পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর সপ্তম পর্ব।।
সুরমা একটা ছোট্ট ঘুম দিয়ে উঠে শাওয়ার নিয়ে আবার তৈরি হলো। রাতের খাবারের আয়োজন সহযোগী সংস্থার অফিসেই করা হয়েছে। সেখানে সরকারি সমাজসেবা অফিসার, মহিলা ও শিশু বিষয়ক অফিসার, সাংবাদিক, শিক্ষক, সমমনা কয়েকটি এনজিওর প্রতিনিধিসহ এলাকার কিছু গন্যমান্য লোকজন আসবেন, ছোট্ট আলোচনাও থাকবে। সন্ধ্যার পরে মার্ক ও জেসিকাকে সাথে নিয়ে সুরমা সহযোগী সংস্থার অফিসে গেল। মঞ্জু দিদি ও দুইজন কিশোরী মেয়ে এসে তাদের অভ্যর্থনা জানালেন। বড় একটা মিটিং কাম ট্রেইনিং রুমে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। কয়েকজন অতিথি এসে গেছেন। জামাল্পুর যৌনপল্লীর যৌনকর্মী সংগঠনের সভানেত্রী রোকেয়া আপা ও সাধারন সম্পাদক সাজেদা আপাও আছেন। মঞ্জু দিদি একটু বিনোদনের ব্যবস্থাও রেখেছেন। সংস্থার পুষ্টি প্রকল্পের প্রচারণার জন্য যে গানের দল আছে তাদেরকে আনা হয়েছে। সুরমারা ভিতরে গিয়ে বসে টুকটাক কথাবার্তা বলছে একে অন্যের সাথে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই অনুষ্ঠান শুরু হলো। শুভেচ্ছা বিনিময় ও পরিচিতি পর্ব শেষে মঞ্জু দিদি গানের দলের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সেই দলে কিশোরী মেয়ে দুটিও ছিল। তিনি তাদের দেখিয়ে বললেন, ‘‘রত্না ও সোহানা দুজনেই যৌনকর্মীর সন্তান। এনজিও শেল্টার হোমে থাকে ও সরকারি হাইস্কুলে ক্লাস সেভেনে পড়ে। তারাও পুষ্টি প্রকল্পের গানের দলে চাকরি করে। তাদের ব্যাংক একাউন্ট আছে। বেতনের টাকা তারা জমিয়ে রাখে ভবিষ্যতের পড়াশোনার খরচের জন্য।”
– বাংলাদেশে যৌনকর্মীর সন্তানরা পড়াশোনা করে? চাকরি করে?
জেসিকার ইংরেজিতে করা প্রশ্ন সুরমা বাংলা করে দেয়।
– আমরা সাধারনত ধরে নেই যে যৌনকর্মীর মেয়েরা যৌনকর্মীই হয় বা হতে হবে। সেই কারণে এবং যৌনপল্লীর ভিতরের পরিবেশ এবং দালালদের সম্পৃক্ততার কারনে যৌনকর্মীর মেয়েদের যৌনকর্মী হবার আশংকাই বেশি থাকে। কিন্তু বাস্তবতা কিছুটা ভিন্ন। সাধারনত কয়েক প্রজন্ম এখানেই থাকে, বাইরে যাবার জায়গা নেই, বাইরের জগত সম্পর্কে ধারণা নেই এমন মেয়েরা যৌনকর্মী হবে ধরেই নেয়। যারা বিভিন্ন সময় পাচার হয়ে এখানে যৌনপল্লীতে এসেছে তারা তাদের ছেলেমেয়েদের গ্রামের বাড়িতে, আত্নীয়ের বাড়িতে রাখার চেষ্টা করে। সর্দারনী বা নেত্রীদের কেউ কেউ শহরে বাসা ভাড়া করে সন্তানদের রাখার ব্যবস্থা করে। তারা কলেজে, ভোকেশনাল স্কুলেও পড়াশোনা করে। এখন এনজিওদের ও সরকারি শেল্টার হোমের কারনে বেশ কিছু ছেলেমেয়ে বাইরে পড়াশোনার সুযোগ পাচ্ছে। বর্তমানে এই যৌনপল্লীর ১৮৭ জন যৌনকর্মীর মধ্যে মাত্র ৯ জন যৌনকর্মী তাদের মায়ের পরে এই পেশায় যুক্ত হয়েছে। কাজেই আমরা যদি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলাই, যৌনকর্মীদের সন্তানরা যদি একটু সহযোগিতা পায় তবে তারাও নতুন সুন্দর জীবন তৈরি করতে পারে আপনার আমার সন্তানের মতই।
মঞ্জু দিদি বুঝিয়ে বলেন।
অন্যান্য অতিথিরা, মার্ক ও জেসিকা খুব খুশি হল মেয়ে দুটিকে পড়াশোনা আর চাকরি করতে দেখে। এরপর গানের দল একটি দলীয় পুঁথিপাঠের মাধ্যমে যৌনপল্লীর বিবরণ তুলে ধরে উপস্থিত অতিথিদের সামনে।
“রেলস্টেশন -বাসস্ট্যান্ড থন, এক কিলোমিটার যান
রাণিগঞ্জ বাজারে যৌনপল্লী আছে একখান
কবে হইছে, কেমনে হইছে আমরা ন’জানি
৫৫ শতাংশ জমিন আছে সেইডা তো শুনি
১১ কোটি টাকা জমিনের দাম
১৭ জন মালিক, সেইডা জানিবাম
১১ খানা বাড়ী আছে ৩২ বাড়ীওয়ালী্র
১৮৭ খানা ঘরে ব্যাবসা ১৮৭ যৌনকর্মীর
১৫০ জনের নামে আছে জাতীয় পরিচয় পত্র
মদ-মাদকের কারবার আছ ভিতরে যত্রতত্র
তিনভাবে ব্যবসা চলে- স্বাধীন, ছুকরী, বাবুর তলে
তয় বাবুর সাথে যোগ রাখে, প্রায় সকলে…….।”
আলোচনা বেশ ভালোই হল। তারই প্রেক্ষিতে বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশমালা তৈরি করা হয়। যেমন, ছুকরী (১৮ বছরের কম বয়সী মেয়ে কিনে তাদেরকে দিয়ে যৌনব্যবসা করানো) কেনার বিষয়টা কমানোর জন্য যৌথ প্রতিরোধ কমিটিকে আরো জোরদার ভূমিকা পালন করতে হবে। ছুকরীদের উপর অমানবিক শারিরীক-মানসিক অত্যাচারগুলো কমানোর জন্য মনিটরিং বাড়াতে হবে। ছুকরীদের সাথে এনজিও কর্মীদের প্রায়ই কথা বলার ব্যবস্থা করার জন্য সর্দার্নী ও বাবুদের সাথে আলোচনায় বসতে হবে। সাংবাদিকরা যৌনকর্মী হবার রুটকজ এবং যৌনকর্মীদের মানবাধিকার নিয়ে নিয়মিতভাবে লেখালেখি করবেন। যৌনকর্মী সংগঠনের সভানেত্রী রোকেয়া আপা বললেন, নেত্রীরা সরকারি প্রতিষ্ঠানের দায়বদ্ধতা বাড়ানোর জন্য বিভিন্ন দপ্তরের সাথে তাদের যোগাযোগ বাড়াবে, মিটিংয়ে যাবে এবং তাদেরকে সংগঠনের বিভিন্ন কার্যক্রম দেখানোর জন্য নিয়ে আসবেন।
আলোচনা শেষে সমাপনী পরিবেশনায় ছিল জামালপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলের একটি আঞ্চলিক গান। বিয়ের আগের দিন গায়ে হলুদে তাদের আদরের কন্যাকে নিয়ে মা-খালারা এই গানটি গেয়ে থাকেন। তাদের আবেগ ভালবাসার প্রকাশ এই গান। ঠিক একইভাবে একজন যৌনকর্মী মাও স্বপ্ন দেখেন তার মেয়েরও আলতা কাজল পড়ে বিয়ে হচ্ছে সমাজের আর দশজন সাধারন মেয়ের মতন করেই। একজন যৌনকর্মী মায়ের সেই স্বপ্ন রত্না ও সোহানা কেঁদে কেঁদে এই গানের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুললো। সুরমা মার্ক আর জেসিকাকে গানের প্রেক্ষিত আর অর্থ ব্যাখ্যা করলো।
‘‘কাল আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইবো
কাল আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
আসিয়া রঙ্গিলা কুসুম পিঁড়িতে বসিবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
পিঁড়িতে বসিয়া কুসুম ছিনানও করিবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
কাল আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
ছিনানও করিয়া কুসুম আলতা পড়িবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
আলতা পড়িয়া চোখে কাজলও পাটিবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
কাল আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইবো
কাল আমরার কুসুমরানীর বিবাহ হইবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো
বিবাহ হইবো, বিবাহ হইবো…।”
গানের শেষে সবাই নিস্তব্ধ, আবেগ সামলানোর চেষ্টা করছে, কেউই কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। জেসিকাই প্রথমে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দিল। সাথে সাথে সকলে উঠে দাঁড়ালো। একঘর মানুষ মুহুর্তের জন্য বৈষম্যহীন “শুধুই মানুষ” উপলব্ধিতে মায়ায় আবদ্ধ হলো। জীবনটা যদি এই মুহুর্তেই স্থির হয়ে থাকত তবে কতই না ভালো হত, পৃথিবী অনেক সুন্দর হত। কিন্তু বাস্তব ভিন্ন। খাওয়া শেষে সকলে যে যার গন্তব্যে ফিরলো। মার্ক আর জেসিকা পুরো রাস্তা জুড়ে রত্না আর সোহানার কথা বলতে বলতে হোটেলে ফিরলো।
সকালের নাস্তা সেরে, হোটেল থেকে একবারে চেক আউট করে বের হল সুরমা, মার্ক আর জেসিকা। প্রথমে যৌনপল্লীর প্রকল্প অফিসে গেল। আজ ক্লিনিক ডে, ডাক্তার-প্যারামেডিকের সাথে কথা বলবে তারা, রোগীদের এক্সিট ইন্টারভিউ করবে। শম্পা তার টিমকে কাজে পাঠিয়ে অফিসেই ছিল। সে মার্ক আর জেসিকাকে নিয়ে ডাক্তার আপার সাথে কথা বলার ব্যবস্থা করতে গেল। ডাক্তার দেখিয়ে বের হওয়া একজন যৌনকর্মীকে বসিয়ে রাখলো ইন্টারভিউয়ের জন্য। আরো একজন রোগী এসেছে, প্যারামেডিক তার ফাইল বের করে সমস্যা লিখছে। সুরমার এই মুহুর্তে এখানে কিছু করার নেই। সে ল্যাপটপ খুলে ইমেইল এর উত্তর দিতে লাগলো। ডাক্তারের সাথে কথা শেষ করে মার্ক আর জেসিকা বাইরে বসিয়ে রাখা মেয়েটির সাথে কথা বলতে গেল পাশের রুমে। এমন সময় যৌনকর্মী সংগঠনের সভানেত্রী রোকেয়া আপা চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতে হুড়মুড় করে ঢুকে পরলো প্যারামেডিকের রুমে। সুরমা, শম্পা, মার্ক, জেসিকা সকলেই বেরিয়ে সেখানে গেল। রোকেয়ার কপালের এক কোনা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে, চোখের নীচে রক্ত জমে আছে, বাম গাল ফোলা, নীচের ঠোঁট কেটে রক্ত টপটপ করে শাড়ীতে পড়ছে, ডান হাতটা ব্যাথায় নড়াতে পারছে না। প্যারামেডিক জিজ্ঞেস করলো, ‘কি হয়েছে রোকেয়া আপা?’
‘ঐ হারামজাদা, ঐ হারামজাদা, খানকির পোলা আমারে মাইরা ফেলাইছে গো আফা, ডাক্তার আফা কই? মইরা গেলামগো আফা’, রোকেয়ার কেঁদে কেঁদে উত্তর
‘ওনাকে আগে ডাক্তারের রুমে পাঠান, পরে কথা বলি’, শম্পা প্যারামেডিককে বলে।
রোকেয়া ডাক্তারের রুমে ঢুকলে যে যার কাজে ফিরে।
‘শম্পা, রোকেয়া আপা এখানকার সভানেত্রী, ওনার গায়ে এভাবে হাত তোলার সাহস কার?’ সুরমা জানতে চায়
‘নারীর গায়ে হাত তোলার প্রথম সাহস পুরুষের, এটাই তো যুগ যুগ ধরে হয়ে আসছে আপ ‘, শম্পার শান্ত উত্তর।
‘এমন পুরুষ কে আছে এই ব্রোথেলে? রোকেয়া আপা যে মারদাঙ্গা ক্ষমতাশালী মহিলা সে কি কোন পুরুষকে তোয়াক্কা করে? এক্ষুনি উনি থানায় ফোন দিলে যে কাউকে নিয়ে গিয়ে ১৪ শিকের মধ্যে পুরবে’, সরমা বলে।
‘কাউকে কাউকে সেও তোয়াক্কা করে আপা’, শম্পা বিষন্ন হেসে বলে।
সুরমা একটু অবাক হয় কিন্তু কথা বাড়ায় না। রোকেয়া আপাকেই জিজ্ঞেস করবে ভেবে কাজে মন দেয়।
প্রায় আধাঘন্টা পর কপালে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে, হাতটা গজ দিয়ে গলার সাথে ঝুলিয়ে রোকেয়া বের হয়ে এসে শম্পার পাশে বসে। সুরমা তাকিয়ে দেখে। জিজ্ঞেস করে, ‘কিভাবে হল?’
‘মারছে’, রোকেয়ার উত্তর।
-কে মেরেছে?
‘আমারে আবার কেডাই মারবো? সাহস আছে কারও? শুধু একজন, ঐ একজনই আসমত ফকির, বেজন্মার বেজন্মা, আমার বাবু’, দাঁতে দাঁত ঘষতে ঘষতে রোকেয়ার উত্তর।
‘আপনার বাবু আপনাকে মারে?’ সুরমা কথার পর কথা জানতে চায়।
-হ, মারে তো
– এইভাবে মেরেছে?
– হ, এমুন কইরাই মারে।
– কেন মেরেছে?
– নতুন একটা ছুকরী আসছে খুবই সুন্দরী। সে তার কাছে গ্যাছে।
‘মানে কি?’ সুরমা জানতে চায়
– মানে মাইয়াডার সাথে শুইছে, সে আমার বাবু, সে আমার ছুকরীর সাথে শুইছে! বুঝেছেন আমার কত কষ্ট হইছে? আমি কত অপমানিত হইছি? আমার কত বুক জ্বলে! এইডা নিয়া রাগারাগি করছি। পরে আমারে মারছে। কিল, ঘুষি, লাত্থি, পরে ধাক্কা দিয়ে ইডের উপ্রে ফেলাইছে।
রোকেয়া ক্ষোভ প্রকাশ করে
-আপনি মার খেলেন?
সুরমার বিস্ময় প্রকাশ
– হ খাইছি তো
– আপনি বাবু রাখেন কেন?
– কী করবো আফা?
– ছেড়ে দেন
– কী কন আফা? আমার বাবুরে আমি ছাড়বো ক্যান?
– সে আপনাকে মেরেছে তাই, ছেড়ে দিবেন
– তাতে কী? বাবুরা তো মারেই। আমাগো বাবু হইলো স্বামীর মতন। সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে। এইডাই নিয়ম। আপনাগো শিক্ষিত মাইনষের মইধ্যেও স্বামীরা বউরে মারে। একটু একটু মাইর খাইতে ভালই লাগে, নিজেরে বউ বউ লাগে।
সুরমা আকাশ থেকে পড়ে, “বাবু কি আপনার ভরণ পোষন দেয়? বাবুর সাথে থাকতে হয় কেন? বাবু কে?”
– আফা, বাবু আমার ভালোবাসার মানুষ, আমার অভিভাবক, আমার স্বামীর মতন। সে আমারে টাকা-পয়সা দেয় না। আমিই তারে টাকা-পয়সা দেই, থাকতে দেই আমার সাথে। তার বাড়িতে পরিবার আছে। সেই পরিবারের খরচও আমি দেই। সে স্বামীর মতন আমার সাথে থাকে।
– তাতে আপনার লাভ কি?
– আমি কোন বিপদে পরলে সেই আমারে দ্যাখে। আমিতো ছুকরী খাটাই, ঘর ভাড়া দেই আবার মদের কাউন্টারেও শেয়ার আছে। এইগুলার অনেক হ্যাপা আছে। মাস্তান, থানা পুলিশ হইলে সেই সব কিছু করে। সে আমারে ভালোবাসে। আমিও ভালোবাসি। আমার ছেলে মেয়েদের দেখাশোনাও করে।
– আপনাকে ভালোবাসলে আরেকজনের কাছে যায় কেন? তাছাড়া আপনার যা ক্ষমতা থানা পুলিশ সবই সামলাতে পারেন। মাস্তানরা আপনাকে দেখলে ভয় পায়। আপনার কেন বাবুর কাছে থাকতে হবে? দরকার হলে আপনি দুই একজন কর্মচারী রাখেন। আপনি যৌনকর্মীদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন। আর আপনিই টাকা পয়সা সব বাবুরে খাওয়ান! আবার তার হাতে মার খান! কীভাবে সম্ভব? যে আপনারে মারে তাকে ভালোবাসেন কি করে?
– একজন মানুষরে ভরসা করতে, আশ্রয় করতে ইচ্ছা করে। সেই ভরসা আর ভালোবাসার জায়গা বাবু। কিন্তু আমি জানি তাগোরে চিরদিনের জন্য ভরসা করা যায় না। বাবুরাও একজনের টাকা পয়সা নিয়া আরেকজনের কাছে চইলা যায়। কী করবো কন আফা! আমি হইছি মনের দাস, আবেগের দাস, ভালোবাসার দাস। যুক্তি বুদ্ধি কিছুই মন মানতে চায় না। মন এক আজব জিনিস। এই যে যৌনকর্মীরা এত ব্যাডাগো লগে শোয়, তারপরও মন কান্দে ভালবাসার মাইনষের লাইগা। এর মইধ্যেই একেকজন একেকজনের সাথে প্রেম করে, ঘর বান্ধার স্বপ্ন দেখে।
– শুধুই ভালোবাসা? আপনি নেত্রী হয়ে মার খাচ্ছেন, টাকা-পয়সা খোয়াচ্ছেন, আপনি অধিকার আন্দোলন করবেন কীভাবে? আপনার সব সিদ্ধান্ত আপনি নেন?
– কিছু কিছু আমি বাবুরে জিগাইয়া করি। টাকা-পয়সা, জমি- জিরাতের বিষয়েও তারে জিগাইয়া করি
– তারমানে যৌনকর্মী অধিকার আন্দোলনের দিকনির্দেশনাও যদি আপনি বাবুর কাছ থেকে নেন তাহলে সেটা কোনদিনও যৌনকর্মীদের মঙ্গলের জন্য হবে না। একে তো বাবু পুরুষ, তার উপর তারা নেত্রীদের সিদ্ধান্ত দেয়, কাজেই তারাই এখানে সবচেয়ে ক্ষমতাশালী। ফলে আপনাদের অধিকার আন্দোলনও সেই পুরুষের হাতেই।
‘এমুন কইরাতো ভাবি নাইগো আফা’, রোকেয়ার ইতস্তত উত্তর।
– খুব সাধারন হিসাব রোকেয়া আপা। সর্দারনী হিসাবে আপনি নিজেই ছুকরী খাটান, আবার আপনিই ছুকরী কমানোর আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ব্যাপারটা কেমন হল? আপনি নেত্রী হয়ে নিজে ছুকরী খাটানো বন্ধ করেন, তারপর আন্দোলন করেন। দেখবেন অন্যরাও আস্তে আস্তে বাদ দেবে, ছুকরী আর থাকবে না। যৌনকর্মীদের অধিকার আন্দোলন ফিরে দেখবার প্রয়োজন এখন। প্রয়োজন নতুন করে পরিকল্পনা করার।
সুরমার অস্থির লাগে। এবার ট্রিপ রিপোর্টে বিষয়টা আনতে হবে।
দুপরের দিকে ব্রোথেল থেকে সুরমা, মার্ক আর জেসিকা বেরিয়ে পড়ে। পথে সুরমা রোকেয়ার বিষয়টা, বাবু ও বাবুদের ভুমিকা এবং ব্রোথেলের পাওয়ার ডিনামিকস নিয়ে ওদের সাথে আলোচনা করে। বিকালের দিকে মার্ক ও জেসিকা সুরমাকে ময়মনসিংহে হোটেলে নামিয়ে দিয়ে ঢাকার পথে রওয়ানা হয়।
(চলবে…)
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে
শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?