November 2, 2024
সাহিত্যগল্পফিচার ২

অনু কিংবা অপরাজিতাকে কেউ খুন করেনি

উলুল অন্তর।। অনুকে কবর দেয়ার মাস পাঁচেক পর এক দুপুরবেলা অপরাজিতা লতাটিকে প্রথমবার দেখি।

অনু শুয়ে আছে তিন বছর আগে তারই হাতে লাগানো লিচু গাছের পাশে। আর কয়েক বছরের মধ্যেই  গাছটা শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে ওর কবরকে ছায়া দেবে।

সেই দুপুরে ছাতিফাটা রোদে কবর জিয়ারত করে লিচু গাছটার দিকে তাকিয়ে এই কথাটাই ভাবছিলাম। হঠাৎই সিনেমার পর্দায় যেভাবে দ্রুত দৃশ্য পরিবর্তন হয়, তেমনি  গাছটার গায়ে এই লতাটা আবির্ভূত হয়। লিচু গাছের কাণ্ডে পরিবর্তনটা এতো দ্রুত ঘটে যে আমি সেটা ধরতেই পারি না, শুধু দেখি একটা লতা এঁকেবেঁকে ঝুলে আছে যা হয়ত ন্যানো সেকেন্ড আগেও ছিল না।

প্রতি শুক্রবারেই জুম্মার নামাজ পড়ে আমি অনুর কবর জিয়ারতে আসি। কিন্তু এই লতাটা তো আগে চোখে পড়েনি। প্রথমে ভাবি চোখের ভুল, গত ছয় মাসে তো ভুলভাল কম দেখিনি, কিংবা কোনটা স্বপ্ন আর কোনটা জাগতিক সেই বোধটা আমার ছিল না বললেই চলে।

কাছে গিয়ে লতাটা ভালো করে দেখলাম, প্রায় আড়াই ফুট উঁচু। বুঝলাম নিরূপায় লিচু গাছটার রসদ শুষে এটি দ্রুত বেড়ে উঠেছে। আমার কেন জানি প্রচন্ড রাগ ওঠে। এক টান মেরে লতাটিকে গাছ থেকে মাটিতে ফেলে দেই। তখনই ঘটে আরেকটি অদ্ভুত ঘটনা, লতাটা মাটিতে পরামাত্র আহ করে উঠল, ঠিক অনুর কণ্ঠে, মৃত্যুর আগে অনু বোধহয় এভাবেই কাতর কণ্ঠে শেষবার আহ বলেছিল। আমার বুকের ভিতরটা দ্রিম দ্রিম করে ওঠে। দ্রুত অনুর কবরের দিকে তাকাই, হয়তো আশা নিয়ে কিংবা শঙ্কায়। না, দাবানল লাগানোর ক্ষমতা নিয়ে আসা রোদে পুড়তে থাকা খেজুরের মলিন ডাল ছাড়া কিছুই চোখে পড়ল না। এবার তাকালাম লতাটার দিকে, সেখানেও অস্বাভাবিক কিছুই দেখলাম না। বুঝলাম, এটা আমার শোনার ভুল। আসলে অনুকে হারানোর যন্ত্রণা কিংবা তাকে ধর্ষণ ও হত্যার বিচার আদায় অথবা প্রতিশোধ নিতে না পারার ব্যর্থতা গত কয়েক মাস ধরে আমাকে কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে। তাই মাথাটা ঠিক নাই। কী দেখতে কী দেখি! যা শোনার নয়, তা শুনি!

অনুকে সে কিংবা তারা কিংবা কেউ নয় যেদিন খুন করল, তার তিনদিন পর আমি প্রথমবার ভুলভাল দেখি। তিনদিন ধরে খাওয়াপরা না করে থানা, হাসপাতাল, পত্রিকা অফিসে দৌড়াদৌড়ি করায় শরীরটা আর চলছিল না। ঘরে ফিরে দুয়ার খোলা রেখেই বিছানায় এলিয়ে পড়েছিলাম। হয়তো স্বপ্নে নয়ত হ্যালুসিনেশনে দেখি– রোজকার মত  অনু ক্যান্টনমেন্টে টিউশনি সেরে বড়ি ফিরছে।

অনু যে কেবল টাকার প্রয়োজনে টিউশনি করে তা না। আমাদের পাঁচজনের সংসারের খরচ আব্বার পেনশন ও আমার সদ্য পাওয়া চাকরির খরচেই মিটে যেত। কিন্তু অনু তো ম্যাথমেটিক্সে মাস্টার্স পাশ, সে কেন বেকার বসে থাকবে? তাছাড়া আমাদের বাড়িতে আম্মাই প্রায় সব কাজ করেন, অনুর বেশিরভাগ সময়ই অলস বসে কাটে। সে তাই আমার সম্মতিতেই টিউশনটা নেয়, বাড়ির কাছেই ক্যান্টনমেন্টে এক অফিসারের শিশু পুত্রকে পড়াতে হবে, সপ্তাহে তিন দিন, মাসে আট হাজার টাকা। এই উপরি ইনকাম আমাদের ছোটখাটো বিলাসিতা পূরণে বেশ কাজে আসে। অনু টাকাটা দিয়ে আব্বাকে পাঞ্জাবি, আম্মাকে শাড়ি, ননদকে কসমেটিকস কিনে দেয়; কখনো বা আমাকে দেয় দামী শার্ট-টাই। বাকী টাকা দিয়ে বিচিত্র সব জিনিস কিনে ঘর সাজায়; এ ব্যাপারে, আসলে সব ব্যাপারেই, অনুর রুচি বেশ ভালো।

কিন্তু সবচেয়ে নিরাপদ জায়গাতেও যে সবচেয়ে বড় ঘাতক লুকিয়ে থাকতে পারে সেটা আমাদের কল্পনাতেও আসেনি। এই অসাবধানতার ফলে আমি  অনুকে হারাই।

যা বলছিলাম– শীতের সেই বিকাল এবং সন্ধ্যার মাঝামাঝি সময়টায় গায়ে চাদর জড়িয়ে অনু হাঁটছে সেনানিবাসের গাছগাছালি ঘেরা নির্জন সরু রাস্তা দিয়ে। তবে কুয়াশায় সামান্য সামনের বস্তুও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না। হঠাৎই দেখি অনু হাঁটার গতি বাড়িয়ে দিল। সে কি কিছু আঁচ করতে পারছে? কোনো অস্বাভাবিক কিংবা ক্ষতিকর অস্তিত্ব? আমার দম বন্ধ হয়ে আসে।

অনু দৌড়াতে শুরু করে। তারপর ডিশ লাইনে সমস্যা হলে টিভি পর্দা যেমন ঝিরঝির করে, তেমনি সবকিছু আউলা ঝাউলা হয়ে যায়। বিচ্ছিন্ন কিছু দৃশ্য দেখতে থাকি– অনু জ্ঞান হারিয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছে, শক্ত লোমশ দুটা- তিনটা-চারটা-পাঁচটা হাত তাকে টেনেহিঁচড়ে ঝোপের আড়ালে নিয়ে যাচ্ছে, ওর এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে পড়ে গেল।তারপর কী বীভৎস! ওহ খোদা! আমি চিৎকার দিয়ে বিছানায় উঠে বসি।

আরেকদিন দেখি আমি একটা প্রায় অন্ধকার প্রকোষ্ঠে চেয়ারে বসে আছি। আমার হাত-পা রশি দিয়ে চেয়ারের সাথে বাঁধা। এটা ঘটনাকে আমি অবশ্য স্বপ্ন কিংবা হ্যালুসিনেশন বলে এড়িয়ে যেতে পারি না। কেন জানি মনে হয়, কোনো একদিন সত্যিই আমি এই অবস্থায় ছিলাম।

শুধু যে অদ্ভুত দৃশ্য দেখি তা-ই নয়; শুনিও। আমার মাথার মধ্যে বাজে; বেশিরভাগই অবশ্য কেস তুলে নেওয়ার হুমকি-ধামকি, কখনো খানকির বেটা, হারামজাদা বলে গালি, কখনো মিলিটারির জুতার শব্দ, কখনো কোনো নেতার ভারি কণ্ঠের শাসানি।

ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম দিকে আমার খুব জ্বর এসেছিল। অফিসে না গিয়ে বিছানায় চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছিলাম। হঠাৎ শুনতে পেলাম সম্পূর্ণ অচেনা দু’জন মানুষের গোপন শলাপরামর্শ।

একটা তরুণের কণ্ঠ বলছে–স্যার, অনুর কেসটা নিয়ে কী করব?

–এইডা সাবধানে ডিল করা লাগব, ক্যান্টনমেন্টের কেস, পলিটিক্যাল ব্যাপারসাপারও আছে। উল্টাপাল্টা কিছু করা যাবে না।

যে লোকটা কথাগুলো বলল, তার কণ্ঠ শুনেই বুঝতে পারি সে এমন অসংখ্য কেস হ্যান্ডেল করে অভ্যস্ত।

তরুণ কণ্ঠটা আবার বলে ওঠে– কিন্তু এটা নিয়ে তো সাড়া দেশে ব্যাপক হৈচৈ হচ্ছে। ফরেনসিক রিপোর্ট অনুযায়ী…

–আরে রাখো মিয়া ফরেনসিক। আর পাব্লিক সেন্টিমেন্ট দুই দিনেই হাওয়া হইয়া যাইব, প্যারা নাই।

যেভাবে অকস্মাৎ শুরু হয়েছিল, সেভাবেই এক সময় আর কথা শুনি না। কিন্তু এমন স্বপ্ন কিংবা বাস্তবের অলৌকিক ঘটনাগুলো ততদিনে আমার মাথা অর্ধেক খেয়ে ফেলেছিল। এখন লতাটিকে কথা বলতে শুনে বাকিটাও বোধহয় আর ঠিক থাকল না।

অনুর কবর থেকে ঘরে ফিরেও লতাটার কথা ভুলতে পারি না। পরের শুক্রবারে আবার গেলাম, এবার অনুর কবর নয়, আগে চোখে পড়ল লতাটা। লিচু গাছের গা বেয়ে উঠে দাঁড়িয়েছে। এবার দেখলাম লতাটায় নীল রঙের ফুল ফুটেছে। আমার মনে পড়ে অনু একদিন এই ফুলটা নিয়ে এসেছিল। আমি জিজ্ঞেস করলে বলেছিল– ক্যান্টনমেন্টে রাস্তার ধারে ফুটেছে। এর নাম নীল অপরাজিতা। অনুর পছন্দের ফুলটা আমি আর ছিড়তে পারি না। প্রকৃতি বোধহয় সব সৃষ্টিকেই আত্মরক্ষার পদ্ধতি শিখিয়ে দেয়। কিংবা সৃষ্টি নিজেই নতুন নতুন বিপদে নতুন কৌশল তৈরি করে নেয়। বুঝলাম আমার হাত থেকে বাঁচতেই লতাটা ফুল ফুটিয়েছে।

আমি ফুলটার নীল শাড়িতে ঢাকা পড়া সাদা অংশের দিকে তাকিয়ে থাকি, অনেকক্ষণ। তারপর তাকে বলি– তোমার নাম কী?

–নীলকন্ঠ।

ফুলের কথা বলা আমার কাছে স্বাভাবিকই লাগে।

–তোমার বাড়ি কই?

–থাইল্যান্ড

– সেখান থিকা তুমি এখানে কীভাবে আসলা?

নীলকণ্ঠ জবাব দিল না। আমি প্রসঙ্গ বদলাই– আমার বউ অনু তোমাদের খুব পছন্দ করত, জানো?

–হ্যাঁ, তোমার বউ খুব ভালো মানুষ ছিল।

–আমি স্যরি, সেদিন তোমার মাকে মাটিতে ফেলে দিয়েছিলাম।

–ব্যাপার না, তোমরা সব সময় এমনই করো। যা কিছু প্রাকৃতিক, যা কিছু সুন্দর, তোমরা তাকে ধ্বংস না করে থাকতে পারো না।

–আমি সত্যিই স্যরি, আমাকে মাফ করে দাও। আমি ফুলটার সাথে কথা বলতেই থাকি। কথা বলতে বলতে এক সময় সে শুকিয়ে যায়, তারপর নিঃশব্দে মাটিতে ঝরে পড়ে। কিন্তু নারীকণ্ঠ (আসলে অনুর কণ্ঠস্বর) থামে না। বুঝতে পারি ফুলটা নয়, আসলে পুরো লতাটাই আমার সাথে কথা বলছে।

নতুন ফুল ফোটে, অনেকগুলো, লতাটাও বাড়তে বাড়তে লিচু গাছের ঘাড় স্পর্শ করে। রোদ যায়, বৃষ্টি আসে, বৃষ্টি যায়, রোদ আসে; কিন্তু আমি চোখ সরাতে পারি না। সবকিছু এভাবেই চলতে থাকে। হঠাৎ একদিন আমার ছোটবোন সুহানা এসে ঘোর ভাঙায়, চেচিয়ে বাড়িসুদ্ধ মাথায় তুলে বলে– হায় আল্লাহ, ভাইজান তাই গাছের লগে কথা কয়।

সুহানার চিৎকারে আতঙ্কিত হয়ে আম্মা ছুটে আসেন, মাটিতে লাঠি ঠুকে ঠুকে আসেন আব্বা। আর আসে চাচাতো-ফুপাতো ভাই, ভাবী, ভাতিজারা। আসে পাড়াপড়শি। সবাই আমার দিকে তাকায়। কেউ বলে–হায় খোদা! বউ হারানোর শোকে পোলাডা পাগলা হয়ে গেল! কেউ আব্বাকে পরামর্শ দেয়–হেরে বোগদাদি পীরের কাছে লইয়া যান, উনার দয়ায় সব ঠিক হইয়া যাইব। ছোটরা এসব শুনে হাসতে থাকে।

আম্মা আমার হাত ধরে টেনে ঘরে নিয়ে যান। বিছানায় শুইয়ে দিয়ে আমার গায়ে একটা চাদর ফেলে দেন। তারপর আমার মাথায় হাত বুলাতে থাকেন। আমি আরামে চোখ বুজে নীল অপরাজিতার কথা ভাবতে থাকি। কী সুন্দর ফুলটা, ঠিক অনুর মত। অনুর কথা মনে পড়তেই অপরাজিতা ফুলের সব রহস্য উন্মোচন হয়ে যায়, বিস্ময়কর সত্যটা আমি জেনে যাই– অনু আসলে আমার কাছে ফিরে এসেছে, নীল অপরাজিতা হয়ে। এইজন্যেই যখন লতাটা ছিড়ে মাটিতে ফেলেছিলাম, তখন অনু আহ করে উঠেছিল।

ছোটবেলায় আম্মার মুখে শুনেছি ভালোমানুষ মারা গেলে নক্ষত্র হয়ে যায়, দূর আকাশের বুকে সুন্দর আলো ফোটায়। কথাটা আমি বিশ্বাস করেছিলাম।

বড় হয়ে জীবনানন্দের কবিতা পড়ে দেখি– কবি প্রিয় বাঙলায় ফিরে আসতে চেয়েছেন মানুষ নয়, শালিক কিংবা কাক হয়ে। অনু নিশ্চয়ই মানব জনম শেষে নীল অপরাজিতার বেশে আমার কাছে ফিরতে চেয়েছে।

আমি দ্রুত চাদর সরিয়ে আম্মাকে ঠেলে ঘর থেকে বের হই। ছুটে যাই অনুর কবরে। এবার অপরাজিতা লতাটার দিকে তাকিয়ে আমি যেন অনুকেই দেখতে পাই। আমার প্রচন্ড ইচ্ছা করে ওকে ছুঁতে। আমি লতাটিকে বলি– একটা সত্যি কথা বলবা? তুমি কি আসলে অনু?

নীলকণ্ঠ খিলখিল করে হেসে ওঠে। হাসিটা এবার আমি দেখতে পাই। মিনিটখানেক পর সে হাসি  থামিয়ে বলে–এতোদিনে চিনতে পারলে?

আমি কণ্ঠে অনেকখানি প্রেম ঢেলে বলি– আমার কি ইচ্ছা করতেছে জানো?

নীলকণ্ঠ বলে– জানি। তুমি আমাকে স্পর্শ করতে চাও।

–কীভাবে জানলা?

–পুরুষ যার প্রেমে পড়ে তাকে স্পর্শ না করতে পারলে পাগল হয়ে যায়, তখন সে খুনী হতেও দ্বিধা করে না। আমি তোমাকে বাধা দেব না, ইউ ক্যান টাচ মি।

আমি প্রবল মমতায় নীলকণ্ঠকে ছুঁই। আমার এতো চেনা শরীরটা… আহা… কতো দিন পর স্পর্শ করলাম… সেই তুলার মত নরম হাত, টলটলে জলের চৌবাচ্চা চোখ, ছোট্ট নাক, কমলার কোয়ার মত ঠোঁট…।

আমি নীলকণ্ঠের ভিতরে ঢুঁকে পড়ি, তার সৌন্দর্য আমাকে ঘিরে ফেলে, অনুর শরীরের পরিচিত গন্ধ আমার মাথা দখল করে নেয়। স্বপ্ন নয়, প্রেম নয়, কোন এক বোধ কাজ করে মাথার ভিতরে। আমি পরম তৃপ্তিতে হারিয়ে যেতে থাকি অনু কিংবা নীলকণ্ঠের গহীনে।