট ভাবছে!

রক্ত মাংসের রোবটের সেই সংসার নামক জেলখানাতে থাকা হয়নি বেশিদিন। যেখানে তার মন খারাপের খবর নেয়না কেউ, অসুস্থতার মধ্যে মাথায় হাত রাখেনা কেউ, উনিশ থেকে বিশ হলে মা-বাবা তুলে গালি শেষ পর্যন্ত  আর হজম করা হয়নি। তাইতো তাকে শুনতে হয়েছে ‘স্বামীর ঘর করার যোগ্যতা নেই, ডিভোর্সি’, ‘খুব তো সাহস মেয়েছেলেটার’, ‘কী, স্বামীর টাকায় পোষায়নি বুঝি?’ দিন শেষে নিজের ঘামে ভেজা শরীর আর অফিসের ফাইলের সাথে টিকে থাকার লড়াইয়ে সে এই তীব্র মানসিক যন্ত্রণায় জিতে গিয়েছিল ঠিকই কিন্তু তাতে কি অস্তিত্বকর, অরুচিকর কথার বিষাক্ত তীরের আঘাত থেকে রক্ষা পেয়েছে সে?

অথচ সেই পুরুষকে শুনতে হয়না কোনো কটুবাক্য। আশাপূর্না দেবীর ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’-তে পড়েছিলাম তথাকথিত সমাজের কাছে নাকি তারা সিংহ-পুরুষ, পরশ পাথর। তাদের কোনো ভুল হলেও মানিয়ে নেওয়ার নিয়মের খেলা খেলতে হবে আমাদের এই অন্ধ সমাজের সাথে। অন্ধ সমাজের চোখের চিকিৎসা না করিয়ে চশমা পরিবর্তনে নতুনভাবে কিছুই তৈরি হবে না।

স্কুলটা ছিল গার্লস স্কুল, যাবার পথে যে ছেলেটা প্রতিদিন মেয়েদের বিরক্ত করতো, অরুচিকর কথা বলতো, প্রতিবাদ করলে তার পৈশাচিক রূপটা যেন বেশি প্রকাশ পেতো। একদিন একটি মেয়ের হাত ধরে টানানানির পর থেকে মেয়েটির লেখাপড়াই বন্ধ হয়ে গেলে! বাড়ি থেকে বলা হলো আর অতো লেখাপড়ার দরকার নেই, লোকে ভালো চোখে দেখেনা তাই এখন থেকে ঘরেই থাকতে হবে।

আমরা এর বিপরীত দিকটাও তো দেখতে পারতাম, তাই না? ছেলেটার বিরুদ্ধে কেউ কথা বলছে-  ‘যে ছেলে রাস্তার পাশে আড্ডা দেওয়া, মেয়েদের বিরক্ত করা ছাড়া কোনো কাজ পায় না, ঘরেই থাকবে সেই ছেলে ’।

কিন্তু ওই যে আমাদের সমাজটা অন্ধ! দিনের ঝকঝকে আলোর মধ্যেও পথ হাঁটতে গেলে ভীষণ অন্ধকার মনে হয়। প্রতি পদে পদে যুদ্ধের জন্য নিজেকে তৈরি করে নিতে হয়, কেউ যুদ্ধে সফলভাবে টিকে থাকে, কেউ বা ঘরে বন্দি হয়। চার দেয়ালের বন্দিদশায় কাটাতে হয় বাকিটা জীবন। যাদের কোনো না কোনো কাজে প্রতিদিন বাইরে যেতে হয়, প্রত্যেকটা মেয়ের মা তাকে ঘর থেকে বের হবার আগে কানে গুজে দেয় ‘শোন সাবধানে যাবে, সন্ধ্যার আগে ঘরে ফিরবে’। এটা বলার পাশাপাশি ছেলেটা বের হবার সময় যদি তার কানেও একই ভাবে বলা হতো যে ‘শোন, রাস্তায় কোন মেয়েকে একা দেখলেই ভেবোনা সে তোমার ভোগের সামগ্রী’। আক্ষেপটা এখানেই, একই শিক্ষা একটু আলাদাভাবে দিলে সমাজের সাথে সাথে পৃথিবীটা কতো সুন্দর হতো! শুরুটা করতে হবে তাড়াতাড়ি বা কিছু পরিবারে শুরুটা হয়েছে। এই শুরু করাটা আমাদের জন্য খুব জরুরি। তা না হলে এই অন্ধকার আরও ঘনীভূত হবে আর এমন এক সময় আসবে যখন অন্ধকার দূর করবার কোন পথই পাওয়া যাবে না।

অদ্ভুত লাগে, যখন দেখি সদ্য জন্মানো শিশুটি ছেলে হলে পরিবার পুরো এলাকার লোকজনকে মিষ্টি মুখ করায় আর মেয়ে শিশুর জন্ম হলে পরিবারের সবার মুখ দেখা যায় না। মনে হয় মেয়েটা জন্ম নিয়ে ভীষণ বড় অপরাধ করে ফেললো। আর তার মাও সমান অপরাধী কারণ তার মা ইচ্ছে করলেই ছেলে সন্তানের জন্ম দিতে পারতো! কতোটা অদ্ভুত অশিক্ষিত সমাজে রয়ে গেছি আমরা একটু ভাবলেই অবাক লাগে! খুব বড় বড় ডিগ্রিধারী লোকের ঘরেও স্ত্রী নির্যাতনের শিকার হচ্ছে এখনো এসব কারণে। প্রথম মুখ দেখতে আসা আত্মীয়রা বিভিন্ন কথা বলা শুরু করবে এক বা দু’দিন বয়সী বাচ্চাকে উদ্দেশ্য করে ‘দেখ দেখ হাত-পায়ের আঙুলগুলো কেমন ছোটো ছোটো, মেয়ে নিশ্চিত বেটে হবে, এই যে বউ, তোমার মেয়ের জন্য ছেলে খোঁজা শুরু করো’। আর দশ-বারো বছর হলেই মেয়েটাকে শুনতে হয় জগতের নিকৃষ্ট কিছু কথা – ‘মেয়ের মাথায় তো অনেক চুল, এ মেয়ে কোনো ছেলের সাথে নিশ্চিত চলে যাবে’, ‘মেয়ের দাঁত এমন উঁচু নিচু কেন? যখন কথা বলে তখন দেখলে মনে হয় গরু জাবর কাটছে, দেখো বিয়ে দিতে ঝামেলা হবে’,  ‘ওমা মেয়েকে এতো পড়াচ্ছো! বিয়ে দিয়ে দাও, ওটাই ওর ভবিষ্যৎ’।

মেয়ে হয়ে জন্ম নেওয়া মানেই যেনে বিয়ের জন্য বলী দেওয়া। জন্মের পরমুহূর্ত থেকেই তার জন্য কথার ঝুড়ি সাজিয়ে রাখবে আমাদের কথাকথিত সমাজ। চোখে বার বার আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবে – তুমি মেয়ে, তুমি মেয়ে। যদিও এই ধারার কিছুটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কালের পরিক্রমায় সব কিছুরই পরিবর্তন হয়। এই তিমির রাত্রিতেও পরিবর্তন আসবে, তবে এমনি এমনি আসবে না, নিয়ম নামের কিছু অনিয়ম থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। প্রত্যেকটা মেয়ের আকাশ ছোঁয়ার ইচ্ছে জেগে ওঠাটা খুব বেশি দরকার।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]