পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর চতুর্থ পর্ব।।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যখন থামলো সুরমাদের গাড়ীদুটো, তখন সকাল আটটা, চারিদিকে কুয়াশা। গেটের পাশের একটা খাবারের দোকানে ঢুকে পড়লো সকালের নাস্তা করার জন্য। পরোটা, ভাজি আর অমলেটের অর্ডার দিয়ে দুটো টেবিল জুড়ে বসলো সবাই। সুরমা, সাথে প্রোজেক্ট অফিসার টুটুল আর ৬ জন জাতীয় পর্যায়ের নারী নেত্রী। তাদেরকে নিয়ে যাচ্ছে দৌলতদিয়া যৌনপল্লীতে, আজ যৌনকর্মীদের সংগঠনের নেত্রী আর কিছু মেয়েদের সাথে কথা বলবে। কাল সকালে স্টেকহোল্ডার মিটিংয়ে অংশ নেবে। নাস্তা সেরে, চা খেয়ে আবার যাত্রা শুরু করল। গত রাতে ঘন কুয়াশার কারনে ফেরি পারাপার বন্ধ ছিল, তাই পাটুরিয়া ঘাটে লম্বা লাইন, কয়টায় পৌঁছানো যাবে কে জানে।
ফেরি পার হয়ে দৌলতদিয়া ঘাটে নামলেই বড় জেলা ট্রাক স্ট্যান্ড আর কাছেই রেল স্টেশন। সেগুলোর কাছাকাছি পদ্মার পাড়েই যৌন পল্লীটি গড়ে উঠেছে। সকাল ১১ বেজে গেল সুরমাদের পৌঁছাতে। পল্লীর মুখে ঢুকতে তিনটি এনজিওর অফিস। সেগুলোর একটাতেই সহযোগী সংস্থার প্রকল্প অফিস। তারা সোজা প্রকল্প অফিসে গিয়েই বসলো। প্রাথমিক আলাপচারিতার পরে তারা পল্লীর ভিতরে গেল কয়েকজনের সাথে ওয়ান টু ওয়ান কথা বলার জন্য। ভিতরে একেকজনের সাথে একেকজনকে বসিয়ে দিয়ে সুরমারা কয়েকজন একটা ঘরের সামনে এসে দাঁড়ালো। জবা গাছটার নিচে পাতা একটা বেঞ্চিতে ওরা বসলো। যে মেয়েটিকে ওদের কাছে আনা হল তার নাম শাপলা, বয়স ২৩-২৪ বছর। সে এসেই বলল, আপনাদের তো এখানে বসা যাবে না, আপনাদেরকে আমার ঘরের ভিতরে বসতে হবে।
কোন সমস্যা নেই আমাদের। এখানেই হবে, আপনি বসেন, কিছুক্ষন কথা বলতে চাই আপনার সাথে, অবশ্য যদি আপনার আপত্তি না থাকে, যদি সময় থাকে। কথা বলতে বলতেও হঠাৎ যদি আর ভালো না লাগে, চলে যেতে পারবেন, সুরমা বলল।
– আপা, কি যে কন। কতজনের সাথে কথা কইলাম। জিগান, কি জানতে চান।
অন্যরা চলে গেলে সুরমা কথা শুরু করে
– কত বছর আছেন এখানে?
– ৭ বছর, এইখানেই। প্রেমিকের হাত ধরে পলাইছিলাম বিয়া করার জন্যে। আমারে নিয়া এইখানে বিক্রি করছে। প্রথম এক বছর ছুকরী আছিলাম। এক বছরেই সর্দার্নীর টাকা শোধ দিয়া নিজে ঘর ভাড়া নিছি। বাপ মায়ের লগে যোগাযোগ করছিলাম, তারা আমার মত নষ্ট মাইয়ারে ঘরে তোলতে চায় না। থাইকা গেলাম এইখানেই।
– আর কতদিন থাকবেন এইভাবে? ভবিষ্যত নিয়ে কিছু ভাবেন?
– আপা, আমার কিন্তু আয় রোজগার ভালো। এই পল্লীর সবচেয়ে বেশি রোজগার করা মাইয়াগো মইধ্যে আমি একজন। টাকা হাতের ময়লা। লাখ লাখ টাকা এই হাতের উপরে দিয়া আইছে আর গ্যাছে। আমি শাপলা এক তুড়ি বাজাইলে মনে করেন হাজার হাজার টাকা আমার পায়ের উপরে আইসা পরবে। আপা, আমার ঘরে যে খাট তার দাম ৮৫ হাজার টাকা। আমার ঘরে বিদেশি কয়েক পদের মাল আছে। আমার রেট অনেক বেশি। আমি গানও পারি, নাচও পারি। সোনাগাছি থাইকা যেই হৈমন্তী দিদি এই পাড়ায় আসছে তার কাছে হিন্দী ফিলিমের নাচ শিখছি। কিন্তু এর বাইরেও আমার রোজগার আছে। অনেক বড় বড় টাকাওয়ালা লোকজন আমার কাছে আসে। অনেক লেনদেন, ভাগ বাটোয়ারা আমার ঘরে বইসাই হয়। আমারে তারা ভাগ দেয়। তারপর মনে করেন পুলিশের ডরে যারা গা ঢাকা দিতে চায় তাগোরে যখন আমার ঘরে থাকতে দেই তখন তারাও আমারে ঘন্টা হিসাবে ঘরভাড়া দেয়, খাওন মদ সেইসবের টাকা আলাদা।
একটু থেমে আবার আবার বলে, আমার ঐ নেশাটা ধরার পরে আর বেশি টাকা জমাইতে পারি না। গ্রামে জমি কিনছি, বাপ মা আমারে বাড়িতে নিবো না কিন্তু আমার টাকায় জমি কিনবো। সেই জমিতে আমার নাম নাই। ভাইডা বিদেশ গেল তার টাকাও আমি দিলাম। অথচ ঘেন্নায় আমারে ফোন দেয় না, পরিচয় দেয় না। কই যামু কন। ব্যাংকে টাকা জমাইছি। ডর লাগে, নেশাটা আমারে খাইয়া ফালায় যদি!
কিসের নেশা করেন? ইঞ্জেকশন নেন? সুরমা জানতে চায়।
– আরে না, সুঁইরে আমি ডরাই। তিন মাসে একটা সুঁই নিতে কইছিল, সেইটাই নেইনি। মদ গাঞ্জা জর্দা গুল এইসব তো আগে থাইকাই খাই। তয় এখন হেরোইন ধরছি। কি যে করি! একবার পুলিশের তাড়া খাইয়া এক বান্ধা কাস্টমার পলাই আইছিল, আমার ঘরে রাখছিল মালগুলা কয়মাস। ঘরেই ছোট ছোট প্যাকেট কইরা সাপ্লাই দিত। তাগোর লগে ওইসব করতে করতে আমিও নেওয়া শুরু করছি।
– আপনি যে বললেন তিন মাসে একটা সুঁই নেন না, তাহলে কী করেন? সুরমার প্রশ্ন
– আপা, এই ব্যাপারে আমি খুব কঠিন, কনডম ছাড়া কাম নাই। খদ্দের আমার আপন, তার রোগ বালাই তো আমার আপন না। ঠিক কিনা কন?
– একদম ঠিক বলেছেন। আপনার স্বপ্ন কী?
– পক্ষীর মতন ডানা মেইলা, নীল আসমানে উড়াল দিতে মন চায়গো আপা
– সেটা কেমন?
– জানিনা, চক্ষের সামনে দ্যাখতে পাই আমি একটা বিশাল সাদা রঙের পক্ষী হইয়া আকাশে উড়তেছি, মাথার উপরে খালি নীল আর নীল। মাঝে মইধ্যে সাদা সাদা নরম তুলার মতন মেঘ, আমি উড়তে উড়তে মেঘের মধ্যে ঢুইকা হারায়ে যাই। আমার রঙ সাদা, মেঘের রঙও সাদা। কাওরে আর আলাদা করন যায় না তখন।
শাপলার গলায় একটা অদ্ভুত মাদকতা ছিল, সুরমা কিছুটা আনমনা হয়ে যায়।
দিনের কাজ শেষ করে সুরমার টিম নিয়ে রাজবাড়ী সার্কিট হাউজে পৌঁছতে সন্ধ্যা পার হয়ে যায়। আজ রাতটা তারা এখানে থেকে কাল আবার ব্রোথেলে যাবে। সকালে মিটিং শেষে ওখান থেকেই ঢাকায় ফিরবে। সারাদিনের ক্লান্তিতে সুরমা সহজেই ঘুমিয়ে পড়ে। ঘুমের ভিতরে স্বপ্ন দেখে, সে একটা বড় সাদা রঙয়ের পাখি হয়ে উড়তে উড়তে নীল আকাশের সাদা মেঘের মধ্যে হারিয়ে গেল!
অফিসের উপরতলায় একটা বড় মিটিংরুম ভাড়া নেওয়া হয়েছে আজকের মিটিংয়ের জন্য। এলাকার গন্যমান্য ব্যাক্তি, মেম্বার, থানা, নারী ও শিশু বিষয়ক অফিস এবং সমাজ সেবা অফিসের প্রতিনিধিরা থাকবেন। এছাড়াও যৌনকর্মী সংগঠনের নেত্রীরা ও বাবুদের প্রতিনিধিরা থাকবেন। সাড়ে এগারোটায় মিটিং শুরু হলো। সহযোগী সংস্থার সহায়তায় ক্লাস এইট পর্যন্ত পড়া একজন যৌনকর্মী দৌলতদিয়া যৌনপল্লীর একটি পরিচিতি পড়ে শোনালো-
‘দৌলতদিয়া যৌনপল্লী দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লী। প্রায় তিন একর এলাকা জুড়ে তৈরি এই পল্লীটি রাজবাড়ী জেলার গোয়ালন্দ থানার ভিতরে পড়েছে। দৌলতদিয়া অত্যন্ত ব্যস্ত এলাকা, প্রতিদিন সারাদেশ থেকে প্রচুর ব্যাবসায়ীদের আনাগোনা এখানে। ৮০’র দশকে গোয়ালন্দ যৌনপল্লী উচ্ছেদের পর এক ভূ-স্বামী ১০ জন যৌনকর্মীকে মৌখিকভাবে একখণ্ড জমি দান করেছি্লেন। সময়ের পরিক্রমায় এটি বাড়তে বাড়তে দেশের সবচেয়ে বড় যৌনপল্লীতে পরিণত হয়েছে। এখানে বিভিন্ন সময়ে ১৩০০ থেকে ২০০০ যৌনকর্মীর বাস এবং প্রতিদিন প্রায় ২৫০০-৩০০০ খদ্দের আসে। দেশের অন্যান্য পল্লী থেকে এটি কিছুটা ভিন্ন। এই পল্লীটি দিনরাত ২৪ ঘন্টাই খোলা থাকে। এতটাই জনবহুল এই জায়গাটি যে কখনো কখনো এক এক জন যৌনকর্মীকে দিন রাত মিলে ১০-১৫ জন খদ্দেরও নিতে হয়। বাবু, বাড়ীওয়ালী এবং আরো কিছু ক্ষমতাশালী লোকজন মিলে এটা নিয়ন্ত্রণ করে। এইখানে ২টি যৌনকর্মী নিবন্ধনকৃত সংগঠন আছে, তারা বেশ শক্তিশালী। এই পল্লীর জমির আনুমানিক মূল্য ১২ কোটি টাকা………’
মিটিং শেষ হলে সব অতিথিদেরকে ব্রোথেলের ভিতরে নিয়ে যাবে এবং সেইখানে মেয়েদের সাথে কথা বলবে, এমনই পরিকল্পনা।
কয়েকমাস আগে টাঙ্গাইল ব্রোথেল উচ্ছেদ আতংকের সময় রঞ্জনা তার ছেলে জীবনের হাত ধরে এখানে এসেছিল। মাস খানেক লেগেছিল নিজের জায়গা করে নিতে। এসেই রাজিয়া ঘরওয়ালীর সাথে কথা হয়, ঘরভাড়া নেয় তার কাছ থেকেই। রাজীয়া বুজি এইখানে সংগঠনের নেত্রী, সেখানেই রঞ্জনার নাম তুলেছে। পরের দিন হাজেরা নেত্রীও এসেছিল তার সংগঠনে যোগ দেবার জন্য পীড়াপীড়ি করল। রঞ্জনা খুব অবাক হয়ে জানতে চায়
– এক পল্লীতে দুই সংগঠন ক্যান?
– এত বড় পল্লী, এত মাইয়া, এত খদ্দের এক সংগঠন সামলাইতে পারেনা। দুই সংগঠন ভাগ কইরা কাম করি- হাজেরার গম্ভীর গলায় উত্তর। একটু থেমে আবার বলে ‘দুই সংগঠন হওনের কারনে অনেকে নতুন নতুন নেত্রী হওয়ার সুযোগ পাবে। চেষ্টা করলে তুমিও পারবা।’
রঞ্জনার ওসবে কাম নাই। ‘তার এইখানে রোজগার করতে হবে, কলিম মোল্লার মতন কাউরে পাইলে বিয়া কইরা সমাজে উইঠা যাইবো। পোলাডারে মানুষের মতন মানুষ করতে হইবো’- এই তার স্বপ্ন।
দুইদিন পরে এনজিওর এক আপা এসেছিল, জীবনকে তাদের শেল্টার হোমে রাখার জন্য। রঞ্জনা গিয়ে দেখে এসেছে পল্লীর ঢোকার মুখে ৩টা অফিস আছে, একটা ৪ তলা বাসা আর একটা টিনের ঘরের বড় বাগানওয়ালা বাড়ী আর একটা ইটের, অনেকটা বিদেশি বাড়ির মত। ৪ তলা আর টিন শেডের অফিসে বাচ্চাদের রাখা যায়, পড়াশোনা, করে, গোসল খাওয় খেলাধুলা সবই করে। সন্ধ্যায় মায়ের কাছে থাকতে যায়। আবার মেয়েরা ঐখানে রাতে থাকেও। মায়েরা গিয়ে দেখে আসতে পারে। এই পল্লীতে রাতেও কাস্টমার আসে, রঞ্জনার মাঝে মাঝে বিরক্ত লাগে। রাতে ছেলেটাকে বুকে নিয়ে ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখতে দেখতে ঘুমানোই তার বেশি পছন্দের।
পল্লীটা এত বড়, রঞ্জনার পুরাটা ঘুরে দেখা হয়নি। আজ কাস্টমারের চাপ কম। সে পাশের ঘরের নাজমাকে সাথে নিয়ে পল্লীর ভিতরে যায়। অনেকদূর অবদি যায়, ফেরার পথে পাশের গলিতে চেনা হাসির শব্দে পাশ ফিরে তাকায়, ভুত দেখার মত চমকে ওঠে- ‘ববিতা না? হ, ববিতাই তো, টাঙ্গাইল পাড়া থাইকা বিয়া কইরা সমাজে উইঠা গেছিল!’ নাজমা বলে, আরে না, ঐটা তো শাবানা, ৪-৫ মাস হল আসছে।
রঞ্জনা তখন ববিতাকে নাম ধরে ডাক দিল। মেয়েটা তাকিয়েই চিতকার করে, আমি ববিতা না, আমি শাবানা, আমি শাবানা।
বলেই উল্টো দিকে জোড়ে জোড়ে হাঁটা শুরু করলো। রঞ্জনাও ওর পিছিন পিছন যাচ্ছে। শাবানা এক দৌঁড়ে একটা ঘরে ঢুকে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে দিল। রঞ্জনা হাঁপাতে হাঁপাতে দরজার সামনে এসে পা লেপ্টে বসে পড়ল। ওর বুক ধুক ধুক করছে, মাথা ঘুরছে ‘এইডা যে ববিতা তাতে কোন সন্দেহ নাই। টাঙ্গাইল পাড়াতে থাকতো। একটা ভালো মনের মানুষরে বিয়া কইরা সমাজে উইঠা গেছিল। ব্যাবাকে কয় সে ভালো আছে, সংসার করতাছে। ওরে দেইখাই তো আমিও স্বপ্ন দেখছিলাম সমাজে ওঠার, সংসার করার! তাইলে ও এইখানে ক্যান? আমারে জানতেই হইব।’
নাজমাও পিছন পিছন আসে, ‘ওই কি হইল তর?’
তুই অহন যা নাজমা, তর কাস্টমার আইবো। আমি অর লগে কথা কইয়া আসতেছি, রঞ্জনার জবাব।
নাজমা ফিরতি পথে পা বাড়ায়। রঞ্জনা ববিতার দরজায় কান পাতে, ভিতরে ফুঁপিয়ে কান্নার শব্দ। শব্দটা আস্তে আস্তে দরজার কাছে আসে, ববিতা দরজা খুলে বাইরে আসে। রঞ্জনার সোজা প্রশ্ন, তুমি এইখানে ক্যান? তোমার স্বামী কই? তোমার ঘর, তোমার সংসার?
সে রঞ্জনার দিকে চুপচাপ এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। রঞ্জনা আবার প্রশ্ন করে, কথা কওনা, ক্যান?
ববিতা শরীরের সমস্ত শক্তি দিয়ে চিৎকার করে বলে, নটীগো আবার স্বামী কি, ঘর সংসারই বা কি!
সুরমা টিম নিয়ে গলির মুখে আসতেই ববিতার চিৎকারে থমকে দাঁড়ায়, সকলে অবাক হয়ে তাকায়। আশেপাশে দাঁড়ানো মেয়েরা, খদ্দের,দালালেরা সবাই ববিতার মুখের দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
সে একই স্বরে বলতে থাকে, নটীগো ঐসব স্বপ্ন দ্যাখতে নাই, ওগোর খালি শরীল থাকে, খালি কাপড় খুইলা ব্যাডাগো নিচে শুইবো, ওগোর আর কিছু থাকতে নাই, ওগোর স্বামী থাকে না, সংসার হয় না …!
বলতে বলতে ডুকরে কাঁদতে থাকে। কিছুটা দম নিয়ে আবার শুরু করে, কথা ছিল আমারে বিয়া কইরা সমাজে তুলবো। বাড়ীতে বউ বাচ্চা আছে। তাতে আমার কোন সমস্যা নাই। নতুন ঘর উঠায়া আমারে নিবো। ঘর উঠানোর টাকা দিছি। বিয়া, সমাজের খাওন আর মাতবরগো দেওনের লাইগা ৬০ হাজার টাকা দিছি। আমারে নিয়া গিয়া তুললো বাজারের মইধ্যে একটা দোকানের পিছনের এক ঘর ভাড়া নিয়া। আমি জিগাই, ‘এইখানে তুললেন যে?’ সে কয়, ‘কয়ডা দিন যাক, বাড়ীর বউ বাচ্চার মেজাজ ঠান্ডা হোক। আস্তে আস্তে তোরে নিয়া বাড়িত যামু।’
তারে বিশ্বাস কইরা সংসারের স্বপ্ন দ্যাখতে থাকি। মৌলভী আর দুইজন মানুষ নিয়া আইসা বিয়া পড়াইলো। আহা! কি সুখ! আমার স্বামী আছে, রাইতে যার সাথে শুইলাম সে আমার স্বামী, খদ্দের না। সেই সুখে আমি পাগল হইয়া গেছিলাম। এর মইধ্যে আমার কাছে যত টাকাপয়সা ছিল সব দিয়া দিছি। দুই দিন দুই রাত ভালোই ছিলাম। আমারে রানতেও দেয় নাই, হোটেল থাইকা ভালো ভালো খাওন কিনা আনছে, নিজের হাতে মুখে তুইলা খাওয়াইছে! এত সুখ আগে কোনদিন পাই নাই। ৩য় দিন বলল বাড়ীতে যাচ্ছে ফিরতে রাইত হইবো। বাইরে যাওনের সময় দরজায় তালা লাগাইয়া গেলো। সারাদিন আসে নাই, আমার কিচ্ছু ভাল্লাগে না। অনেক রাইতে ফিরলো সাথে দুইজন পুরুষ মানুষ নিয়া। ব্যাডাগুলার চোখের দিকে তাকাইয়া দেখি চকচক করতেছে। এই চোখ আমার অনেক দিনের চেনা। আমার মাথার ভিতরটা চক্কর দিয়া ওঠে, আমি বিছানায় ধপ কইরা বইসা পরি।
সে কয় ‘একজনরে ঢুকাইলাম, তার শেষ হইলে আরেকজন আসবো। তুই কোন টাকা চাইবি না, টাকা আমারে দিয়া দিছে।’
আমি কই, এইডা কী কন? আমি না আপনের বউ। বউরে কেউ অন্য মাইনষের সাথে টাকা নিয়া শুইতে দেয়? আল্লাহর দোহায় লাগে, আমারে রহম করেন। আমি সমাজে থাকতে চাই, আপনের বউ হইয়া সন্মান নিয়া থাকতে চাই, আপনের সন্তানের মা হইতে চাই। আমাগো ছেলে হইলে অরে মাদ্রাসায় পড়াবো, হাফেজ বানাবো, আমি ভালো হইয়া যাইতে চাই। দয়া করেন আমারে।
সে রেগে আমার চুলের মুঠি ধরে দেয়ালের সাথে বাড়ি মারে। কয়, ‘নটীগো আবার স্বামী, নটীগো আবার সংসার! তোর শখ দেইখা তো মনে কিছু মানে না। তুই এখন থাইকা এই কামই করবি। এই ঘরের ভাড়া, খাওন পরনের খরচ সব তোলতে হইবো। আর যদি কথা না শুনোস, তাইলে মাইরা গাঙ্গের পানিত ভাসাইয়া দিমু।’
সেই শুরু হইল। প্রত্যেক রাইতে দুইজনরে নিয়া আসতো। ট্যাকা পয়সা সব তার কাছে। খাওন দিত খুবই কম। সারাদিন থাকতো না, রাইতে মানুষ নিয়া আসতো। আস্তে আস্তে দিনেও দুইজন কইরা নিয়া আসতে লাগলো। তিন মাস এমনেই গেল। একদিন কইলাম, আমার শরীলডা খারাপ, আইজ কোন মানুষ নিতে পারুম না। সেইটা শুইনা সে আমারে অনেক মারলো। সেই রাইতে চার জনরে নিয়া আইসা একসাথে ঘরে ঢুকাইয়া দিলো। রক্তে আমার শরীলডা ভাইসা গেল। আমি বেঁহুশ হইয়া মাটিতে পইড়া গেলাম। যখন হুঁশ ফিরলো দেখি ঘরের দুয়ার খোলা। কোনদিকে না তাকাইয়া এক দৌড়ে বাইরে গেলাম। দৌঁড় দৌঁড়… কতক্ষণ কোনদিকে দৌঁড়াইছি জানিনা, শরীলে কোন শক্তি নাই। একসময় রাস্তার পাশের বিরিজের নিচে গিয়া শুইয়া পড়ছি, আর কিচ্ছু মনে নাই। যখন চোখ মেলছি দেখি আমি হাসপাতালে, রাস্তার মাইনষে অজ্ঞান অবস্থায় পাইয়া হাসপাতালে দিয়া গ্যাছে। তারপর সোজা এইখানে। কাপড় খোলার কামই যদি করতে হয় তাইলে নিজের মতন নিজের জায়গাতেই করন ভালা। আপনাগো ভালা মাইনষের সমাজে নটীগো জায়গা কই, কইতে পারেন? ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?
প্রচন্ড আক্রোশে সমাজের দিকে প্রশ্নটা ছুঁড়ে ববিতা চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। রাজিয়া এসে ববিতাকে জড়িয়ে ধরে। রঞ্জনা হতভম্ব হয়ে মাটিতে লেপ্টে বসে থাকে। ও নিজের মনে ভাবতে থাকে ‘আমাগো আর ফেরার উপায় নাই, যাওয়ার জায়গা নাই!’
ববিতার আর্তনাদ সুরমার বুকের ভেতর মেঘের গর্জন হয়ে বাজতে থাকে, আপরাধবোধে মাথা নুয়ে আসে। সে এই সমাজের সভ্য মানুষ, সাথে করে নিয়ে এসেছে সুশীল, শিক্ষিত ও পদস্থ মানুষদেরকে। মেয়েটা তো ওদের দিকেই আঙ্গুল তুলেছে, ওরা কোন জবাব দিতে পারেনি। সমাজের মানুষগুলতো তারই স্বজাতি, তারই স্বজন কিংবা পরিবার!
ফেরার পথে সুরমা গাড়ির সিটে মাথা এলিয়ে দেয়, অস্থিরতাটা কিছুতেই যাচ্ছে না। তার শুধু মনে হচ্ছে-
একজন নারী, একটা সংসারের স্বপ্ন
সমাজিক সন্মান নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন
ভালো (?) হয়ে যাবার স্বপ্ন
স্বপ্নপূরনে জন্মানো একটা বিশ্বাস
একটা বিয়ে, একটা সমাজ
দুই দিনের ভালবাসা
একজন পুরুষ, মানুষ পুরুষ
আবার প্রতারণা, বিশ্বাস ভংগ
অনেক পুরুষ, রক্তের বন্যা
নটীপাড়ায় প্রত্যাবর্তন
নটীপাড়ায় এক নটীর প্রত্যাবর্তন!
উহ্ সুরমা আর ভাবতে পারছে না, কি অসহ্য যন্ত্রণা, কপালের দুইপাশের শিরাগুলো দপদপ করছে!
(চলবে…)
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে
শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?