পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর ষোলতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
লুইস বুজোয়া (Louise Bourgeois)
(১৯১১-২০১০)
১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে শিল্প জগৎ নারী শিল্পীদের জন্যে উন্মুক্ত হতে শুরু করে। আর তখন যেসব নারী ব্যাপক (যদিও বিলম্বিত) সাফল্য লাভ করেন লুইস বুজোয়া তাঁদের অন্যতম। ঝড়তি পড়তি স্থাপত্যগত নানান জিনিস, কুড়িয়ে পাওয়া বস্তু আর ভাস্কর্যগত নানান জিনিস-পত্তরের সাহায্যে তিনি যে ধারাবাহিক কিছু ইন্সটলেশন তৈরি করেন Cell (Eyes + Mirrors) সেগুলোরই একটি। স্পেসটির ভেতর আমরা কেবল দৃশ্যগতভাবেই প্রবেশ করতে পারি, আমাদের চোখ ব্যবহার ক’রে। অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই কালো মর্মর পাথরের চোখগুলো আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকে, যেন আমাদের তাকানোর জবাব দিতে। আমাদের চ্যালেঞ্জ করে তারা। অন্য দিকে আমাদের নিজেদের স্থিরদৃষ্টি কুঠুরিটির ভেতরে রাখা অসংখ্য আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে অনিশ্চিত এবং খণ্ডকৃত রূপ ধারণ করে। এই কুঠুরিটি কি কোনো আশ্রয়স্থল নাকি কারাগার?
বুজোয়ার কাজে সব সময় একটা টেনশন বা একটা টানাপোড়েন কাজ করে। এখানে সেটা সৃষ্টি হয়েছে আমাদের ঈক্ষণকামুক (voyeuristic) স্থিরদৃষ্টি এবং কোন আশ্রয় বা কোন নিষ্কৃতির অবকাশ না-দেয়া একটি কামরার দেয়ালগুলো তৈরি করার জন্য ব্যবহৃত তারগুলোর কারণে। বুজোয়ার ভাষায়, “যন্ত্রণার বিষয়টিই আমার কাজের জায়গা। আমার কাজ হতাশা এবং যন্ত্রণা বা দুর্ভোগের একটা মানে আর আকার বা কাঠামো দেয়া।… কুঠুরিগুলো বিভিন্ন ধরণের যন্ত্রণার প্রতিনিধিত্ব করে: শারীরিক, আবেগগত এবং মনস্তাত্ত্বিক, আর সেই সঙ্গে মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিগত।”
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Cell (Eyes + Mirrors) ১৯৮৯-৯৩
ইস্পাত, চুনাপাথর, আর কাচ
২৩৬ X ২১১ X ২১৮
জোয়ান জোনাস (Joan Jonas)
(জন্ম ১৯৩৬)
Organic Honey’s Visual Telepathy নামের বিশেষ মেজাজ বা প্রতিবেশ সৃষ্টিকারী (atmospheric) সাদা-কালো ছবিতে জোয়ান জোনাস ও তাঁর নিজেরই ভিন্ন সত্তা অর্গানিক হানি বা জৈব মধু ক্যামেরার সামনে পারফর্ম করেন। তাঁদের শরীর সুগন্ধিত, আর আয়নায় প্রতিফলিত, এবং তাঁর নিজের ভিন্ন সত্তার মতো জোয়ান জোনাসের-ও দেহ প্রপ্স বা অভিনয়ে সাহায্যকারী নানান জিনিস শোভিত, আর সেসব প্রপ্স তাঁর ছদ্মাবরণের কাজও করছে। সেই প্রপ্সের মধ্যে আছে ব্যক্তিগত, ঘরোয়া সাজসজ্জায় ব্যবহৃত নানা অলংকার আর পালকের একটা জাঁকালো মুকুট। নিজের পারফরমেন্সের ভিডিও ক্যামেরা ফুটেজ ব্যবহার ক’রে জোনাস তাঁর ছবিটি নির্মাণ করেছিলেন। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, “নারীবাদের সঙ্গে আমার সম্পর্ক ব্যক্ত করার একটি কাব্যিক ধরনের ওপর ভিত্তি ক’রে Organic Honey’s Visual Telepathy তৈরি করা হয়েছে। ফিমেল আর্ট, ফিমেল ইমেজারি ইত্যাদির মতো কিছু হতে পারে কিনা সেটার একটা অনুসন্ধান এই ছবিটির মধ্যে রয়েছে।”
ভিডিওর প্রথম দিককার গুণগ্রাহী এবং প্রচারকদের মধ্যে জোনাস একজন। পুরুষদের যে-আধিপত্য পেইন্টিং এবং ভাস্কর্যের মতো সনাতন শিল্পমাধ্যমে রয়েছে এই নতুন শিল্প মাধ্যমটিতে সেই আধিপত্যের অভাব থাকার ব্যাপারটা তিনি উপভোগ করতেন। জোনাস ১৯৭০ সালে তাঁর প্রথম ক্যামেরা কেনেন এবং নিজের চিলেকোঠায় বসে ‘একটা ক্লোযড-সার্কিট পরিবেশে’ কাজ করতে তিনি ভীষণ আনন্দ পেতেন, যেহেতু সেখানে একান্তে এবং মাইনে দিয়ে রাখা সহকারী বা ক্রু ছাড়াই কাজ করা যেত।
লন্ডনের টেট মডার্ন গ্যালারিতে ২০১৮ সালে জোনাসের যে রেট্রসপেক্টিভ অনুষ্ঠিত হয় সেখানে দেখা যায় Organic Honey’s Visual Telepathy-তে তিনি যেসব বিষয় নিয়ে কাজ করেছিলেন তখনো সেসব বিষয়ে তাঁর আগ্রহ বজায় রয়েছে- যেমন মাস্কের ব্যবহার, এবং নড়াচড়ার মধ্যে স্ট্যাটিক মোটিফের ব্যবহার।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Organic Honey’s Visual Telepathy ১৯৭২
মাল্টিমিডিয়া রেকর্ডিং : সিঙ্গেল-চ্যানেল ভিডিও, সাদা-কালো, শব্দ
১৭ মিনিটি ২৪ সেকেন্ড
(চলবে)
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত
পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান
পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী
পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ