পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর নবম পর্ব।।
একজন নারী মা হতে পারবে না বলে সংসারে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেল! এতই সস্তা জীবন?
নাকি নারীর জীবন দেখেই হিসাবটা এমন। যদি কোন পুরুষ বিয়ের পরে তার বাবা হবার ক্ষমতা হারাতো, তবে তার পরিণতি কি এই মেয়েটির মত হত? এত পার্থক্য নারী পুরুষের জীবনের মধ্যে? এত বৈষম্য আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির? সুরমা নিজের মনে ভাবতে থাকে।
“সংসারে নারীর রোল কি, আপা?”, তিতলীর আচমকা প্রশ্নে সুরমার ভাবনায় ছেদ পড়ে। মুখ তুলে তিতলীর দিকে তাকায়। মেয়েটা কেমন ব্যাথাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে।
‘‘কাজ করা, পুরুষের মনোরঞ্জন মানে তাদের যৌনকাজে সঙ্গী হওয়া আর প্রজন্ম রক্ষা করা। আরো নির্দিষ্ট করে বললে ঘরের কাজ, স্বামীর শোয়ার সঙ্গী আর সন্তান উৎপাদন।’’ সুরমার উত্তর।
‘‘কাজতো কাজের মানুষকে দিয়ে করানো যায়, যৌনকাজের সঙ্গীও বাইরে পাওয়া যায়। তার মানে শুধু সন্তান ধারণেই নারীর প্রয়োজন? বংশরক্ষা নিজের ঔরসের হতে হবে, তাই তো?” তিতলী আবারো জিজ্ঞেস করে।
‘‘বিষয়টা সেরকমই’’, সুরমার প্রতিউত্তর।
– কিন্তু এগুলো সবই তো বিয়ের পরের রোল। জন্ম থেকে বিয়ের আগ পর্যন্ত আর কোন কাজ নাই? মা-বাবার কাছে? নাকি মা-বাবার বাড়ি শ্বশুরবাড়ির জন্য তৈরি করার প্রস্তুতি পর্ব?
– সব মেয়েই মা-বাবার কোলে রাজকন্যা হয়ে জন্মায়। বিয়ের পর হয় আসল সমস্যা!
– আসলেই কি সকল কন্যা সন্তান রাজকন্যা হয়ে জন্মায়? মেয়েদের অধিকারে কন্যাশিশু দিবস কেন তাহলে? ছেলে মেয়ে বৈষম্য ঘর থেকেই শুরু হয়, আপা।
– ঠিক বলেছেন তিতলী। আমার বিষয়টা হঠাৎ মাথায় আসেনি।
– আপনার মাথায় আসেনি, কারন আপনার জীবনে তেমনটি ঘটেনি। কিন্তু আমার জীবনে ঘটেছে। আল্ট্রাসনোগ্রামের রিপোর্ট দেখে আমার বাবা আমার মাকে নানাবাড়িতে রেখে এসেছিল। আমার জন্মের পর দুই বছর আমার মুখ দেখেনি। এর মধ্যে কয়েকবার নানাবাড়িতে গিয়েছিল বাবা, কিন্তু আমি তখন খালার কাছে থাকতাম। আমার ভাইটা যখন হল, তার ৪০ দিন পরেই বাবা গিয়ে আমাদের নানাবাড়ি থেকে বাসায় নিয়ে এলো। ভাইবোন আমরা পিঠাপিঠি, অথচ যত্নে কি ভীষণ বৈষম্য। মা প্রচন্ড কাঁদতেন। ভাইকে কিন্ডার গার্টেন স্কুলে ভর্তি করলো আর আমাকে সরকারি প্রাইমারিতে। আমি ক্লাসে প্রথম হতাম, বাবা বলতো সরকারি প্রাইমারিতে কাজের বুয়াদের বাচ্চারা পড়ে, ওখানে প্রথম হওয়া কোন বিষয় না। বাবার সামনে আমি কুঁকড়ে থাকতাম কিন্তু ভিতরে ভিতরে কি ভীষণ ক্ষোভ তৈরি হত! প্রায়ই ভাবতাম নানাবাড়িতে খালার কাছে চলে যাবো। কিন্তু পারতাম না, আমার ভাইটার জন্য। ভাই আমাকে এত মায়া করতো! ভাই, আমার ছোট্ট ভাইটাই হলো আমার খেলার সঙ্গী, আমার সব আনন্দের উৎস। সেও বুঝেছিল এ বাড়িতে তার জন্য বরাদ্দ আর আমার জন্য বরাদ্দ এক নয়। তাই ভাইকে কিছু আলাদা করে খেতে দিলে, সে আমার জন্য একটু করে রেখে দিত। যখন বড় হতে থাকলো, তখন সে সবকিছুই আমাকে সাথে নিয়ে করতে চাইতো- যেমন খাওয়া, জামা রঙ পেন্সিল কেনা। বাবা ছেলের কোন আবদার ফেলতে পারতো না। ভাইটা যত বড় হতে থাকলো, পরিবারে আমার জায়গা তত বাড়তে থাকলো। আপা জানেন, আমি আমার বাবাকে ক্ষমা করে দিয়েছি। কারণ আমার ভাইয়ের মত একজন “মানুষ পুরুষ” জন্ম দেওয়ার জন্য। আমার রেজাল্ট ভালো, প্রায় পুরো শিক্ষাজীবনই সরকারের টাকায় চলেছি মানে বৃত্তির টাকা দিয়ে। ক্লাস এইট থেকে টিউশানি করেছি, আমার নিজের খরচপাতি এমনকি আমার প্রাইভেট টিউটরের টাকাটাও জোগার করেছি। আমার জন্য বাবার তেমন কোন খরচ হয়নি। নিজের চেষ্টায় চাকরিও পেয়েছি। আমাকে দেখে আমার ভাইটা নারীকে মানুষ হিসাবে দেখতে শিখেছে, নারীকে অমূল্য ভাবতে শিখেছে। এইটা আমার একটা বড় পাওয়া। সবসময় প্রার্থণা করি ভাইটা যেন ওর বৌকেও একই সন্মানের চোখে দেখতে পারে।
সুরমা অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে তিতলীর দিকে। এই চটপটে হাসিখুশি মেয়েটার ভিতরে এতটা কষ্ট জমে আছে! তার খুব মায়া হয়। তবে ওর ভিতরে যে শক্তি আছে তার আভা যেন সুরমার চোখ-মুখেও লাগে। ঠিক তখনই টুটুল আউটরিচ ওয়ার্কার দুইজনকে সাথে নিয়ে অফিসে ঢোকে। তারা যৌনপল্লীর ভিতরে একচক্কর দিয়ে এসে জানালো যে প্রস্তুতি ভালো, ব্যালট বাক্স বানাচ্ছে আর প্রার্থীরা গণসংযোগ করছে। সুরমা তিতলীকে বলে, ‘‘২০ জন প্রার্থির সাথেই কথা বলবো একেকজন করে।”
– ওদেরকে বলা আছে, আপা। আমরা একজন একজন করে ডাকতে পারি।
‘‘জোছনা আপা কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে আমাকে জানিয়েছে”, একজন আউটরিচ ওয়ার্কার বলল।
এমন সময় চারজন যৌনকর্মী একসাথে এলো। তারা খুব উত্তেজিত গলায় বলল, ‘‘তিতলী আপা, আপনাগো সাথে কথা আছে।”
– আপারা, বসেন। বলেন কি কথা।
– যৌনপল্লীর নির্বাচন, আমাগো ভিতরের বিষয়। আমরা কারে ভোট দিবো, কে আমাগো ভালো করবো সেইডা আমাগো বিষয়। বাইরের মাইনষের কোন খবরদারি এইখানে চলব না, আমরা চাইনা। সুরমা আপাও আছে, টুটুল ভাইয়াও আছে আপনেরা কন আমরা ঠিক কইছি কিনা।
তিতলী সুরমার দিকে তাকায়। সুরমা বলে, ‘‘আপনারা খুলে বলেন আপা।”
“ছার হইলো জোছনার মানুষ, হোসেন ভাই হইলো সেলিনার মানুষ। তারা দুজনেই আমাগো উপরে ভোট দেওনের লাইগা জোর জবরদস্তি করতেছে। রাবেয়া নিজেই লড়তেছে। এখন কন এইগুলান কত সহ্য করা যায়?” চারজন মিলে কথা বর্ণনা করলো।
– স্যার আর হোসেন ভাই কী করে?
– ছার হইলো ইস্কুলের ছারগো পড়ায়। আর হোসেন ভাই হইলো এলাকার মাস্তান। দুইজনেরই অনেক ক্ষমতা। হোসেন ভাই কইছে সেলিনা না জিতলে হুজুরগো দিয়া আমাগো উচ্ছেদ করাইবো। আর ছারে কইছে জোসনা না জিতলে পাড়া জ্বালাইয়া দিবো।
“জোসনা আপা গেল দুই বছর সভানেত্রীর দায়িত্ব পালন করলো। আপনারাই চিন্তা করেন সে এই দুই বছরে আপনাদের কতটা ভালো করেছে, কতটা খারাপ করেছে। সে জিতলে আপনাদের কী সুবিধা ও অসুবিধা হবে, নিজেরা আলোচনা করে দেখেন। একইভাবে সেলিনা আর রাবেয়ার কথা ভাবেন।” সুরমা বুঝিয়ে বলে।
– সে দুই বছরে সংগঠনের ভালোই করছে। কিন্তু সমস্যা হইলো ছারের সাথে তার ব্যবসা। তারা দুজনে মিলে মেয়ে কেনা-বেচা করে, আর বিদেশে পাচার কইরা দেয়। এইখানে কয় ছুকরী কিনছি, তারপর সময় মত বিদেশে বিক্রি করে।
– থানায় জানাননি কেন?
– ছারের নামে পাচারের মামলা আছে। ওসি সাব একবার এইখান থাইকা ধইরা নিয়া গেছিল। একটুবাদে মন্ত্রীসাবের ফোনে ছাইড়া দিছে। আর জোসনা সব জায়গায় সভানেত্রীর আইডি কার্ড দেখাইয়া ছাড়া পাইয়া যায়। আর সেলিনা সর্দারনী হইলেও ভালো। কিন্তু হোসেন ভাই একবার দুইজন হুজুর নিয়া আইসা আমাগো তওবা পড়াইছিলো। একজন হুজুর মাটির দিকে তাকাইয়া তওবা পড়াইছে, সে নিজেই হোসেন ভাইয়ের ডরে কাঁপতেছিলো। আরেকজন হুজুর যতজন মাইয়ারে তওবা পড়াইছে, সকলডির বুকে হাত দিছে, চোখ দুইখান চকচক করতেছিল। মনে হইতেছিল চোখ দিয়াই মাইয়াগো সাথে যৌনকাজ করতেছে। এখন বিষয়ডা হইতেছে আমরা যারে ভালো পাই তারে ভোট দিমু। তারা খবরদারি করতে আসে ক্যান? আরো একখান সমস্যা হইতেছে ছার আর হোসেন ভাইয়ের লোকেরা যৌনপল্লীর বাইরেও গণ্ডগোল মারামারি করার হুমকি দিচ্ছে একদল আরেকদলরে।
– এই কথাগুলো অন্যরা জানে?
– হ সকলডি জানে। এইখানে যেই এনজিওরা কাজ করে তারাও জানে, থানাও জানে আর ভিতরের সব মাইয়ারাও জানে। সর্দার্নী, বাবু, ঘরওয়ালীরাও জানে। একেকজন একেকবার একেক দলে যাইতে চায়। আপা-ভাইয়া, কিছু একটা কন আমরা কী করবো?
– আপনারা যেটা ভালো বুঝবেন সেইটাই করবেন। সবকিছু যেন ঠিকভাবে হয় আমরা সেইজন্য সাপোর্ট দিচ্ছি ।
এইসময় জোহরের আজান শুরু হয়। টুটুল বাইরে থেকে খাবার কিনে আনার কথা বলে। তিতলী অফিস সহকারিকে বলে দেয় কোন্ রেস্টুরেন্ট থেকে কী কী খাবার আনতে হবে। টুটুল টাকা বের করে দিয়ে খাবারের সাথে বিল আনার কথা মনে করিয়ে দেয়। দরজার বাইরে জোসনাকে আসতে দেখে মেয়েগুলো বের হয়ে যায়। জোসনা এসেই সালাম দিয়ে বলে, ‘‘সুরমা আপা, অনেকদিন পরে আসছেন, আজ দুপুরে আপনাগো সবায়রে আমি খাওয়াবো। না করতে পারবেন না কইলাম। টুটুল ভাইয়া বলেন কী খাবেন? কোন্ দোকান থাইকা খাবার আনাবো?’’
টুটুল কিছু বলার আগেই তিতলী বলে ওঠে, “টুটুল ভাই খাবার আনতে পাঠিয়েছেন। আপনি বরং উনাদের সাথে আলাপ করেন। উনারা আপনাদের সাথে কথা বলতে এসেছে।”
‘‘সুরমা আপা, আগে কন কেমন লাগতেছে পাড়াডারে দ্যাখতে?”, জোছনা জিজ্ঞেস করে।
‘‘খুব ভালো লাগছে জোসনা আপা, জাতীয় নির্বাচনে যেমন হয়, তেমন লাগছে’’, সুরমা হেসে উত্তর দেয়।
– আপা, আমার লগে এক প্রেসের মালিকের খাতির আছে। সেই সকলের পোস্টার এমনি এমনি ছাপায়া দিছে, আবার ভোটের কাগজও (ব্যালট পেপার) ছাপায়া দিছে।
‘‘এমনি এমনি দিয়ে দিল?’’ টুটুল অবাক হয়ে জানরে চায়।
– হ ভাইয়া, ঐ ভোটের পরে নতুন মাইয়া আসলে কয়দিন থাকতে দিলেই খুশি হইয়া যাইবো। তার কী পছন্দ তা তো আমি জানিই। আমি নেত্রী মানুষ তো আমারে অনেক দিক সামলাইয়া চলতে হয়।
টুটুল, সুরমা আর তিতলী একবার একে অন্যের দিকে তাকায়। টুটুল এবার জিজ্ঞেস করে, ‘‘জোছনা আপা, আপনি তো গত দুইবছর সভানেত্রী পদে ছিলেন। আবার এইবারও দাঁড়িয়েছেন কেন? বিশেষ কোন কারন আছে? পরেও তো দাঁড়াতে পারতেন।”
– হ ভাইয়া পরেও পারতাম। কিন্তু বিষয় হইলো কি, আমি সভানেত্রী হইয়া দুই বছরে সংগঠনের ব্যাংক একাউন্টে ৫০ হাজার টাকা জমাইতে পারছি, সকল প্রজেক্টের কাজ ভালোভাবে করছি, নতুন একটা প্রজেক্ট পাইছি, মাইয়াগো ঢাকায় নিয়া ট্রেনিং দিছি, ২ জনরে বিদেশে ঘুরাইয়া আনছি। এইসব করতে গিয়া আমার অভিজ্ঞতা হইছে, ভুল যা করছি তা থাইকা শিখছি কেমনে কামডা করলে আরো ভালো হইতো। আমি যে উন্নতি করছি সেই উন্নতি ধইরা রাখনের লাইগা, আর যে ভুল করছি সেগুলা আরো ভালো করনের লাইগা এইবার আমার সভানেত্রী হওন খুবই দরকার। ভাইয়া বুঝলেন না, ঐ যে মন্ত্রী টিভির ভাষণে কইছিলো না সেইরকম। কথাডা আমার মনে ধরছে গো ভাইয়া। আমিও তার মতন হইতে চাই। আমার সাহেবে কইছে আমারে উপজেলার মেম্বার ভোটে দাঁড়া করাইবো ভবিষ্যতে।
টুটুল কিছুক্ষন হা করে থাকে, ভাবে বলে কি মহিলা!
টুটুল পরের প্রশ্নটি করতে যাবে ঠিক তখনই জোছনা নিজেই জিজ্ঞেস করে, ‘‘সুরমা আপা, আপনি কি সকালেই ঢাকা থাইকা আসছেন নাকি রাইতে আইসা হোটেলে উঠছেন?”
– কাল বিকালে এসেছি। কেন জোছনা আপা?
– টিভিতে যে আমারে ভোট দেওনের কথা কয় সেইডা দ্যাখছেন? আমার সাহেবে করাইছে।
– দেখেছি জোছনা আপা। আপনার “সাহেব” বিষয়টা কী?
– আপা ঐ যে যার নাম দেখায়, আজমল হুদা, সরকারি কলেজে ইস্কুলের মাষ্টারগো পড়ায়, উনিই আমার সাহেব।
৩৫ বছরের জোছনা ২০ বছর ধরে এই পল্লীতে থাকে, এখানকার সর্দারনী, সে নতুন বউয়ের মত লাজুক হেসে তার সাহেবের কথা বলছে। সুরমা কিছুই না বুঝে আবার জিজ্ঞেস করে, ‘‘সাহেব মানে কী?”
– ক্যান আপা? আপনার না হয় বিয়া হয় নাই, কিন্তু আপনার মায়ের তো হইছে!
জোছনা একটু উস্মা প্রকাশ করে। একটু অভিমানি গলায় বলে, “উনি আমার জামাই। উনার সাথে আমার বিয়া হইছে”, বলেই সে একটি সিডি বের করে সুরমাকে এগিয়ে দেয়। বলে, “আপা, আমি জানতাম কেউ বিশ্বাস করবো না, তাই ভিডিও কইরা রাখছি। তাছাড়া উনিও আমারে অস্বীকার করতে পারবো না, আমার কাছে ভিডিও আছে প্রমাণ হিসাবে। আমি আপনের লাইগা এই সিডি কইরা আনছি। সাথে নিয়া যান। আমার কাছে আরো আছে।”
– বিয়েটা রেজিস্ট্রি করেছেন? দেনমোহর কত?
– কী কন আপা, বিয়া হইলো মনের বিষয়। হুজুর আইসা বিয়া পড়াইছে, তাতেই হইছে। আর দেনমোহর তো কয়ডা টাকা। তার সাথে আমার টাকা-পয়সা নিয়া কোন ঝামেলা নাই।
– আপনি একজন সরকারি কলেজের অধ্যাপককে বিয়ে করেছেন, এটা খুবই খুশির খবর। আপনার জন্যে সমাজের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বসবাস করা (সোশ্যাল ইনক্লুশন) সহজ হবে। আপনি তো তাহলে সমাজে উঠে গিয়ে বাইরে বাসা ভাড়া নিয়ে স্বামীর সাথে থাকবেন। তাহলে যৌনপল্লীর ভিতরে নির্বাচন করে আপনি কী করবেন?
– আমি বাইরে যাবো না আপা। বাইরে তার পরিবার আছে, তার সমাজে একটা মান সন্মান আছে। তাছাড়া আমি ছোডবেলা থাইকাই এখানে আছি। আমি বাইরে গিয়া থাকতে পারবো না। আমি এইখানে থাইকা এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই, তাগোর অধিকার আদায়ে কাজ করতে চাই।
ঝানু নেতার মত করে বলে জোছনা।
– গত দুই বছরে কতজন ছুকরী এসেছে এই ব্রোথেলে?
– খুবই কম আপা, আগের বছরের থেকে অনেক কম। ও তিতলী আপা, সুরমা আপারে রিপোর্ট দেখান নাই? এখন বাইর কইরা দেখান। পুলিশের খাতার হিসাব আর আমাগো হিসাব একদম এক। কোন হেরফের নাই।
– হিসাবের বাইরে কোন মেয়ে ঢোকার সুযোগ নাই?
– আমার চোখরে ফাঁকি দিয়া এমুন কাম করবো, কারও সাহস নাই। আমার আমলে তেমুন কিছুই হয় নাই। আল্লাহর কসম, খোদার কসম কইরা কইতাছি। আমার উপরে ভরসা করতে পারেন আপা। মাইয়াগো জিগাইয়া দেখেন তারা কোন নেত্রীরে চায়। জোছনার নাম ছাড়া কারও মুখে কোন কথা নাই।
– ভোটের দিন গণ্ডগোল হওয়ার কোন আশংকা আছে?
– কি যে কন আপা! একদম না । আমি আর আমার সাহেব সব ঠিক কইরা রাখছি। কেউ টু শব্দ করার সাহস পাবে না।
– কী ঠিক করে রেখেছেন?
– আপা লোকজন ঠিক করা আছে। নির্বাচনী নীতিমালায় যা যা লেখা আছে ঠিক সেইভাবেই সবকিছু হইবো। আমি রেকর্ড কইরা দেখায়া দিবো আমরা পাড়ার মাইয়ারা কত ভালো করে নির্বাচন করতে পারি।
– ঠিক আছে জোছনা আপা। শুভকামনা আপনার জন্য।
জোছনা চলে গেলে সকলে অফিস রুমেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয়। বাকি ১৯ জনের সাথে কথা বলতে ৫টা বেজে গেল। সবকিছু গুছিয়ে ব্রোথেল থেকে বের হবে এমন সময় শাহেদ সাহেবের ফোন। উনি আরেকটি এনজিওর ডিরেক্টর, ওনাদের প্রোজেক্ট অফিসও এই যৌনপল্লীর ভিতরেই। উনি জানালেন এখানে যেই সংস্থাওগুলো কাজ করছে তারা আজ সন্ধ্যা সাতটায় মিটিং এ বসবে। সুরমা অবাক হয়ে বলে, ‘‘মিটিংটা তো কাল হবার কথা।” শাহেদ ভাই জানালেন মিটিংটা জরুরি ভিত্তিতে আজই করতে হচ্ছে কিছু উদ্ভুত বিষয়ের কারনে। উনি মেসেজে ভেন্যু জানিয়ে দিবেন। সুরমা সম্মতি দিয়ে ফোন রাখতেই সহযোগী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক হুমায়ূন ভাই ফোন দেন। উনিও একই কথা বলেন এবং যেহেতু উনি শহরের বাইরে তাই উনাদের ডিরেক্টর প্রোগ্রাম আজাদ ভাই থাকবেন। গাড়িতে উঠতেই শহরের একটি চাইনিজ রেস্টুরেন্টের ঠিকানা আসে ফোনে, শাহেদ ভাই পাঠিয়েছে। রুমে এসে ব্যাল্কুনির দরজাটা খুলতেই এক ঝলক বাতাসের স্পর্শ সুরমার সমস্ত ক্লান্তি দূর করে দেয়। সে চুলের পাঞ্চক্লিপটা খুলে দেয়। এলোমেলো বাতাসে শাড়ির আঁচল উড়তে থাকে, সেই সাথে ওড়ে তার কোমর সমান চুল। সুরমা হঠাৎ গুনগুন করে ওঠে-
“এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ীর আঁচল,
কখন যেনো মেখে দিয়েছে, এই দু’চোখে ভালবাসার কাজল।
জানিনা কখন হারিয়েছি মন
হারিয়ে ফেলেছি আমাকে ।।
এমন হয় না কি শুধু ভালবাসবে
দেখা না পেলে হয় দু’চোখ সজল
এলোমেলো বাতাসে উড়িয়েছি শাড়ীর আঁচল,
কখন যেনো মেখে দিয়েছে এই দু’চোখে ভালবাসার কাজল।”
মিটিংটা শুরু হতে হতে সাড়ে সাতটা। সুরমা, টুটুল দুজনেই গেছে। এনজিওরা ছাড়াও দুইজন সাংবাদিক ছিলেন। জরুরি ভিত্তিতে মিটিংয়ের মূল কারন “আজমল হুদা ও হোসেন ভাই” মারমুখী অবস্থানে আছে। তারা দুজনেই নিজেদের প্রার্থীকে জেতানোর জন্য মরিয়া, যৌনপল্লীকে ঘিরে আজমল হুদার কোটি টাকার নারী পাচারের ব্যাবসা আর হোসেন ভাইএর মাদকের ব্যাবসা। জোছনা সুরমাকে যেই সিডি দিয়েছিল, সেই একই সিডি এখানকার সবার হাতে। শাহেদ ভাই ল্যাপটপে প্লে করে দেখালেন। একজন হুজুর সাথে দুই জন পুরুষ ও তিন জন নারীর উপস্থিতিতে আজমল হুদা বিয়ে করেছে জোছনাকে। আকদে যা যা হয় সেভাবেই দেখানো হয়েছে। সকলে নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন। কোন একটা ঝামেলা হলেই উচ্ছেদের মুখে পড়বে যৌনপল্লীটি। মিটিংয়ে কিছু সিদ্ধান্ত হয়। সেই মোতাবেক ওখানে বসেই তারা এস পি সাহেবকে একটা স্মারকলিপি লিখে ফেলে। ওসি সাহেবের সাথেও ফোনে কথা বলে নেন। রাতের খাবার শেষে যে যার বাসায় ফিরে যায়। সুরমা রুমে ফিরে অফিসের লাইন ম্যানেজারকে পুরোটা জানায়। সিকিউরিটি ফোকাল পারসনের সাথে আলোচনা করে সুরমা আর টুটুলকে ইমেইল করে জানানো হয় যে যদি নিরাপদ মনে না করে তবে নির্বাচনের দিন তারা যেন ব্রোথেলের ভিতরে না যায়। কর্মীদের নিরাপত্তাই সংস্থার কাছে সবার আগে।
পরেরদিন বুধবার কাটে একটার পর একটা মিটিংয়ে। ভিজিল্যান্ট টিমের সাথে মিটিং, ওসি সাহেবের অফিসে গিয়ে কথা বলা, নির্বাচন কমিশনার দুজনের অফিসে গিয়ে দেখা করে রেস্টুরেন্টেই দুপুরের খাবার খেয়ে নেয় সুরমা আর টুটুল। যৌনপল্লীতে ঢুকতে তিনটা বেজে যায়। শেষ মুহুর্তে এডহক কমিটির সাথে শেষ প্রস্তুতি নিয়ে কথা বলে ভোটের বুথ দেখে নিলো। বুথটা করা হয়েছে পাশেই একটা এনজিও অফিসে। ব্যালট বাক্স, ব্যালট পেপার, সিলমোহর সব ঠিকমত আছে। উৎসব উৎসব লাগছে। বাংলাদেশের মানুষ খুব নির্বাচনপ্রিয়। ভোট ঘিরে যে হই হুল্লোর, মিটিং মিছিল, উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সবই এখানে আছে। সুরমার কাছে সাধারণ নির্বাচনের মতই মনে হচ্ছে। স্থানীয় পত্রিকায় বেশ ফলাও করে আজ প্রতিবেদন বেরিয়েছে। প্রস্তুতি বেশ ভালো দেখে কিছুটা ফুরফুরে মেজাজে সুরমা আর টুটুল হোটেলে ফেরে। রাত সাড়ে আটটায় ডিনার করবে, টুটুলকে জানিয়ে দেয়।
গোসল করেই একটা ঘুম দেয় সুরমা। আটটায় ঘুম ভাঙ্গে ইন্টারকমের রিংয়ে। রিসিপশন থেকে জানায়, ‘‘ম্যাডাম, আপনার একজন গেস্ট এসেছে। উনার নাম আজমল হুদা, সরকারি টিটি কলেজের প্রফেসর।” সুরমা ধড়মড় করে উঠে বসে বলে, “স্যরি বুঝিনি, কে এসেছে?”
– আজমল হুদা স্যার, সরকারি টিটি কলেজের প্রফেসর
– কিন্তু আমি তো এই নামে কাউকে চিনি না
– উনি বলেছেন উনি আপনার সাথে দেখা করতে চান
সুরমা বুঝতে পারছে না সে কী বলবে। তবুও বলে একটু পরে জানাচ্ছি। সে প্রথমে তার ম্যানেজারকে জানায়। উনার পরামর্শ অনুসারে ওসি সাহেবকে জানায়। ওসি সাহেব বললেন, “আপনি দেখা করেন, আমি কাছেই থাকবো, আর হোটেলেও আমি জানিয়ে দিচ্ছি।” সুরমা টুটুলকেও নিচে যেতে বলে ফ্রেশ হয়ে ঝটপট শাড়ি পরে ফেলে। অফিসের কাজে শাড়িতেই সে স্বচ্ছন্দ। হোটেলের লবিতে সুরমাকে দেখে প্রফেসর সাহেব উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দেয়। একজন সরকারি কলেজের অধ্যাপককে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিতে দেখে সুরমা একটু অস্বস্তি বোধ করে। সাথে সাথেই নিজের মনকে সতর্ক করিয়ে দেয়- সে একজন নারী পাচারকারী। তারা মুখোমুখি সোফায় বসে। বিয়ের ভিডিওতে যতটা বিদ্ঘুটে মনে হয়েছিল, এখন ততটা মনে হচ্ছে না। লোকটি হাসিমুখে সুরমার চোখের দিকে সরাসরি তাকিয়ে কথা শুরু করে।
– ম্যাডাম, আমি আজমল হুদা, সরকারি টিটি কলেজের প্রফেসর। আপনি অবাক হচ্ছেন বুঝতে পারছি। আপনার অনেক কথা শুনেছি তাই পরিচিত হতে এলাম।
– আমি দুঃখিত, আপনাকে চিনতে পারছি না। আর আমার কথা কোথায় শুনেছেন, কী শুনেছেন তাও জানিনা। আপনার হয়তো কোথাও ভুল হচ্ছে।
সুরমার বিনীত উত্তর।
তিনি আরো বিস্তৃত হেসে বললেন, “জোছনার নির্বাচনী প্রচারণায় আমার নাম আছে, বিয়ের ভিডিওতে যাকে দেখেছেন সে-ই আমি। আশা করি এখন বুঝতে পারছেন।
– ও আচ্ছা। সেটা না হয় বুঝলাম, কিন্তু আমার কাছে কেন?
প্রশ্নটা করেই সুরমা লোকটির পাশ দিয়ে সামনের দিকে তাকিয়ে দেখে ওসি সাহেব তাদের উলটা দিকে আরো সামনে গিয়ে একটা থুজা গাছের আড়ালে বসলেন।
– আপনি এত ভালো বিষয়ে পড়াশোনা করা মানুষ, ভালো চাকরি করবেন, এইসব আপনার কাজ না। এইসব ছোটলোকের কাজ। এসবে অনেক স্থানীয় বিষয় জড়িত থাকে। সেসবে অনেক রিস্কও থাকে। তাই বলছিলাম এসবে না জড়ানোই ভালো। ম্যাডাম আপনি আজ রাতেই ঢাকায় চলে যান। আমার মনে হয় আপনার আগামীকাল এখানে থাকার দরকার নেই।
– আপনি কি এই কথা বলার জন্যই এসেছেন? কথা শেষ হয়েছে? তাহলে আপনি আসতে পারেন।
সুরমার কথা শেষ হতেই টুটুল কফি পাঠিয়ে দেয়।
আজমল সাহেব হেসে বলেন, ‘‘আমি যদিও এই কথাটাই বলতে এসেছি কিন্তু আমি আরো কিছুক্ষণ আপনার সাথে থাকতে চাই, আপনার সাথে কথা বলতে ভালো লাগছে। অন্তত কফিটা তো শেষ করি। সেই সাথে আনুষঙ্গিক আরো কিছু কথা বলি।’’
– এই যৌনপল্লীতে অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে কিছু আন্তর্জাতিক সংস্থার সহায়তায়। জাতিসংঘেরও ফান্ড আছে। কিন্তু অন্য কাউকে কিছু না বলে আমাকে চলে যেতে বলছেন কেন?
আজমল কফিতে চুমুক দিয়ে বলেন, তার একটা কারণ আছে। অন্য প্রজেক্টগুলো সার্ভিস দেয়, কিন্তু আপনারা অধিকার শেখান, দেশের আইন শেখান, ছুকরী কিনতে নিষেধ করেন সেখানেই আমার সমস্যা। আপনাদের ফান্ড কম হলেও শক্তি বেশি। দেখেন আমি চাই জোছনা এবারো ভোটে জিতে নেত্রী হবে। শুধু এবার নয় এর পরে আরো ৪-৫ বছর তাকে সভানেত্রী পদে থাকতে হবে।
– সেটা সম্ভব নয়। ওদের সংগঠনের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী একজন জীবদ্দশায় ২ বারের বেশি পদে থাকতে পারবে না।
এইবার আজমল হা হা করে হেসে ওঠে। বলে, “দেশের বড় রাজনৈতিক দলগুলোতে একজনই আজীবন দলের চেয়ারম্যান থাকেন, নির্বাচনে অংশগ্রহন করেন এবং একই ব্যাক্তি পরপর নির্বাচিত হতেই থাকেন। আর এইটা যৌনকর্মীদের একটা সংগঠন! ফুঃ!”
সুরমার এবার খুব রাগ হয়। তবুও শান্তমুখে বলে, “এটাতো রাজনৈতিক দল নয়, সেলফ-হেল্প গ্রুপ। দুটোর ধরণ আলাদা।“
– আরে রাখেন আপনার আলাদা, এই দেশের এনজিওগুলোতেও একই ব্যাক্তি বছরের পর বছর প্রধাণ হয়ে বসে থাকে। আর আপনি আমাকে সেলফ-হেল্প গ্রুপ শেখাচ্ছেন। আজমল সাহেবের চড়া গলা শুনে আশেপাশের লোকজন ফিরে তাকায়। সুরমা কিছুটা বিব্রত বোধ করে। শান্ত গলায় বলে, “সেলফ-হেল্প গ্রুপ ও এনজিও এক নয়। সেলফ-হেল্প গ্রুপ নিজেরা নিজেদের জন্য কাজ করবে। এদের মূল লক্ষ্য নিজেদের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা।”
– সেখানেই তো আমার সমস্যা। তাছাড়া এখন আন্তর্জাতিক সংস্থারা সেলফ-হেল্প গ্রুপগুলোকে এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন করতে বলছে কেন?
– কেউ কেউ দায়ে পড়ে বলছে কারণ সরকারি নিয়ম অনুসারে এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন ছাড়া কেউ বিদেশি অনুদান গ্রহণ করতে পারবে না। আর কেউ কেউ সেলফ-হেল্প গ্রুপ কী সেটা না বুঝেই এনজিও ব্যুরোর রেজিস্ট্রেশন করতে বলছে। সেলফ-হেল্প গ্রুপ নিজেদের অধিকার বুঝবে, প্রয়োজনে নিজেদের অর্থ নিজেরাই দেবে।
– আমি সরকারি কলেজে পড়াই, আমাকে জ্ঞান দিতে আসবেন না। আপনাকে সোজা ঢাকায় চলে যেতে বলেছি, ঢাকায় যাবেন।
উত্তেজিত হয়েিআজমল উঠে দাঁড়ায়। সুরমাও দাঁতে দাঁত চেপে উঠে দাঁড়ায়। ঠিক তখনই ওসি সাহেব তাদের সামনে আসতে থাকে। আজমল সাহেব নিজেকে সামলে নিয়ে হেসে ওসি সাহেবকে সালাম দিয়ে বলে, “সুরমা ম্যাডাম এত সুন্দর করে কথা বলে ভাবলাম উনার সাথে এককাপ কফি খেয়ে যাই।” সুরমার দিকে তাকিয়ে “আসি ম্যাডাম, কোন দরকার হলে জানাবেন। ভালো থাকবেন।”
সুরমা টুটুল আর ওসি সাহেবকে জানায় আজমল সাহেবের সাথে কী কথা হল সেসব। ওসি সাহেব বললেন, ‘‘রাতে এখানে আমাদের লোক থাকবে, আর যে কোন সমস্যা হলে আমাকে ফোন দেবেন।” উনি চলে গেলে সুরমা আর টুটুল ডিনারে বসে। সুরমা চটপট মোবাইল থেকেই কয়েকটা মেসেজ করে অফিসে। অফিস থেকে নির্দেশনা- পরিস্থিতি যদি এমন থাকে কাল হোটেল থেকে তারা বের হবে না নির্বাচন চলাকালীন সময়ে। সুরমা-টুটুলের মন খারাপ হয়ে যায়, এতো সুন্দর আয়োজন, চোখে দেখতে পারবে না তাই।
রাত তিনটার দিকে টুটুলের ফোন মোবাইলে, “আপা, হোসেন ভাইকে পুলিশ বাসা থেকে ধরে নিয়ে গেছে। তার বাসায় অনেক ইয়াবা পাওয়া গেছে। আর সব মেয়েদের ঘরে টাকার প্যাকেট পৌঁছে গেছে। একেকটা প্যাকেটে ২০০০ করে টাকা আছে। তার মানে ৬ লাখের মত টাকা খরচ করে ফেলেছে জোছনার পক্ষে। শাহেদ ভাই জানালো। কাল কোন ঝামেলা হবে না আর, শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে।” অফিসকে মেসেজ দিয়ে রাখলো সুরমা, আপডেট জানিয়ে লিখলো পরিস্থিতি স্বাভাবিক থাকলে তারা ব্রোথেলে যাবে। বাকি রাতটা সুরমার ঘুম হলো না। কফির মগ হাতে ব্যালকনিতে বসে কাটালো।
সকাল ১০ টার আগেই সুরমা আর টুটুল যৌনপ্ললীতে পৌঁছালো। নির্বাচন কমিশনাররা এসে গেছেন, ভিজিল্যান্ট টিমের অন্য সদস্যরা এসে গেছেন, এসেছেন কয়েকজন সাংবাদিক, টিভি ক্যামেরা। যথাসময়ে ভোটগ্রহণ সম্পন্ন হল। কোন কারচুপি হয়নি। একটা আদর্শ নির্বাচনে যা যা হয় তার সবই হল। জোছনা নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে টানা দ্বিতীয়বারের মত সভানেত্রী নির্বাচিত হল। জোছনা সুরমার কাছে এসে পায়ে ধরে সালাম করে বললো, “আপা কইছিলাম না, নির্বাচনী নীতিমালায় যা যা লেখা আছে তার সব ঠিকঠাক মত পালন করব। আলহামদুলিল্লাহ সব পারছি গো আপা। আপনার মান রাখতে পারছি।”
সুরমা তাকে অভিনন্দন জানায়।
দুপুরের পরে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণ, দায়িত্ব গ্রহণ, করতালি, বিজয় মিছিল, মিষ্টিমুখ হলো। জোছনা ব্যস্ত সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তর দিতে।
সুরমা আর টুটুল বেরিয়ে হোটেলে আসে। সবকিছু গুছিয়ে চেক-আউট করে ঢাকার পথে রওয়ানা দেয়। সারাটা মন জুড়ে একটা পরাজয়ের গ্লানি মেখে রাত ৯টায় বাসায় পৌঁছে সুরমা।
[চলবে]
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে
শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?