December 23, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

নারীবাদ একটি আদর্শ, আপনি বোমা মেরে মানুষকে তা শেখাতে পারবেন না

২০১২ সালের কথা, নারীবাদী রাফিয়া জাকারিয়া ইন্ডিয়ানার প্রায় হাউযফুল একটা সিনেমা থিয়েটারে দেখছেন কীভাবে জেসিকা চেস্টেইনের তত্ত্বাবধানে আল কায়েদা সন্দেহে এক সন্ত্রাসীর নির্যাতন চলছে। ফিল্মের নাম জিরো ডার্ক থার্টি, ক্যাথরিন বিগেলোর কল্পনা মিশ্রিত যুক্তরাষ্ট্রের ওসামা বিন লাদেন গ্রেফতার ও হত্যার কাহিনী। জাকারিয়ার বক্তব্য “পুরো সিনেমাটির আবর্তন একজন ফেমিনিস্টকে কেন্দ্র করে যিনি আমার স্বজনদের মত দেখতে লোকদের অত্যাচার করছেন।”

সিনেমা শেষে যখন হলসুদ্ধ লোক দাঁড়িয়ে সাধুবাদ দিচ্ছিলো, রাফিয়া তার চোখের জল ধরে রাখতে পারেননি, “লিঙ্গ সমতার একি কুৎসিত প্রদর্শন!”

পাকিস্তানী বংশোদ্ভুত রাফিয়া জাকারিয়া একজন আমেরিকান মুসলিম আইনজীবী, রাজনৈতিক দর্শনবিদ এবং একজন মানবাধিকার কর্মী। রাফিয়া কথা বলেছেন “টু দি বেস্ট অফ আওয়ার নলেজ” এর অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পসের সাথে, কীভাবে আফগানিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ‘প্রথম ফেমিনিস্ট যুদ্ধে’ পরিনত হল। এটি গত ১লা অক্টোবর ২০২১ এ প্রকাশিত হয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য কথোপকথনটি অনুবাদ করেছেন অর্চি সাহা ।।

রাফিয়া জাকারিয়া: আফগানিস্তানে নারীবাদী যুদ্ধের গল্পটার শুরু নব্বই দশকের শেষের দিকে যখন ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশন আফগানিস্তানে “স্টপ জেন্ডার এপারথিড” প্রচার শুরু করে। মেভিস লেনো (জে লেনোর সহধর্মিণী) এর কথা শুনে মেরিল স্ট্রিপ, সুজান সার‍্যান্ডনসহ নামী তারকাদের নিয়ে জাঁকজমকপূর্ণ এক তহবিল সংগ্রহের অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: আফগান নারীদের কথা তখন বুঝি তাদের স্মরণ হল?

রাফিয়া জাকারিয়া: একদম। তারপর আসলো ৯/১১, যখন বুশ প্রশাসন আফগান আক্রমনের প্রস্তুতি নিচ্ছে, তখন তারা ফেমিনিস্ট মেজরিটি ফাউন্ডেশনের শরণাপন্ন হয়। এমনকি কলিন পাওয়েল (সেক্রেটারি অফ স্টেট) যখন আক্রমণের ছক ঘোষণা করছিলেন সেখানেও ফাউন্ডেশনের কর্তাব্যক্তিরা হাজির।

আধুনিক ইতিহাসে এটাই সম্ভবত প্রথমবার ওয়েস্টার্ন ফেমিনিস্ট আন্দোলন রাষ্ট্রের কার্যকলাপে নজরদারি করার বিপরীতে, যেমন ভাবে ভিয়েতনাম যুদ্ধে করেছে, যুদ্ধের পক্ষে মত দিয়েছে। হিলারি ক্লিনটন, ম্যাডেলিন অলব্রাইট, লরা বুশ, গ্লোরিয়া ষ্টেইনেম প্রমুখ এদের সমর্থন করেছে। অথচ তখন আদিবাসী আফগান নারীবাদীরা এর তীব্র প্রতিবাদ করে শান্তির পক্ষে স্লোগান দিচ্ছিলেন।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: আসলে এই আক্রমণের মোদ্দা কথা শুধু তালিবান সন্ত্রাসীদের দমন তা না, এটা আফগান নারীদের শিক্ষা, চাকরি, ব্যক্তি স্বাধীনতার অধিকার আদায়ের পথও সুগম করার যুদ্ধ ছিল। এই উদ্দেশ্যকে তো খারাপ বলা যায় না।

রাফিয়া জাকারিয়া: এই উদ্দেশ্যের গলদটা হল এখানে যে আপনি একই সাথে বোমা বিস্ফোরণে সমস্ত দেশ গুড়িয়ে দিয়ে নারীর ক্ষমতায়ন আর অগ্রগতির কথা বলতে পারেন না। এই কথিত উদ্দেশ্যের পেছনে লুকিয়ে আছে রাতের পর রাত বাড়ি বাড়ি অভিযান, বিনা অপরাধে মানুষ আটক, পরিবারগুলোর স্বজনদের খোঁজ না জানা কুৎসিত সত্য। যার ফলে নারীর শিক্ষা, ক্ষমতায়ন, স্বনির্ভরতা ইস্যুগুলো ম্লান হয়ে গেছে কারণ নারীরা বৈদেশিক দখলদারির এই ভয়ংকর কষ্টগুলোর ভিতর দিয়ে যাচ্ছিলেন।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: আপনি কি বলতে চাচ্ছেন প্রশাসন আর সামরিক বাহিনী ইচ্ছাকৃত অন্যায়ভাবে নারীবাদকে ব্যবহার করেছে জনসমর্থন বাড়াবার জন্য? আর মূলধারার আমেরিকান নারীবাদীরা এই গোঁজামিল ধরতেও পারলেন না?

রাফিয়া জাকারিয়া: এটা আসলে একটা দারুন প্রলোভন। যুদ্ধ শুরুর মুহুর্তে আমেরিকান নারীবাদীদের বলা হল “আপনারা শক্তিশালী, স্বাবলম্বী নারী। আমরা আপনাদের আদর্শকে এমন এক দেশে প্রতিস্থাপিত করতে চাই যে দেশে নারীরা বঞ্চিত”। আর এই বক্তব্য খুব বিশ্বাসযোগ্যও ছিল কারণ এটা তাদের দেশকে একটা “উচ্চমার্গের” ভাবমূর্তি দিচ্ছিল। যদিও এই কীর্তিতে “শ্বেতাঙ্গদের দ্বারা প্রাচ্যের পুরুষদের থেকে নারীদের বাঁচান” (উত্তর ঔপনিবেশিক নারীবাদী গায়েত্রি চক্রবর্তী স্পিভাক কর্তৃক প্রচলিত বিখ্যাত প্রবাদ) এই ঔপনিবেশিক বার্তাটিরই পুনরাবৃত্তি হচ্ছিল।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: তারপরও, জোট শক্তির দখলদারির আমলেই একের পর এক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সাহায্য আসতে শুরু করে। এরা আফগানিস্তানে মেয়েদের জন্য শিক্ষা, আশ্রয়, সরকারি চাকরির সুযোগ তৈরি করে। তাতে বাস্তবিকই কি নারীদের জীবনমানের উন্নতি হয়নি?

রাফিয়া জাকারিয়া: আমি পাকিস্তানের মেয়ে, এ ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ আমাদের অঞ্চলে অসংখ্য দেখতে পাবেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে এতে মেয়েদের উন্নতিই হচ্ছে। আসলে এটা একটা গরু মেরে জুতা দান প্রজেক্ট, বিদেশি অর্থ সাহায্যের বেশিরভাগ বিদেশিরাই নেন, আর নারীদের জন্য সামজিক কর্মকাণ্ডে বা রাজনীতিতে সুযোগ সৃষ্টি বিদেশিদের জন্য একটা দুরূহ ব্যাপার।

তাই এটাকে আমি একটা জুয়া খেলা বলি। কিছু নারীবাদীকে সামনে রেখে লোকদেখানো উন্নতির আড়ালে আফগানি নারীদের আসল বাস্তবতা খুব একটা পাল্টায়নি।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: এটাকেই কি আপনি “ট্রিকল ডাউন ফেমিনিজম” বলছেন?

রাফিয়া জাকারিয়া: একদম। ট্রিকল ডাউন ফেমিনিজম হল কীভাবে ফেমিনিস্টদের দ্বারা আফগানিস্তানে নারী উন্নয়ন ব্যর্থ হল তার উদাহরণ। আদপে এটা শক্তিশালীদেরই শক্তি জুগিয়েছে, দুর্বলদের নয়, এটাই এর প্রথম শিক্ষা। আপনি বোমা মেরে মানুষকে নারীবাদ শেখাতে পারবেন না। এছাড়া নারীবাদ একটা আদর্শ, কোনো প্রযুক্তিগত উৎকর্ষতা নয় যা দিয়ে রাতারাতি জীবন পাল্টে ফেলা যায়। কিন্তু আজকের এই নব্য উদারনীতির যুগে এই ধারণা সর্বত্র বিদ্যমান। মানুষ ভাবে একটা ক্ষুদ্র ঋণ, মুরগি বা সেলাই মেশিন থেকে বুঝি ব্যাবসা দাঁড় করানো যায়; বাস্তবতা তা না।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: কারণটা কি এটাই যে পৃথিবীর সবাই আমেরিকান নারীবাদীদের শেখানো মুক্তি বা ক্ষমতায়ন চায় না?

রাফিয়া জাকারিয়াঃ হ্যাঁ। যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের জন্য অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের জীবন বৈশ্বিক রাজনীতির প্রভাব থেকে অনেকটাই মুক্ত। তাদের লড়াই শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের সাথে, সমতা অর্জনের লক্ষ্যে । অন্যদিকে, আফগান নারীদের জন্য অন্যান্য মৌলিক বিষয় যেমন জীবনের নিরাপত্তা বেশি অগ্রগণ্য। তাই  তালিবানদের কপচানো “সহি ইসলামের” নিয়মের বিরুদ্ধে নারীদের সঠিক ইসলামিক শিক্ষা দিয়ে প্রতিবাদ করতে শেখানোটা বেশি জরুরি।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: আপনার কি মনে হয় না এসব আসলে ঔপনিবেশিকতারই নোংরা প্রভাব?

রাফিয়া জাকারিয়া: হ্যাঁ। বেশ কিছু বছর আগে “হোয়াইট সেভইওর ফেমিনিস্ট বার্বি” বলে একটা হাস্যকর ধারণার প্রচলন শুরু হয়েছিল যেখানে কৃষ্ণাঙ্গ ও ভারতীয় মেয়েদের সামনে শ্বেতাঙ্গ নারীদের আদর্শ হিসেবে তুলে ধরা হতো। এটা অনুধাবন করাটা খুব প্রয়োজন যে পশ্চিমা নারীবাদীরা নিজেদের আদর্শ ভাবার তুলনাটা কোত্থেকে পায়। তারা ভাবে আমরা পাশ্চাত্যের জনগনই প্রগতিশীল, উদার, নেতৃত্বদানকারী; বাকিরা সব নির্যাতিত, পিছিয়ে পরা, সমঅধিকার-স্বাবলম্বনের লড়াই থেকে বহু দূরে বসবাস করা জনগণ। ঔপনিবেশিকতা এই কৌলিন্যবাদই মজ্জাগত করে দিয়ে গেছে।

অ্যান স্ত্রেইনচ্যাম্পস: প্রকৃত সিস্টারহুড কি রকম হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন?

রাফিয়া জাকারিয়া: আমার মতে আমাদের উচিত আন্তরিকভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে অন্যদের জটিল পরিস্থিতি বিবেচনা করে সুনির্দিষ্টভাবে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের বুঝতে হবে, আমরা যে সমাজ থেকেই আসি না কেন আমাদের প্রকৃত লড়াইটা আসলে পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে। আমার মতে এটা বাস্তবায়ন করা সম্ভব। আমি দেখেছি আমেরিকার তরুণ প্রজন্ম কতটা সহমর্মী, অন্যদের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবগত। আমি আশাবাদী এই আন্দোলন সফল হবেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *