September 20, 2024
কলামফিচার ৩

পুরুষ, তুমি নারীর সঙ্গে কী করেছো?

তানিয়া কামরুন নাহার ।।

 “পুরুষ, তুমি নারীর সঙ্গে কী করেছো?

নারী এমন জয়োল্লাসে হাসছে কেন?

পুরুষ, তুমি নারীর সঙ্গে কী করেছো?

নারী এমন অভিমানে কাঁদছে কেন?

পুরুষ, তুমি নারীর সাথে কী করেছো?”

(নির্মলেন্দু গুণ)

আজ ১৯ নভেম্বর,  আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস!

হ্যাঁ, ঠিকই শুনছেন, পুরুষ দিবস। নারী দিবস থাকলে পারলে পুরুষ থাকবে না কেন, নিদারুণ বৈষম্য – এসব বলে যারা চিল্লাপাল্লা করেন, তারা জেনে রাখুন আজ আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস। প্রতি বছর ঘটা করে আন্তর্জাতিক নারী দিবস উদযাপন করা হলেও আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবস নিয়ে আলোচনা বলতে গেলে হয়ই না। নারী দিবস উপলক্ষে অন্তত মার্চের প্রথম সপ্তাহ জুড়ে নানা রকম বিজ্ঞাপন প্রচারিত হয়। নির্মাণ করা হয় বিশেষ নাটক। পত্রিকায় বিশেষ কলাম প্রকাশিত হয়। আর টক শো তো আছেই। কিন্ত পুরুষ দিবস উপলক্ষে টিভিতে এ নিয়ে কোন অনুষ্ঠান, নিদেনপক্ষে বোরিং একটা টক শোও হয় না। পুরুষদের এতো এতো প্রসাধন সামগ্রীর (রঙ ফর্সা করার ক্রিম, শেভিং ক্রিম ইত্যাদি) ব্র‍্যান্ড, সেগুলোও একটা বাণী সমৃদ্ধ বিজ্ঞাপন প্রচার করে না। এর মধ্যে বিশ্ব টয়লেট দিবসও একই দিনে পড়ে যাওয়াতে বিশ্ব পুরুষ দিবসের গুরুত্ব হারিয়ে একেবারে ট্রলে রূপান্তরিত হয়েছে। অথচ বিশ্বে জেন্ডার সচেতনতা তৈরি ও জেন্ডার সমতা আনার জন্য দিনটির তাৎপর্য রয়েছে। ২০২১ সালে দিবসটির থিম  “Better relations between men and women.”

নারী ও পুরুষের মধ্যে আরো ভালো সম্পর্কের উপর জোর দেয়া হচ্ছে। তার মানে কোথাও না কোথাও এ সম্পর্কটি ভালো যাচ্ছে না। নর-নারীর সম্পর্ক তো শুধু প্রেমেরই নয়। পুরুষেরা আমাদের বাবা, ভাই, স্বামী, সন্তান, প্রেমিক, বন্ধু, সহকর্মী এবং কেউই না। কত রকমের সম্পর্কে নারী পুরুষ একে অপরের সাথে সম্পর্কিত। এ সমাজে নারী ও পুরুষের পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব, সুস্থ, সুন্দর, বন্ধুত্বপূর্ণ ও শ্রদ্ধাশীল সম্পর্ক কতখানি অর্জিত হয়েছে তা একটি বড় প্রশ্নই বটে।

বর্তমানে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাচ্ছে, নারী তার অধিকার নিয়ে দিন দিন সচেতন হচ্ছে, বাড়ছে ঘরে ও বাইরে নারীর ক্ষমতায়ন। আবার একই সাথে প্রাচীন পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবও রয়ে গেছে সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নারীর সচেতনতা ও পুরুষতান্ত্রিকতা সব একসাথে মিলেমিশে আমরা যেন জগাখিচুড়ি মার্কা একটি ট্রানজিশন পিরিয়ডে অবস্থান করছি। এ অবস্থায় ঘরে, বাইরে, কর্মক্ষেত্রে নারী ও পুরুষের মধ্যে তৈরি হচ্ছে এক ধরণের অস্বাস্থ্যকর দ্বন্দ্ব, বৈরিতা, বিদ্বেষ। যেন নারী ও পুরুষ পরস্পরের প্রতিপক্ষ, একে অপরের জনম জনমের শত্রু! অথচ শিক্ষা ও সচেতনতা বৃদ্ধি পাবার ফলে হবার কথা ছিল উল্টো।

নারী এখন আগের চেয়েও আরো বেশি চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করছে। যতই দিন যাচ্ছে নারীর জীবন ততই চ্যালেঞ্জিং হয়ে যাচ্ছে। কর্মক্ষেত্রে নারীকে পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে হচ্ছে, এটা একটা চ্যালেঞ্জ। আগে নারীরা ঘরেই থাকতো, নানাভাবে অত্যচারিত হতো, যৌন হয়রানির শিকার হলেও মুখ বুঁজে থাকতো। এখন নারী এসবের প্রতিবাদ করছে, এটাও একটা চ্যালেঞ্জ। নারীকে একই সাথে তার কর্মক্ষেত্র ও সংসার সমানভাবে ম্যানেজ করে চলতে হয়। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ। এছাড়াও নারী এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। মোবাইল, ইন্টারনেট, সামাজিক যোগাযোগের সাইট ব্যবহার করতে গিয়ে নারী আরো চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। নিজেকে সাইবার ক্রাইম, ব্ল্যাকমেইলিং বা গুজবের ফাঁদ থেকে দূরে রাখতে গিয়ে নারীকে চ্যালেঞ্জিং হতে হচ্ছে। আর সব কিছু বাদ দিলেও, নারীকে প্রতিনিয়ত যে সামাজিক কটাক্ষ সহ্য করে চলতে হয়, এটাও বড় একটি চ্যালেঞ্জ। নারীকে নানা রকম বাধাবিঘ্ন পার হয়ে, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে উপেক্ষা করে, তার বিরুদ্ধে সব সহিংসতাকে জয় করে পুরুষের পাশাপাশি  চলতে হচ্ছে রুক্ষ কঠিন পথে। এত এত চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হয়ে যেন কখনো কখনো নারী ক্লান্তি ও হতাশায় খেই হারিয়ে ফেলে। এ পথে চলতে গিয়ে পুরুষের সহযোগিতা যেমন সে পাচ্ছে তেমনি আবার পুরুষই হয়ে পড়ছে তার চলার পথের বড় বাধা। তাই নারী পুরুষের সুন্দর সম্পর্কের কথা ভাবতে হবে সবার জন্যই।

নারীর সাফল্যকে অনেক পুরুষই স্বাভাবিকভাবে গ্রহণ করতে পারে না। তারা নিজেদের অবস্থান নিয়ে একটি মানসিক অনিশ্চয়তায় ভোগে। পুরুষ ভাবে, নারী বুঝি তার জায়গা দখল করে ফেলছে। তাই নারীর সাফল্যকে তারা বেশিরভাগ সময় খাটো করে দেখে নিজেকে মিথ্যে সান্তনা দিয়ে রাখতে চায়। অনেক সময় তারা মনে করে নারীরা তাদের সৌন্দর্য ব্যবহার করে কিংবা নারী বলে বিশেষ সুবিধা পেয়ে পেয়ে সহজে এ সাফল্য পেয়েছে। এছাড়াও নারীদের একটি বড় অংশ এখনো অনগ্রসর। তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে কোটার কারণে নারীদের সুবিধা প্রদান করা হয়ে থাকে। অনগ্রসর নারীদের আরো সামনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য কোটার প্রয়োজনও রয়েছে। এই কোটা সুবিধার জন্য অনেক সময় পুরুষ বাদ পড়ে যায় বলে তাদের মধ্যে নারীর বিপক্ষে এক ধরনের ক্ষোভও তৈরি হয়। আবার অন্যদিকে নারী সমঅধিকারের দাবীও তোলে। তাই নারীকে পুরুষ তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে দেখে এবং কোনো ধরণের সহযোগিতা করতে চায় না। এভাবেও সম্পর্কের মধ্যে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের জায়গাগুলো নষ্ট হয়ে যায়।

এরপরেও ঘরে বাইরে প্রতিনিয়ত আমাদের পাশে থেকে পুরুষেরা সাহায্য ও সহমর্মিতার হাত বাড়িয়ে দেন, সম্মানজনক আচরণ করেন এ কথা অস্বীকার করা যায় না। সবচেয়ে সুন্দর হলো, পুরুষ নারীকে ভালোবাসে।

তাই আন্তর্জাতিক পুরুষ দিবসের মতো এমন একটি দিন নারীদের জন্য সুযোগ এনে দিতে পারে, দায়িত্ববান পুরুষদের  লাল গোলাপ উপহার দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর। এভাবেই সম্পর্ক সুন্দর করার পথে এক ধাপ এগিয়ে যেতে পারি আমরা।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *