পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর একাদশ পর্ব।।
অন্যান্য যৌনপল্লীর মত বানিয়াশান্তাতেও একটি যৌনকর্মী সংগঠন আছে, সংগঠনটি সরকারের মহিলা ও শিশু বিষয়ক অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত। সুরমা টিম নিয়ে যৌনপল্লী থেকে বের হতে যাবে এমন সময় সংগঠনটির সভানেত্রী রহিমা আপা একটা ব্যাগ হাতে এসে দাঁড়ালো, “আপা, গাড়ী আছে সাথে? খুলনা পর্যন্ত আপনাগে সাথে যাইতে চাই। রাইতের গাড়িতে ঢাকা যাবানে। কাল নেটওয়ার্কের (সেক্স ওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশ) নির্বাহী কমিটির মিটিং, আমি কমিটিতে আছি আপা।” সুরমা হেসে ইতিবাচক মাথা নাড়লো। সকলে একসাথে একই জালি নৌকাতে ফিরে এলো মংলাতে। সারোয়ার আর সাথের দু’জন বিদায় নিলো। স্টেফি, রুবেল সুরমা আর রহিমা একই গাড়িতে ফিরছে খুলনার দিকে। স্টেফি টুকটাক কথাবার্তা আর প্রশ্ন করছে। এক সময় রহিমার কাছে জানতে চাইলো, ‘‘তুমি কতদিন ধরে সেক্স ওয়ার্কারস নেটওয়ার্ক, বাংলাদেশের নির্বাহী কমিটিতে আছো?’’
– একটা কমিটি ২ বছরের জন্য নির্বাচিত হয়, বর্তমান কমিটি এক বছর হইল নির্বাচিত হইছে।
– তুমি যে রাতের গাড়িতে ঢাকা যাবে, তোমার কোন সমস্যা হবে না?
– আমাগে কোন সমস্যা নাই। আমি এই রাস্তায় কত বছর ধইরা যাতায়াত করি। কাউন্টারের লোকজন আমারে চিনে। তাগের আমি বেয়াই কই। একসাথে পান-জর্দা খাই।
– তারা তোমাকে রাস্তার সমস্যা করে না?
– না। কখনো করেনি। আমাগে দালাল, পরিচিত লোকজনের মাধ্যমেই চিনপরিচয়। সমস্যা হয় না। তয় দু’এক সময় প্যাসেনজারগের কেউ কেউ বুজদি পারে, ইশারা ইঙ্গিত দেয়। তখন বাসের কন্ডাক্টাররে বললি পরে সে সামাল দেয়।
শহরে রহিমা নেমে যায়। সুরমারা হোটেলে পৌঁছে। সারাদিনের ক্লান্তিতে যে যার রুমে ফ্রেশ হয়ে রেস্ট নেয়।
রাতের খাবার শেষে কফির অর্ডার দিয়ে সুরমা আর স্টেফি হোটেলের লনে আসে। ডিম ল্যাম্পশেডের আলোতে চারপাশে ফুল ঘেরা সাদা টেবিল চেয়ারগুলোকে ক্যালেন্ডারের ছবির মত মনে হয়। বাতাসে এখনো শীত ভাবটা আছে। দু’জনেই গায়ের শালটা টেনে নিয়ে মুখোমুখি চেয়ারে বসে। কিছুক্ষনের মধ্যে কফি এসে যায়। টুকটাক কথাবার্তার পরে স্টেফি সুরমাকে জিজ্ঞেস করে, ‘‘মেয়েরা যে মুদির দোকান, চিংড়ির ঘের, দিনমজুর এমন বিকল্প পেশার কথা বলছে, সে ব্যাপারে তোমরা কি জানো?’’
– যৌনকর্মীদের নিয়ে প্রায় ৩০ বছর ধরে এনজিওরা কাজ করছে বাংলাদেশে। এই কাজগুলো মূলত যৌনপল্লী উচ্ছেদ বন্ধ এবং এইচ আই ভি ও এইডস প্রতিরোধ কর্মসূচি। এই বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে গিয়ে সময়ের সাথে অভিজ্ঞতা ও গবেষণার ভিত্তিতে তাদের অধিকার, স্বাস্থ্য, পেশার স্বীকৃতি, পাচার রোধ, সন্তানদের শিক্ষা বিভিন্ন বিষয় শুরু হয়েছে। যৌনকর্মীরা যে “মানুষ” এই অনুভূতি তারা এনজিওদের কাছ থেকে পেয়েছে। দাতব্য চিন্তাভাবনায় শুরু করা উন্নয়নকাজ পরে কল্যাণমূলক ভাবে বর্ধিত হতে থাকে। আর এখন অধিকারভিত্তিক কাজে রূপান্তরিত হয়েছে। স্যান্ডেল পায়ে দেওয়ার অধিকার, পল্লীর বাইরে যাওয়ার অধিকার ফিরে পেয়েছে এদের কারনেই। আজ তারা সরকারি অফিসে যেতে পারছে, অন্য মানুষের পাশে চেয়ারে বসতে পারছে, নিজেদের অধিকার বোঝার চেষ্টা করছে, দাবি করছে, এদের প্রতিনিধিরা সরকারের নীতি নির্ধারনী পর্যায়ের মিটিংয়ে যেতে পারছে। এগুলো সবই লম্বা সময় ধরে এনজিওদের কর্মকান্ডের ফলাফল। কিন্তু যৌনকর্মীদের লাইভলিহুড বা জীবিকা নিয়ে কোন বড় ইনিশিয়েটিভ নেওয়া হয়নি। সাধারনতঃ সরকারি বেসরকারি সেবার সাথে যৌনকর্মীদের যোগাযোগ করে দেওয়া এবং সেই সেবাটি যেন তারা নিতে পারে সেই চেষ্টা এনজিওরা করেছে। তবে বিভিন্ন প্রকল্পের অধীনে পরীক্ষামূলকভাবে অন্য পেশার সাথে যুক্ত করার কিছু কাজ করার চেষ্টা হয়েছে। ঠিক বিকল্প পেশা নয় বরং এক্সটেন্ডেড পেশা হিসাবে করতে পারে কিনা দেখার জন্য। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা নেই, দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেই, ইন্ডেপ্থ মার্কেট অ্যানালাইসিস, নিড অ্যাসেসমেন্ট, রিস্ক অ্যাসেসমেন্ট, কাউন্সেলিং সাপোর্ট ছাড়াই কিছু কিছু বিষয়ে ট্রেনিং দিয়ে আরেকটি পেশার সাথে যুক্ত করার চেষ্টার ফলাফল আশাব্যাঞ্জক না। কিন্তু এই ব্যর্থতাগুলো থেকে অনেক লার্নিং বেড়িয়ে এসেছে। যেমন যৌনপেশার চেয়ে দিনমজুর বা চিংড়ির ঘেরে কায়িক পরিশ্রম বেশি। সেজন্য যৌনকর্মীদের প্রস্তুতি থাকে না, দিন হিসাবে যৌনপেশায় আয় অনেক বেশি (দিন হিসাবে ব্যয়ও বেশি)। কাজের জায়গায় সহকর্মী ও আশেপাশের লোকজনদের প্রস্তুতি নেই। তাদের দৃষ্টিভঙ্গি নেতিবাচক, তারা সহকর্মী না ভেবে যৌনকর্মীই ভাবে। ফলে বিভিন্ন ধরনের অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটতে থাকে। আবার যৌনপেশায় মেয়েদের এক ধরনের শারীরিক মানসিক অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে যায়। ফলে পুরুষের প্রতি তার দৃষ্টিভঙ্গি অন্যরকম থাকে, সেটিও বদলানো সহজ নয়। যেহেতু যৌনকর্মীরা একটি দুষ্টচক্রের শিকার তাই অনেক বিষয় এসবের সাথে জড়িত। সবচেয়ে বড় বিষয় হল এরা নিজেরা বিকল্প পেশার কথা আদৌ ভাবে কিনা, নাকি উন্নয়ন সংস্থার শেখানো বুলি আওরায়। এরা একাধারে মনে করে যৌনপেশা কোন সন্মানজনক পেশা নয়। কাজেই সমাজে উঠে গিয়ে একটি সম্মানজনক জীবনযাপন করার স্বপ্ন লালন করে প্রত্যেকে এবং চেষ্টা করতে থাকে, প্রতারিত হয় তবুও। আবার এরাই পেশার স্বীকৃতির জন্য, শ্রমিকের অধিকারের জন্য আন্দোলন করে। এইক্ষেত্রে যখন যে উন্নয়ন ধারণা (ডেভলপমেন্ট কনসেপ্ট) আসে, আমরা সেটাই শেখাই, তারাও সেটাই বলার চেষ্টা করে। উপরতলার লোকজন খুব সহজেই পূনর্বাসনের কথা বলে কিন্তু তার কোন সুনির্দিষ্ট দিকনির্দেশনা নাই। আমরা কাজ করতে গিয়ে দেখেছি বিষয়টি অনেক কঠিন। অর্থনৈতিক পূনর্বাসন তবুও কিছুটা আগানো যায় কিন্তু সামাজিক পূনর্বাসন খুবই কঠিন। কাজেই যৌনপেশার প্রেক্ষিত, পেশার স্বীকৃতি, পুনর্বাসন, বিকল্প পেশা এগুলো একে অপরের সাথে সাংঘর্ষিক। ফলে বিকল্প পেশার কথা না ভেবে বরং নতুন করে যেন এই পেশার সাথে মেয়েরা যুক্ত না হয় সেই পুলফ্যাক্টর ও পুশফ্যাক্টরগুলো নিয়ে কাজ করা এনজিওদের জন্য তুলনামূলক সহজ। একই সাথে পরের প্রজন্ম অর্থাৎ যৌনকর্মীর মেয়ে যেন যৌনকর্মী না হয়ে পড়াশোনা শিখে নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে সেটা নিয়েও কাজ করা শুরু হয়েছে। তবে আজকাল যৌনকর্মীরা পিয়ার এডুকেটর হয়ে চাকরি করতে চায়, এনজিওতে চাকরি করতে চায়।
স্টেফি বিষয়গুলো নিয়ে সরকারি নীতি নির্ধায়ক পর্যায়ের লোকজনদের সাথে কথা বলবে ভাবে। তবে তার আগে যৌনকর্মীদের ধারনাটা আরো বেশি করে বোঝা দরকার। কফি শেষ করে তারা উঠে পড়ে। পরদিন সকাল আটটায় নাস্তা সেরে বেড়িয়ে পড়বে, কাল যাবে ফুলতলা ব্রোথেলে।
ফুলতলা যৌনপল্লীতে যাবার জন্য রওয়ানা হলো। গাড়িতে সুরমা স্টেফিকে একটা ব্রিফিং দিলো। “ফুলতলা যৌনপল্লী খুলনা জেলাতেই ফুলতলা বাজারের পাশে অবস্থিত। এর একেবারে পাশে বাসস্ট্যান্ড আছে। তবে ব্রোথেলটির কাছাকাছি কয়েকটি জুটমিল অবস্থিত। কাজেই এখানকার খদ্দেররা সাধারনত জুটমিল শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক এবং বাজারে আসা লোকজন। এটি খুবই ছোট একটি যৌনপল্লী। এর আয়তন ০.১৭ একর যার বর্তমান আনুমানিক মূল্য সাড়ে আটলাখ টাকা। এখানে ৭০টি ঘর আছে, ১৪ থেকে ৫০ বছর বয়সী ৬২ জন যৌনকর্মী আছে। ঘরগুলো ইটের তৈরি ও টিনের ছাউনি দেওয়া। এই জমির মালিক ৪ জন, যৌনকর্মীরা দিন চুক্তিতে ভাড়া নিয়ে থাকে। কোন কোন ঘরে টিভি আছে, কোনটাতে নেই। আসবাব ও টিভি থাকা না থাকা অনুসারে ঘরের ভাড়া কমবেশি হয়। টিভি থাকলে প্রতিরাতে ১৫০ টাকা, না থাকলে ১২০ টাকা হারে ভাড়া দিতে হয়। এর বাইরে বিদ্যুৎ, পানি, পায়খানা সবকিছুর জন্য আলাদা আলাদা ভাড়া দিতে হয় প্রতিদিনের জন্য। আগে বাড়ীওয়ালী এবং সর্দার্নীরা মিলে পুরো যৌনপল্লীটি নিয়ন্ত্রণ করতো। কিন্তু এখন ক্ষমতা অন্যের হাতে। যখন যেই রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় থাকে তাদের ক্ষমতাধর লোকজন আর স্থানীয় থানার পুলিশ মিলে পল্লীটাকে নিয়ন্ত্রণ করে। তারা উভয়পক্ষ মিলে একজন ক্যাশিয়ার নিয়োগ দিয়েছে। সে প্রত্যেক কাস্টমারের কাছ থেকে কমপক্ষে ৫০ টাকা নেয়। মেয়েরা যদি গন্ডগোল, মারামারি করে তাহলে প্রত্যেককে জরিমানা করে ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। যদি কোন মেয়ে জরিমানার টাকা দিতে না পারে তাহলে ক্যাশিয়ার তার ঘরে তালা দিয়ে দেয়। এখানেও নিবন্ধনপ্রাপ্ত একটি যৌনকর্মী সংগঠন আছে। (এই তথ্যগুলো ২০১৪ সালের গবেষণা অনুসারে)।
ওরা ব্রোথেলে পৌঁছালো সকাল সাড়ে ১০টায়। ঢোকার মুখে একটা জটলা নজরে পড়লো, কয়েকজন নারী পুরুষ ঝগড়া করছে। পাশ দিয়ে যাবার সময় সুরমা একবার তাদের দিকে চেয়ে দেখলো। কে যে কার সাথে ঝগড়া করছে বোঝা গেলো না, কিন্তু প্রচন্ড গালিগালাজ শোনা যাচ্ছে। সুরমার ফিরে তাকানো দেখে স্টেফি জানতে চাইলো, “ওরা কি বলছে?”
– ওরা ঝগড়া করছে, গালাগালি করছে। তাতে “চ” বর্গীয় গালিটির ছড়াছড়ি। অদ্ভুত ব্যাপার হল, নারী এবং পুরুষ উভয় কণ্ঠেই একই গালি শোনা যাচ্ছে, তারা একইভাবে “চ” বর্গীয় গালিটি ব্যবহার করছে এবং একইভাবে “খানকি, বেশ্যা, মাগী” এই গালিও ব্যাবহার করছে। নারী পুরুষভেদে গালিগুলোর ব্যবহার অভিন্ন। এই প্রতিটি গালি শুধু নারীকেই দেওয়া হয়। যেমন “চ” বর্গীয় গালিটির ক্ষেত্রে নারী পুরুষ যখন ঝগড়া করে বলে “তোকে ……, তোর মাকে…, তোর বোনকে…”, এমনকি দুজন পুরুষও যখন ঝগড়া করে তখনো এইরকম বলে “তোর মাকে…, তোর বোনকে…”,। কখনো কোন নারী এমন বলে না “তোর বাপকে……, তোর ভাইকে……” । কেন? এর পিছনের মনস্তত্ত্বটা কী আসলে? নারী-পুরুষের শারীরিক সম্পর্কে কি তবে পুরুষকে অ্যাকটিভ আর নারীকে প্যাসিভ বোঝানো হয়?
স্টেফি স্মিত হেসে বলে, ‘‘সারা পৃথিবীতেই মনে হয় গালিগালাজে এই দৃশ্য কমবেশি এক। তবে দক্ষিন এশিয়ার দেশগুলোতে একইরকম। দেখ, ওরা যে গালিগুলো দিচ্ছে তার সবকটিতেই “ফিজিক্যাল ফোর্স” বিষয়টা কমন। যখন একজন গালি দিয়ে বলে “খানকির পোলা”, দৃশ্যকল্পের মধ্যে পুরুষ ফোর্স করছে অর্থাৎ নারীর জন্য নিচু এবং অসম্মানজনক কাজ বোঝাবে এবং ডোমিনেইট করাবে পুরুষকে দিয়েই। পুরুষরা সহজাতভাবেই এক্সট্রোভার্ট। শারীরিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে ফ্যান্টাসি তাদেরকে বেশি আনন্দ দেয়। সেই আনন্দ আরো বেশি হয় যখন ফ্যান্টাসির মধ্যে নিজের কর্তৃত্ব, নারীকে নিচু করে দেখানো যায়। এই অঞ্চলে সমাজের বেশিরভাগ পুরুষই নারীকে সেক্সুয়্যাল ইকুইপমেন্ট হিসাবে দেখে। কাজেই পুরুষের ফ্যান্টাসিতে বিবর্তিত হতে হতে নারীর নিজের আর কোন চয়েস থাকে না। এইসব গালিগুলো সেই মনস্তত্ত্বেরই প্রমাণ।’’
কথা বলতে বলতে ওরা প্রোজেক্ট অফিসে গিয়ে বসে। সারোয়ার আগেই এসেছে। সে দলীয় আলোচনার দল ঠিক করে রেখেছে পাশের ট্রেনিং রুমে। স্টেফি আর রুবেল সারোয়ারের সাথে পাশের রুমে গেল। সুরমা এই রুমে একা। ডায়েরি বের করে কাজগুলো ঠিক করে নিলো। প্যারামেডিক আপা তখন এলো। নিজেরা টুকটাক কথাবার্তা বলছে, এমন সময় দু’জন মেয়ে এসে ঢুকলো, একজন কাঁদছে, তার কান আর ঠোঁট কেটে রক্ত পড়ছে, আরেকজন তার হাত ধরা, প্রচণ্ড রেগে আছে। কাউন্সিলর আপা কিছু বলার আগেই রেগে থাকা মেয়েটি, নাম কাজল, চিৎকার করে হাছনা নামের এক মেয়েকে গালি দিয়ে বলল, ‘‘দেখেন আপা, হাছনা রেশমীর কি অবস্থা করছে?’’
– কীভাবে হল? প্যারামেডিকের প্রশ্ন
– হাছনা কামড়াইয়া রেশমীর কান আর ঠোঁট কাইটা ফেলছে।
প্যারামেডিক অভ্যস্ত হাতে রেশমীকে ড্রেসিং করিয়ে দিচ্ছে, সুরমা তাকিয়ে দেখছে। ১৮-১৯ বছরের বেশ সুন্দর দেখতে রেশমী মেয়েটি। কাঁদতে কাঁদতে চোখমুখ ফুলিয়ে ফেলেছে। ইস কীভাবে কামড়ে দিয়েছে! এমন সময় হাছনা এসে হাজির, দরজায় এসেই কাজলকে গালাগালি শুরু করলো। কাজলও গিয়ে হাছনাকে মারতে লাগলো, “তোর এতবড় সাহস তুই রেশমীর রক্ত বাইর করছোস?” চেঁচামেচিতে সারোয়ার বের হয়ে এসে দু’জনকে আলগা করে। ততক্ষনে রেশমীর ড্রেসিং শেষ হয়ে গেছে। প্যারামেডিক তাকে ওষুধ দিয়ে দেয়। কাজল রেশমীর হাত ধরে নিয়ে চলে যায় বিজয়ীর বেশে। হাছনা চিৎকার করতে থাকে, “রেশমী তুই কাজলের সাথে যাস না, তুই আমারে থুইয়া যাইতে পারিস না, আমি মইরা যামু, তুই অর লগে যাইস না”। এক সময় হতাশ হয়ে কাঁদতে কাঁদতে হাত-পা ছড়িয়ে মেঝেতে বসে পড়ে। সুরমা একটু অপ্রস্তুত হয়ে দেখে, হাছনা হেরে যাওয়া সৈনিকের মত ভেঙ্গে-মুষড়ে পড়ে আকুল হয়ে কাঁদছে।
প্যারামেডিক জিজ্ঞেস করে, “তুমি না রেশমীরে খুব ভালোবাসো, এভাবে কামড়েছো কেন?
হাছনা হাত দিয়ে চোখ মুছে বলে, “সেইজন্যই তো মারছি। ও আমারে ছাইড়া কাজলের কাছে চইলা গেছে। ও ক্যান আমারে ছাইড়া গেলো? তাই মারছি, কামড়াইছি।’’
প্যারামেডিক সারোয়ার আর সুরমার দিকে তাকায়। সুরমা এবার কিছুটা আঁচ করতে পারে। সে হাছনাকে বলে, “চোখ মোছেন। পানি খাবেন? আমার সাথে কথা বলেন। দেখেন হাল্কা লাগবে।” সারোয়ার বাইরে চলে যায়, প্যারামেডিক আপা হাছনাকে পানি দেয়। হাছনা কিছুটা স্থির হয়।
‘‘এবার বলেন কেন মেরেছেন রেশমীকে?” সুরমা জানতে চায়।
– রেশমীকে আমি ভালবাসি আপা। আমরা একবছর ধইরা প্রেম করি। এখন কাজলের লগে তার নতুন প্রেম হইছে। কাজল কাইলকা অরে কানের রিং আর লিবিস্টিক কিইনা দিছে। সেই কানের রিং আর লিবিস্টিক পইড়া আইজ সে কাজলের ঘরে গ্যাছে। আমার জান বাইর হইয়া গ্যাছে আপা। আমি তাই ওর কান আর ঠোঁট কামড়াইছি।
– আপনারা তিনজনই তো নারী!
সুরমা একটু অবাক হয়ে বলে।
‘‘আমি মাইয়াগোই ভালোবাসি আপা’’, হাছনার সোজা উত্তর।
– কিন্তু আপনারা তিনজনই যৌনকর্মী, তিনজনেই পুরুষ কাস্টমার নেন!
– আপা, আমি ব্যাডা কাস্টমার নেই টাকার লাইগা, সেইডা আমার পেশা। আমার একদম ব্যাডাগো সাথে শুইতে ভালো লাগে না, গা গুলায়, বমি আসে। আমি মাইয়াগোই ভালোবাসি।
– কখন থেকে আপনার এরকম হাছনা? শুরুটাই কি আপনার নারীর সাথে?
সুরমা ভাবে হয়তো ওরিয়েন্টেশনটাই নারীর সাথে ছিল।
– আমি আমার বাপ-মায়ের লগে বস্তিতে থাকতাম। একঘরে ভাই ভাবী আর তাগোর দুই বাচ্চা। আর আরেক ঘরে চৌকির উপর বাপে আর নিচে আমি আর মায় ঘুমাইতাম। আমার তখন ১৩-১৪ বছর বয়স হইবো, আমি আর মায় নিচে ঘুমাইয়া রইছি। মায়ের তখন মাসিক চলতেছে। ঘুমের মইধ্যে আতকা আমার মুখ বন্ধ, কিছু বোঝার আগেই আমারে চৌকির উপর নিয়া আমার বাপে…… আমারে জন্ম দিছে যেই ব্যাডা সেই ব্যাডা, আপনেরা যারে বাপ বইলা পূজা করেন সেই বাপে……। আমার কান্দনে মায় জাইগা গেছে, ততক্ষণে আমার সব শ্যাষ্,। মায়ে অন্ধকারের মইধ্যে দুই হাতে বাপরে মারতেছে আর গাইল পারতেছে। হারামজাদা ব্যাডায় মায়রে কয়, “চুপ কইরা থাক, অন্যেরা শোনলে তোর মাইয়ার বিয়া হইবো না।” আপাগো, আমার গা গোলাইয়া বমি, খালি বমি হইলো। দিনের আলোয় ওই জন্মদাতার মুখ আমি দেখুম না বইলা পলাইছি। রাস্তার ধারে বইসা আছিলাম। আর খালি বমি করি। এক মাতারী দেইখা আমারে জিগাইছে কি হইছে। তারে কইছি। সে আমারে এইখানে নিয়া বিক্রি কইরা গ্যাছে। সব কাস্টমারগো আমার কাছে আমার জন্মদাতা হারামজাদার মতন লাগে আপা। প্রতিদিন গা গোলায়, বমি আসে। তবুও সহ্য করি প্যাটের লাইগা। আমার যাওনের যায়গা নাই। আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলেই আমার গা গোলায়, বমি আসে!
[চলবে]
[চলবে]
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে
শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?