পৌনঃপুনিক [পর্ব – ০৯]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী ।।
: দোলন, স্ক্রিপ্টটা ঠিকই আছে কিন্তু একটু চেইঞ্জ আনতে হচ্ছে…। ইয়ে মানে, ক্লায়েন্টের ব্যাপার তো বোঝেনই, কী আর বলবো!
: ঠিক আছে আপা, সমস্যা নেই। কোথায় ঠিক করতে হবে, বলেন?
: মানে বেবি ব্লুজ নিয়ে যে স্ক্রিপ্টটা, ডোন্ট টেইক ইট আদারওয়াইজ, মানে একটু বায়াস হয়ে গেল না?
: “বায়াস!” কোন জায়গাটা বলবেন আপা?
: এটা ক্লায়েন্ট বলার জন্য না। আপনি নিজেই বাড়ি গিয়ে ঠান্ডা মাথায় চিন্তা করেন! এখনকার বাবারা তো অনেক খুশি হয় বেবি হলে। আমার হাজবেন্ড তো খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেছিল আমার ছেলে হওয়ার সময়!
: বাবাদের কি সন্তান হলে শুধু খুশি হওয়াই কাজ?
: দেখেন, নতুন মায়েদের এই বিষন্নতা তো হরমোনজনিত, এখানে তো আর পুরুষ দায়ী নয়!
মোমেনা আপার মুখে অন্তরাত্মাসমেত গা জ্বালানো একটা হাসি। সেটা উপেক্ষা করে দোলন শান্তভাবে উত্তর দিয়ে যাচ্ছে।
: আপা, আমি তো কোথাও লিখিনি যে, পুরুষ দায়ী! হরমোনজনিত হলেও মেয়েদের এই সময় যে সাপোর্ট প্রয়োজন, বেশিরভাগ মেয়ে কি সেটা পেয়ে থাকে? একটা মেয়ে মা হলে তার রুটিনের আমূল পরিবর্তন আসে, কয়জন ছেলে বাবা হলে নিজের জীবনের তাবৎ আনন্দ-বিনোদন বিসর্জন দিয়ে বাবা হয়, বলেন?
: দোলন, বাবা-মা মিলে যাতে সুন্দর একটা সমাধানে আসা যায়, সেভাবে ক্লায়েন্ট দেখাতে চায়। সেখানে আপনি ইচ্ছেমতো বাবাকে মাইনাসে ঠেলে দিলে তো আর এটা এপ্রুভই হবে না!
: আপা, কিছু চেইঞ্জ আনতে চান, তাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু যে কথাগুলো বলছেন, সেখানে কনসেপ্ট অনুযায়ী কোনো অসুবিধে দেখছি না। আর আমি তো বানিয়ে কিছু লিখিনি, প্রতিটি কেইস স্টাডি সত্যি! মাইনাস পুরুষও কিছু লিখিনি আপা! উদ্দেশ্য তো সচেতনতা তৈরি করা, তাই না? মাতৃত্বের এই বিষণ্ণ সময়টাতে পার্টনার, অন্য যারা ফ্যামিলি মেম্বার, তাদেরকে তাদের দায়িত্বটা বুঝিয়ে দেয়া।
: আমিও কিন্তু একজন মা। আমি কিন্তু এতো কিছু ফেইস করিনি!
: আপনার সাথে হয়নি বলে বাকি মেয়েদের সাথে হয়নি, হচ্ছে না – এই ধারণাটা আসলে ঠিক না আপা! এখানে যে মেয়েটি বলেছে যে, তার পার্টনার তার সিজারিয়ান ডেলিভারির আগ মুহূর্তে রিকশায় ঘুরে গাঁজা খেয়ে এসেছে টেনশন কমানোর জন্য, সেই মুহূর্ত থেকেই কিন্তু তার বিষণ্ণ লাগা শুরু হয়েছিল, যা বাচ্চা হওয়ার পরে আরো তীব্র হয়েছে। আমার হেল্পিং হ্যান্ড বলেছে, সে তার হাজবেন্ডের কথার উপরে কখনো কথা বলে না কারণ বিয়ের পর প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সে জেনেছে, সেই লোক তার আগের বউয়ের মুখ জ্বলন্ত চুলার উপরে ঠেসে পুড়িয়ে দিয়েছিল। তার অপরাধ ছিলো বাচ্চা হওয়ার পর সে সংসারের কাজে মনোযোগী ছিল না। একদিন ভাত পুড়িয়ে ফেলায় এই শাস্তি।
: এইসব বিচ্ছিন্ন ঘটনা তো আছেই। তবু যাই বলেন দোলন, সব জায়গায় না ফেমিনিজমটা ঠিক খাটে না।
: আপা, আমাদের মেয়েরা ফিজিক্যালি-মেন্টালি কতভাবে অবহেলার শিকার হয় প্রেগন্যান্সি এবং পোস্ট প্রেগন্যান্সিতে, সেটা আসলে তারা প্রকাশও করে না ঠিকভাবে। অনেক মেয়ের কাছে এই সময়টা ট্রমা হয়ে থেকে যায়। শুধু তো অবহেলা না ভায়োলেন্সের শিকারও হচ্ছে। শহরেই যেখানে উপেক্ষিত, গ্রামে তো বেবি ব্লুজ সম্পর্কে ধারণাই নেই। আমাদের দারোয়ান চাচার মেয়েটা বাচ্চা হওয়ার পর থেকে ডিপ্রেশনে চলে যায়, মেয়েটা শেষ পর্যন্ত সুইসাইড করে আপা!
: আচ্ছা, আমরা আরেকটু ভাবি। আবিদ ছুটি থেকে ফিরবে কাল। নেক্সট সানডে মিটিং আছে, তার আগে আমরা নিজেরা বরং বসি আরেকবার।
: সেই ভালো আপা। আমি তো বলছি, চেইঞ্জ আনা সমস্যা না কিন্তু ওনারা কী চাইছে সেটা ওনাদের তো আগে বুঝতে হবে!
: যা কিছুই বলুক, ক্লায়েন্ট তো বস আর বস ইজ অলওয়েজ রাইট, তাই না?
মিটিং শেষ করে মনমেজাজ খুবই বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে দোলনের । এই আপোষগুলো করতে পারে না বলেই যত ঝামেলা! চিন্তাভাবনাই মেলে না এদের সাথে। পুরুষতন্ত্র কেবল পুরুষ তার মগজে পোষে না, মোমেনা আপাদের ধ্যানধারণায় গেঁথে আছে যত সব ফালতু কথা। আর “ফেমিনিজম” শুনলে ওদের গায়ে জ্বালা বাঁধে। কেন রে ভাই? ফেমিনিজম কি কোনো ক্রাইম? বিরক্তিকর! মাথায় গোবর নিয়ে সব বড় বড় চেয়ার দখল করে আছে। হিপোক্রেসির দুনিয়া শালা!
[চলবে]
ফুলেশ্বরী প্রিয়নন্দিনী : সমাজবিজ্ঞানে স্নাতক সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তা। এই মুহূর্তে শিল্পকর্ম এবং স্বাধীন লেখালিখিতে ডুবে থাকাতেই স্বচ্ছন্দ। মিশ্র মাধ্যমে শিল্পকর্মের বিষয় হিসেবে জানালার গল্পের আড়ালে আসলে ফেলে আসা সময়, স্মৃতির সঞ্চয় অথবা জীবনের কোনো চেনা গল্প রয়ে যায়। জীবনের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতায় নানা ঘাতপ্রতিঘাত পেরিয়ে যে বিষয়গুলো বিশেষভাবে ভাবায় : নারী – পুরুষের সমতা, সম্পর্কের টানাপোড়ন ও জটিলতা। পারিবারিক – সামাজিক নির্যাতন ও বৈষম্য। শিশুর নিরাপত্তা এবং সর্বোপরি, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে আড়াই লক্ষাধিক বীরাঙ্গনা মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধ ও যুদ্ধ পরবর্তী জীবন সংগ্রামের ইতিহাস।