November 22, 2024
কলামফিচার ২

মেঘলা হত্যা এবং আমাদের মেয়েরা

মেহেরুন নূর রহমান ।। সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী মেঘলার মৃত্যুর পর আমি আমি আমার ফেসবুক ওয়ালে একটা লেখা লিখেছিলাম। লেখার বিষয়বস্তু ছিল কী করে পরনির্ভরশীল মনোভাব এবং আত্মবিশ্বাসহীনতা মেঘলার মত শিক্ষিত মেয়েদেরও প্রেডিটরদের কাছে সহজলভ্য করে তোলে। আমার পরিচিত অনেকেই ইনবক্সে মেসেজ করেছেন এবং বলেছেন যে লেখাটা অনেকটা ভিকটিম ব্লেইমিং হয়েছে। ভিকটিম ব্লেইমিং যেহেতু পছন্দ নয় তাই আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য এই লেখাটি লেখা।

এই যে ক্রমাগত মেয়েরা তাদের স্বামী বা প্রেমিকের হাতে খুন হচ্ছে বা ঘরে-বাইরে রেইপড হচ্ছে,  সেসব প্রত্যেকটি ঘটনার একটি কমন ব্যাপার হচ্ছে মেয়েদেরকে কন্ট্রোল করা, দমন করা, মেয়েদেরকে মানুষ মনে না করা, তুচ্ছাতিতুচ্ছ জ্ঞান করা। এই কমন বিষয়টির বাইরে প্রত্যেকটি ঘটনার আলাদা আলাদা কিছু কনটেক্সট থাকে।

যারা এসব নিয়ে লেখালেখি করেন তারা সাধারণত প্রত্যেকটির ঘটনার পরে অপরাধীর বিরুদ্ধে লেখেন, খুন হলে যে মারা গেছে তার বাবা-মার বিরুদ্ধে লেখেন যেহেতু বাবা মা মেয়ের দুঃসময়ে পাশে দাঁড়ায় না; সমাজ এবং রাষ্ট্রব্যবস্থা নিয়ে লেখেন এই জন্য যে এখনো আমাদের রাষ্ট্র বা সমাজ নারীকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ। এবারও এরকম লেখা অনেকেই লিখেছেন। আমি নিজেও বহুবার এধরনের লেখা লিখেছি।

এটা অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে প্রমাণিত যে মেঘলার স্বামী একজন ক্রিমিনাল। পুলিশ তাকে ধরেছে এবং আশা করছি তার কঠিন শাস্তি হবে। আগেই বলেছি প্রত্যেকটি ঘটনার ভেতর কিছু নিজস্ব ঘটনা থাকে। মেঘলার ঘটনার ব্যাপারেও কিছু বিষয় নজরে এসেছে যার জন্য তাকে নিয়ে আমার লেখা।

প্রথমত মেঘলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া শিক্ষিত একজন মেয়ে। সে বিয়ে করেছিল অপরিচিত একজন লোককে পরিচয়ের সাত দিনের মাথায়, যাকে সে সামনাসামনি দেখেনি। বাবা-মা তাকে জোর করে বিদেশি স্বামীর সাথে বিয়ে দেয়নি। সে লোকটির দেয়া কিছু প্রতিশ্রুতিকে আগে পিছে না ভেবে খুব দ্রুত বিশ্বাস করে পরিবারের অমতে লোকটিকে বিয়ে করেছিল। তাকে কানাডা নিয়ে যাবার বা ছোট বোনের লেখাপড়ার দায়িত্ব নেবার মত প্রলোভনের ফাঁদে পা দিয়েছিল।

আমি মনে করি এ ধরনের প্রত্যেকটি ঘটনার পর কান্নাকাটির পাশাপাশি আমাদের তা থেকে শিক্ষা নেয়া খুব দরকার। মেঘলা মারা গেছে, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা তো কিছুই হতে পারে না। আমাদের কষ্ট হচ্ছে। আমরা প্রতিবাদ জানাচ্ছি, দোষীর শাস্তির কথা বলছি এবং এই সব ঠিক আছে। কিন্তু এর সঙ্গে সঙ্গে এটাও ভাবা জরুরি যে আমাদের কী করা উচিত যাতে এরকম ঘটনার পুনরাবৃত্তি না ঘটে বা অন্য মেয়েরা এত সহজে প্রেডিটরদের ফাঁদে পা না দেয়।

আমরা জানি আমাদের দেশে মেয়েরা অনেক বৈরী পরিবেশে বড় হয়। পরিবার, সমাজ তাকে আত্মনির্ভরশীল হতে সাহায্য করে না। আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার চর্চা তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে না। কিন্তু তারপরও আপনি আপনার চারপাশে অনেক আত্নবিশ্বাসী, আত্মনির্ভরশীল নারী দেখবেন যারা  নিজের সাথে সাথে নিজের পরিবার দায়িত্বও পালনে সক্ষম। যারা নিজের স্বপ্নপূরণের জন্য অন্যের আশায় বসে থাকে না। অনেক নারী আছে যারা নারীবাদ চর্চা করে, মেয়েদের রাইটস নিয়ে কথা বলে। এরা সবাই  কিন্তু একই পরিবেশেই বড় হওয়া মানুষ। কিন্তু তারা তাদের শিক্ষা, তাদের পড়াশোনা,  চলমান জীবন, চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা দেখে নিজেদের উপলব্ধিকে সমৃদ্ধ করেছেন, নিজেদের ক্রমাগত পরিবর্তন করেছেন , সচেতন হয়েছেন।

আত্মবিশ্বাস, আত্মসচেতনতার সাথে শিক্ষা/পড়াশুনা (শুধু প্রাতিষ্ঠানিক না) ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সুযোগ বা পরিবেশে একটি বড় বিষয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া একটি মেয়ে কিন্তু পরিবারের বাইরে গিয়েও নিজেকে সমৃদ্ধ করার সুযোগ পায় যেটা হয়তো পড়ার সুযোগ না পাওয়া একটি মেয়ের পক্ষে সম্ভব না। তাই গ্রামের অল্পশিক্ষিত একজন কিশোরীর মধ্যে আমরা যে সচেতনতাটুকু দেখব তার চেয়ে দেশের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়া একটি মেয়ের সচেতনতা বেশি হবে এটাই আশা করি। একজন অল্পবয়সী অথবা অল্পশিক্ষিত মেয়েকে যত সহজে ম্যান্যুপুলেট করা করা যাবে একজন শিক্ষিত সচেতন মেয়ে তত সহজে ম্যান্যুপুলেটেড হবে না এটা  আমি বিশ্বাস করতে চাই। আপনি সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠে পড়েন, যেখানে আপনার চারপাশে অনেক সুযোগ সুবিধা রয়েছে, তারপরও যদি নিজেকে সেভাবে শিক্ষিত করে তুলতে না পারেন বা নিজের ভেতর সচেতনতা গড়ে তুলতে না পারেন এবং মন্দ-ভালোর পার্থক্য না করতে পারেন তবে সে শিক্ষায় কী লাভ?

বিয়েই সকল সুখের চাবিকাঠি  এটা মনে করা কিংবা শিক্ষিত এবং ক্যাপাবল হবার পরও জীবনে স্বাচ্ছন্দ্য বা সুখের জন্য অন্যের উপর নির্ভরশীল হওয়া কাজের কথা না। মেয়েদের এই পরনির্ভরশীল মনোভাবের  কারণেই পুরুষরা নিজেদের নারীদের ত্রাণকর্তা অথবা প্রভু বলে মনে করে এবং তার হাত ধরে আসে নানা রকম শারীরিক এবং মানসিক অত্যাচার। পরনির্ভরশীল মনোভাবের কারণেই প্রেডিটররা খুব সহজেই মেয়েদেরকে ম্যান্যুপুলেট করে তাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে আসতে পারে। সুখের লোভ দেখিয়ে, বিত্তের লোভ দেখিয়ে, বিদেশে যাবার লোভ দেখিয়ে অতি দ্রুত তাদের শিকার বানিয়ে নিতে পারে। জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য, ভালো থাকার স্বপ্ন সবারই থাকতে পারে, সেটা কোন দোষের নয়। কিন্তু সেটা যদি শর্টকাটে অন্যের মাধ্যমে পূরণের স্বপ্ন দেখে থাকেন তবে বেশিরভাগ সময় সেটা অপূর্ণই থেকে যায়।

কোনো একটা ঘটনা ঘটলে আমরা মেয়েদের বেড়ে ওঠা, পরিবার, সমাজ  ব্যবস্থা এসবকে দোষ দিতে পারি, কীভাবে এই দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়া যায় সে নিয়ে কথা বলতে পারি। কিন্তু শুধু এসবকে দোষ  দিয়ে, কান্নাকাটি করে নিজেকে ভিকটিম মনে করে হাত- পা গুটিয়ে বসে থাকা কাজের কথা নয়। পরিবার বা সমাজ  আপনাকে  হয়তো সাহায্য করেনি, কিন্তু কীভাবে আপনি আপনাকে সমৃদ্ধ করতে পারেন, কীভাবে নিজের ভেতর পরিবর্তন আনতে পারেন, সে চিন্তা এবং চর্চাটা ভীষন জরুরি। আমাদের নারী হিসেবে বেড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় যে কমতিগুলো রয়ে গিয়েছিল সেগুলো কী করে পূরণ করা যায় সে চেষ্টা আমাদেরই করা দরকার। এই নিয়ে প্রচুর লেখালেখি দরকার, কথা বলা দরকার, মেয়েদেরকে বোঝানো দরকার। মনে রাখবেন জীবনে কোনো সমস্যা হলে অন্য কেউ এসে আপনাকে সে সমস্যার সমাধান করে দিয়ে যাবে না। আপনাকেই উপায় বের করে নিতে হবে সেখান থেকে বের হওয়ার। নিজের স্বার্থেই আপনার নিজেকে সচেতন করে তুলতে হবে।

আমার আগের লেখাটির উদ্দেশ্য ছিল মেয়েরা যেন আত্মনির্ভরশীল হয়। যেন তারা সচেতন হয়। যেন সহজে প্রলোভিত না হয়। যেন কোনো একটি সিদ্ধান্ত নেবার আগে ভালোভাবে চিন্তাভাবনা করে। দয়া করে মেয়েরা যেন মনে করে যে আমার হাত আছে, পা আছে, বুদ্ধি আছে, শিক্ষা আছে; আমি কেন আমার জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বা সব সমস্যার সমাধানের জন্য একজন পুরুষের উপর নির্ভর করবো? একজন পুরুষ আপনার স্বামী বা জীবনসঙ্গী হবে, আপনারা সুখে-দুখে একজন একজনকে সাপোর্ট করবেন ইমোশনালি এবং ফাইনান্সিয়ালি (যদি সম্ভব), কেউ কাউকে কারো প্রভু বা দাসী মনে করবে না – এটাই তো কাম্য।

আমি গভীরভাবে বিশ্বাস করি, আত্মবিশ্বাস থাকলে, আত্মসন্মানবোধ  থাকলে, আত্মনির্ভরশীল হলে আপনি যে অবস্থাতেই থাকেন না কেন এত সহজে ম্যান্যুপুলেটড হবেন না বা সহজেই কেউ আপনাকে প্রলুব্ধ করতে পারবে না। এবং আপনার উপর অত্যাচার হলে তার প্রতিবাদ করতে পারবেন, প্রয়োজন হলে সেখান থেকে বের হয়ে আসার মত সাহস অর্জন করতে পারবেন। এই সচেতনতা যেন মেয়েদের মধ্যে বৃদ্ধি পায় সেটাই আমার আগের লেখার উদ্দেশ্য ছিল।

অন্যের মাধ্যমে নিজের স্বপ্নপূরণের স্বপ্ন না দেখে নিজের স্বপ্ন নিজে পূরণে সক্ষম হন, পারলে অন্যের স্বপ্ন পূরণের মাধ্যম হন আপনি। সূর্যমুখী ফুল হয়ে উঠুন, মাটির দিকে না তাকিয়ে সূর্যের মুখোমুখি দাঁড়ান।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *