September 20, 2024
মুক্তমত

টিপ এবং সমাজের আদিম রূপরেখা দর্পণ

সাদিয়া মেহজাবিন ।। আয়না আর টিপ! একদম পরিপূরক। আমরা ছয় বোন। ছোট থাকতে দেখতাম আপারা একজন আরেকজনকে টিপ লাগিয়ে দিচ্ছে। এরপর সেঝ আপাকে দেখতাম প্রতিদিন টিপ দিয়ে সিটি কলেজ যেত। সাজ বলতে টিপ আর লিপলাইনার দিয়ে হালকা ঠোঁট সাজানো। কলেজ থেকে ফিরে টিপ আয়নায় সেঁটে দিত। আয়না হয়ে উঠতো নান্দনিকতায় ভরা একটা ছোট পাতাবাহারী গাছ। আমার বেশ পছন্দের ছিল আয়নাটা। আপুদের ড্রেসিং টেবিলের উপর আজন্ম লোভ ছিল, তবে বড় হয়ে আর এসবে শখ বন্দী থাকেনি।

ধীরে ধীরে আবহাওয়া বদলাতে লাগলো। মেয়েরা তখন জিন্স পরত, টিপ লাগাতো, কিন্তু  বি এন পি এবং পরে এরশাদ সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে মৌলবাদের উত্থান হলো, উগ্রবাদী মানসিকতা বাড়লো, মেয়েদের জিন্স পরাও সীমিত হয়ে আসলো। জিন্স পরলেই অনেকে পুরুষের কাপড় বলে চিহ্নিত করত। কিন্তু সে সময়ও ধীরে ধীরে চুকে গেছে। পোশাকের রূপরেখা বদলাতে থাকে। কিন্তু একটা জিনিস আগের মতই সুন্দর ছিল আমার কাছে। শাড়ি আর টিপ! শাড়ি না পরলেও টিপ ছিল খুব প্রিয়!

কিছুসময় পর ডিশ লাইন বা অনেক চ্যানেল নিয়ে টেলিভিশনের এক নতুন যাত্রা হলো। বিচিত্র চ্যানেল সব, আমরা খুব মজা করে এইচবিও’তে ইংরেজি অনেক সিনেমা দেখতাম। কিন্তু টেলিভিশনে তখন প্রবলহারে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে ‘হিন্দি সিরিয়াল’। এদিকে আবার দেশের বেশিরভাগ আত্মীয়ের অমুক-তমুক সৌদিআরব, কাতার, দুবাই প্রবাসী। তারা ছুটিতে এলেই সে দেশের পোশাক নিয়ে আসতো। সবই লম্বা গাউন অথবা বোরকা। কিন্তু মনে পড়ে একদা এক আত্মীয়ের ভাই ফিরতি যাওয়ার সময় বলে গিয়েছিলেন, এসব ভারতীয় চ্যানেল দেখবেন না আপনারা। এসব হিন্দুয়ানী জিনিসপত্র শেখায়।

অনেকবছর কেটে গেল, সে আত্মীয়ের সাথে আর দেখা হলো না কিন্তু ততদিনে বইপুস্তক ঘেঁটে জেনেছি প্রত্যেক দেশের সংস্কৃতির বৈচিত্র আছে এবং পোশাকও তার অন্যতম। বাংলাদেশের নিজেদের সংস্কৃতি বলতে তাও মিশ্র কিন্ত টিপ বাংলারই! বাংলার পুরানো অনেক চিত্রকর্মেও তার নিদর্শন মেলে। তবে একা বাংলার না এ কথাও সমান সত্য। ভারতীয় অংশও আছে। কিন্তু ধারণা করা যায় এক অংশ সিরিয়াল দেখে এবং প্রবাস-ফেরত এসবের মিথ শুনে আস্থা হয়, টিপ হিন্দুয়ানী ব্যাপার! তবে এও সম্পূর্ণ সঠিক নয় কেননা বাংলাদেশের উত্থানে নজর দিলে দেখা যায়, তখন আমরা প্রথমে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ হলেও পরবর্তীতে নিজস্ব পরিচয় পেতে ভাষাসহ মৌলিক অধিকার নিয়ে নয় মাস যুদ্ধ করে জয়ী হই। তাই সামান্য নজরেই বোঝা যায়, ধর্মের বীজ আছেই বাংলায়। তখনো হিন্দুদের সিঁদুর আর টিপ দিয়েই চিহ্নিত করতো লোকেরা, এবং ধর্ষণ করতো সে সময় থেকেই।

প্রযুক্তি, কাল, পাত্র সবই বেগ পেয়েছে কিন্তু এখনো আমরা মীমাংসা করতে পারিনি আমাদের নানান প্রশ্নের। টিপ সুন্দর! তাই বলে আপনাকে পরতেই হবে এমনটা নয়, আবার যারা ভালোবেসে পরছে তাদেরকেও আপনি গ্রাহ্য করবেন না, তা নয়। টিপের অনেক ধরণ আছে। যার যেমন ভালো লাগছে পরছে। আর নিশ্চিত পোশাক সংবিধান নির্ণয় করতে পারে না।

কিন্তু কদিন আগে তেজগাঁও কলেজের শিক্ষিকা লতা সমাদ্দার ইভটিজিং এর শিকার হন। পুলিশের একজন কর্মকর্তা লতাকে ‘টিপ পরছোস ক্যান’ বলে গালি দেন এবং পর্বরর্তীতে আরো গালিগালাজ করে উনার পায়ের উপর দিয়ে বাইক চালিয়ে যান। এবং লতা সমাদ্দার প্রতিবাদ করায় আরো গালিগালাজ করেন সে পুলিশ কর্মকর্তা। এখন বলুন, এই পুলিশ কর্মকর্তারা কি একজন? এদের মস্তিষ্ক কি আদৌ সুস্থ? দেশের বাদবাকি জনগনের কি সমভাবনা নেই টিপ নিয়ে?

টিপ অথবা জিন্স যাই হোক, এই সমাজের প্রচুর মাথাব্যাথা নারীকে নিয়ে। কেননা সমাজের আদিম রূপরেখায় দেখা যায়, ধর্ম বলে জিহাদ কর, যেভাবেই হোক আলোর পথে আনো, নারীদেরকে ঢেকে রাখো। তাই এতে আর সমাজতত্ত্ব খাটে না, ইতিহাসতত্ত্বও নয়।

তবুও সময়ের প্রবাহে আর লোকে কে কী বলছে এসবে মনযোগী নয়। যে যার ইচ্ছে মত একটু বাঁচার প্রচেষ্টায় আছে। যারা ধীরে ধীরে ব্যক্তিকেন্দ্রিক চিন্তা করতো তারা বাদেও অনেকে বুঝতে শিখেছে লোকের আলাদা বুদ্ধি, নৈতিকতা যেমন আছে, তেমন রুচি, ভালো-লাগাও আছে। কিন্তু আবারো কাঠমোল্লাসহ যারা নতুনভাবে জাগরণের সুযোগ পেয়েছেন এবং নিশ্চিত প্রযুক্তির অপপ্রয়োগ করে ভুলভাল ফতোয়াগুলো লোকের দরজায় পৌঁছে দিয়েছেন তখনই  আবার পুরানো বীজ একে একে বাম্পার ফলন দেওয়া শুরু করে। এখন দেশের যে কোণাতেই যান না কেন ওয়াজ মাহফিলে ভরপুর একটা পরিস্থিতি দেখতে পারবেন। এছাড়া বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে কাজে লাগাতে সরকার যখনই এদের কাজে লাগাতে শুরু করেছে, সুযোগ বুঝে কোপ মেরে দিয়েছে এরা। ধীরে ধীরে বই থেকে হিন্দুয়ানী লেখা, দিকে দিকে আলোর প্রচারসহ নানান কাজ বেড়েই চলেছে। তাই পুলিশ কর্মকর্তার অন্যায়ে বিচলিত হবার কিছু নেই কেননা এসবই হবার কথা।

দু কুসুম শান্তি মেলে যখন দেখি একটা সমাজে নারী পুরুষ সকলে নির্বিশেষে নিজেদের ইচ্ছে মত সাজে এবং চলাচল করে। তবে নিশ্চিত সাহিত্যজগত থেকেও আমাদের আশা উঠে যাচ্ছে। কিছুদিন আগেই এক কবির দুটো লাইনে দেখা মেলে তিনি রবীন্দ্রনাথ পড়া রমণীর সাথে কোরআন পড়া রমণীকে প্রতিপক্ষে রাখছেন। আবার বিশিষ্ট প্রগতিশীল লেখকেরা যৌনকর্মীর পোশাক নির্ধারণ করছেন এবং নিঞ্জা টেকনিক দিচ্ছেন। হ্যাঁ, এসবে মন খারাপের কিছু নেই। নবী যেমন নারী হতে পারেন না তেমনই সাহিত্যে কবি বা লেখক বলতে শুধু পুরুষেরাই আছেন। তারা সাহিত্যে নারীকে অলংকার হিসেবে ব্যবহার করতে রাজি আছেন কিন্তু কবি বা লেখক হিসেবে নারীদেরকে মেনে নিতে রাজি নন।

দেশে আর ধর্মের কল বাতাসে নড়ার সুযোগ নেই। সমাজে এই আদিম রূপরেখার বীজ অনেক আগেই পোঁতা হয়েছে। তাই নারীদের প্রতি হয়ে যাওয়া এসব অন্যায়কে কতটা পুরুষতান্ত্রিকতার ফসল বলব, আর কতটা জাতিগত সমস্যা বলবো, এই নিয়ে দ্বিধায় পড়তে হয়। তবুও যারা পরিত্রাণ চান, তারা জোরে একটা থাপ্পড় মারুন, ভেঙে দিন দেওয়াল! আদিম রূপরেখার বীজকে আগে বিনষ্ট করুন। সোচ্চার হোন। মুক্ত হোন!

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *