November 2, 2024
ফিচার ৩সাক্ষাৎকার

যত বেশি মেয়ে নিজেকে নারীবাদী বলবে, ততই লোকে বুঝবে নারীবাদ খারাপ কিছু নয়

রোক্সান গে মার্কিন নারীবাদী লেখক, অধ্যাপক, সম্পাদক এবং সোশ্যাল কমেন্টেটর। তার লেখা Bad Feminist নিউ ইয়র্ক টাইমসের সর্বাধিক বিক্রিত বইয়ের তালিকায় আছে। এছাড়াও তার লেখা বই Ayiti, An Untamed State, Difficult Women, Hunger তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। ব্যাড ফেমিনিস্ট প্রকাশ হয় ২০১৪ সালে। এটি প্রবন্ধ সংকলন। বইটি প্রকাশের পর তুমুল আলোচনায় চলে আসেন তিনি। সে সময় টাইম ম্যাগাজিন তার একটি সাক্ষাৎকার নেয়। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটির উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলায় অনুবাদ করে দেয়া হল।

ব্যাড ফেমিনিস্ট বইটিতে আপনি নারীবাদের সংজ্ঞা দিয়েছেন অনেকটা এইভাবে- নারীরা যখন নিজেকে বর্জ্য হিসেবে দেখতে চায় না। এছাড়া আর কোন উপযুক্ত সংজ্ঞা কি আছে?

– না আমি মনে করি না যে নারীবাদের একটি কোন নির্দিষ্ট সংজ্ঞা আছে। নারীবাদের বহু রকম সংজ্ঞা হতে পারে। তবে মূল কথাটি হল- পুরুষ ঠিক যা যা সুবিধা ও অধিকার ভোগ করে, নারীরও ঠিক তাই তাই ভোগ করবার অধিকার রয়েছে। গর্ভধারণ ও সন্তান জন্মদানের বিষয়ে স্বাধীনতা এবং নিজের শরীর কোনো ধরণের বাধ্যবাধ্যকতার ভেতরে থাকবে না, এটি আমাদের নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের তাকাতে হবে মজুরি বৈষম্যের দিকে, ভাবতে হবে শ্রেণি ও গোত্র নিয়ে, নারীর যৌনতা নিয়ে, নারীর কাজের দক্ষতা নিয়ে। কারণ নারীর বহুমুখী পরিচয় রয়েছে। নারীবাদী হিসেবে আমরা যে গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো করতে পারি, তার একটি হল, যদিও নারীত্বের দিক থেকে আমরা এক রকম, তবু আমাদের নিজেদের ভেতরে পার্থক্যগুলো কী তা চিহ্নিত করতে হবে, সেই পার্থক্যগুলো কীভাবে আমাদের উপর প্রভাব ফেলে এবং আমাদের কী প্রয়োজন, তাও বুঝে নিতে হবে।

হলিউডের কোন তরুণী যখন নিজেকে ফেমিনিস্ট বলেন, সেটির কি মূল্য রয়েছে?

– হ্যাঁ আবার না। এখানে মূল্যটা হল, যত বেশি মেয়ে নিজেকে নারীবাদী হিসেবে দাবি করবে, ততই লোকের মনে এই ধারণা আসবে যে নারীবাদ আসলে খারাপ কোনো কিছু নয়, অথবা এমন কিছু না যা তাদের ভয় পেতে হবে বা এড়িয়ে যেতে হবে। তবে আপনি জানেন নারীবাদ একটি চয়েস। এটা কাউকে জোর করিয়ে বিশ্বাস করানোর বিষয় না। আমি বলতে চাই, যদি সবাই নারীবাদী হয়, তাহলে আমি ভীষণ খুশি হবো, কিন্তু লোকের ভাল লাগা না লাগাকেও আমার সম্মান করতে হবে। যদি আপনি নারীবাদে বিশ্বাস না করেন এবং নারীবাদী হিসেবে নিজেকে দাবি না করেন, তাহলে সেটি সম্পূর্ণ আপনার অধিকার। কিন্তু আমি মনে করি, যত বেশি নারী প্রকাশ্যে উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করবে যে, “আমি একজন নারীবাদী”, সেটি ততই নারীবাদকে এগিয়ে নিয়ে যাবে এবং একই সাথে নারীমুক্তির পথ খুলে দেবে।

সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়ায় নারীবাদের বিরুদ্ধে নারীদের একটি অবস্থান দেখা গিয়েছিল, সেটি নিয়ে আপনার মত কী?

– আমার কাছে পুরো বিষয়টিই অদ্ভুত আর দুঃখজনক মনে হয়েছে। তবে যে যার নিজের মত রেখেছে। আমি তাদের সাথে পুরোটাই ভিন্নমত পোষণ করি এবং আমি মনে করি, নারীবাদই তাদের এই মতপ্রকাশের স্বাধীনতাটা সম্ভব করে দিয়েছে, ফলে তারা এখন এই উস্কানিমূলক কথাগুলো বলতে পারছে। তাদের বক্তব্যগুলো দেখে ভাবছিলাম, মানুষ কীভাবে এতটা অজ্ঞ হতে পারে! এটা খুবই দুঃখজনক।

তাদের এই অজ্ঞতার বিরুদ্ধে লড়তে আপনি আসলে কোথা থেকে শুরু করবেন?

– তাদের বুঝতে শুরু করতে হবে যে নারীবাদ একটি ধারণা। একটি দর্শন। এটি সকল ক্ষেত্রে নারীর প্রতি সমতার কথা বলে। নারীবাদ মানে পুরুষকে ঘৃণা করা নয়। নারীবাদ মানে নয় যে আপনাকে রসকষহীন হতে হবে। নারীবাদ নিয়ে ৪০/৫০ বছর ধরে যে ভুল ধারণাটি প্রতিষ্ঠা করে এর পথ কঠিন করা হয়েছে তা দূর করতে হবে। এটাই বিরক্তিকর যে আমাদের এখনও এই কথাগুলো বলতে হচ্ছে।

বিয়ন্সে’কে (মার্কিন কণ্ঠশিল্পী, নৃত্যশিল্পী, অভিনেত্রী, চলচ্চিত্রনির্মাতা) নিয়ে গত বছর যা ঘটে গেল, পুলিশ তাকে ব্যাড ফেমিনিস্ট বলেছে, তার নারীবাদকে ‘ভুল’ বলেছে। আপনার কি মনে হয়, তাকে বিশেষভাগে টার্গেট করা হয়েছিল?

– হ্যাঁ, আমি মনে করি তাই ঘটেছে। আমি বিশ্বাস করি, যখনই কোন নারী প্রকাশ্য হয়ে ওঠেন তখনই তাকে টার্গেট করা হয়। বিয়ন্সেকে টার্গেট করা হয়েছে কারণ তিনি পাবলিক ফিগার এবং অনেকের রোল মডেল। বিশেষ করে তার সাম্প্রতিক কাজগুলোতে তিনি তার যৌনতাকে দারুনভাবে তুলে ধরেছেন। যখনই কোনো নারী তার যৌনতাকে ধারণ করেন, তুলে ধরেন, তখনই সেটা লোকের কাছে অস্বস্তিকর হয়ে ওঠে। সুতরাং আমরা যা দেখলাম, তা হলো, অনেক অনেক অস্বস্তি আর লোকজন নানা রকম মত দিতে শুরু করলো, পক্ষে বা বিপক্ষে। যখনই নারী কোনো কাজ করে, তখনই আমাদের কোনো না কোনো মন্তব্য করতেই হয়!

লেখালেখির ক্ষেত্রে ইন্টারনেটেই কি প্রথম ড্রাফটটা করেন?

– সবসময় নয়। আমি Tumblr দিয়ে শুরু করেছিলাম, কোন উদ্দেশ্য ছাড়াই। লেখালেখিটা তখন খুব মজার আর শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল কারণ আমার কোনো ডেডলাইন ছিল না। আমি আমার নিজের জন্য লিখতাম যা ছিল খোলামেলা এবং সততায় ভরা। ইন্টারনেটে লেখালেখিও খুব ভাল কাজ করে, কারণ এটা খুব দ্রুত পাঠকের প্রতিক্রিয়া জানায়। আমার কিছু ভাবনা এলো, আমি ইন্টারনেটে সেগুলো প্রকাশ করলাম। আবার যখন আমি সেটা আমার ব্যক্তিগত ব্লগে লিখি, তখন সেটি নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা নেই, এটা শুধুই আমার ব্লগ, আর কেউ দেখে না। ফলে কোনো বিষয়ে আমার কোনো একটা উদ্বেগ আমি আমার নিজের মতো করে প্রকাশ করে রাখতে পারি, আমাকে এত কিছু ভাবতে হয় না। কিন্তু twitter অথবা tumblr এর বিষয়টি আলাদা, সেখানে আমি আমি আমার ভাবনা আর অনুভূতিগুলো নিয়ে রীতিমত কাজ করা শুরু করি।

মাঝে মাঝে কি এমন হয়, লোকে আপনার লেখা পড়ে আপনার সাথে তর্ক করতে এসেছে?

– হ্যাঁ নিশ্চয়ই। যখন কেউ কোন কিছু পয়েন্ট আউট করে অথবা কোনো কিছু তাদের ভালো লেগেছে বলে জানায়, তখন একটু অস্বস্তি হয় বৈকি, মনে হয়, ওহ ওয়াও! আমার তখন গভীর মায়া জন্মায়। লোকজন আমার লেখা পড়ছে আর আমি কাজ করছি এই মায়া নিয়ে।

আমি বুঝতে পারছি এরকম মুহুর্ত আপনার জীবনে আরো আসছে।

– হ্যাঁ আসছে। এবং এটা একটু বিব্রতকরও। কিন্তু হ্যাঁ, এই মায়াটা বয়ে নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন কাজ সত্যিই। আর আমি কঠিন কাজটাই করে যাচ্ছি।

একটি লেখায় আপনি বলেছেন, আমি চিৎকার করছি কারণ আমি সবগুলো পথ দেখাতে চাই। নারীবাদ নিয়ে আপনার অনেক লেখা আছে। কিন্তু কলেজে পড়ার সময়কার শহুরে জীবন নিয়েও আপনি লিখেছেন। আপনি যা বলতে চান, সেটির জন্য এগুলোও তো গুরুত্বপূর্ণ।

– আমি বিশ্বাস করি, যদি আপনি অনুসরণযোগ্য কাউকে না পান, তবে আপনাকেই নেতৃত্বের জায়গাটায় যেতে হবে। আমি নিজেকে নেতা বলবো না, কিন্তু আমি উঠে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করবো যে আমি একজন ফেমিনিস্ট। আমি একজন খারাপ নারীবাদী, কিন্তু আমি আমার নিজের নারীবাদ নিয়েই উঠে দাঁড়াবো। প্রত্যেকটা লেখায় আমি আমার নারীবাদকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি, যা আমার জীবনকে ভালো অথবা খারাপ, যেভাবেই হোক প্রভাবিত করেছে। একজন নারী হিসেবে এই দুনিয়ায় আমি কীভাবে চলছি, সেটিই প্রকাশ করেছি। এটা শুধুই নারীবাদ নয়, এটি আমার মানবতা এবং সহমর্মিতাকেও প্রকাশ করছে।