November 21, 2024
কলামফিচার ৩

সৌমিত্র আছেন ‘দিনের আলোর গভীরে’

মাসকাওয়াথ আহসান।। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ম্যাটিনি শো কাঁপানো নায়ক ছিলেন না। বিশেষ করে যেটা মহানায়ক উত্তম কুমারের দাপটের যুগ; সেখানে কিছুটা ঘাবড়ে যাওয়া; ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যাওয়া হাসি হেসে লাজুক মুখে তাকিয়ে থাকা নায়ক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়কে প্রথম প্রথম সবাই সত্যজিৎ রায়ের অফ বিট বা আর্ট ফিল্মের নায়কই ভেবে বসেছিলো।

তিনি আসলে একজন স্লো পারফরমার ছিলেন; জীবনের পথটা অনেক দীর্ঘ তো; তাই কোথাও যাবার তাড়া নিয়ে না হেঁটে ধীরে ধীরে পথ হেঁটেছেন। তাই বুঝি তিনি সত্যজিৎ রায়ের হাত ধরে হাঁটতে শুরু করে, তপন সিনহা, মৃণাল সেন,তরুণ মজুমদার থেকে শিবপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়-নন্দিতা রায় হয়ে সৃজিত মুখোপাধ্যায়,অতনু ঘোষ, সুমন ঘোষের মতো আজকের প্রজন্মের পরিচালকদের ছবিতে কাজ করে বুঝিয়ে দিলেন; ১৯৫৯ থেকে ২০২০; কী তরুণ; কী যুবক, কী প্রৌঢ়, কী বৃদ্ধ বয়সে; সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় পর্দায় এলেই তিনি নায়ক। সেই কিছুটা ঘাবড়ে যাওয়া হাসি হেসে লাজুক মুখে তাকিয়ে থাকা দিয়ে বয়স সম্পর্কে; নায়ক সম্পর্কে দর্শকের প্রচলিত চিন্তাকে বদলে দিলেন।

কলেজ জীবনে শিশির ভাদুড়ী’র থিয়েটার দেখে তিনি মুগ্ধ হন; সেই মুগ্ধতা আর শিশির ভাদুড়ীর সঙ্গে আড্ডা দেবার সুযোগে; অভিনয়ের সঙ্গে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন তিনি। সৌমিত্রের পরিবারেও থিয়েটার অভিনয়ের চল ছিলো। শিশির ভাদুড়ীর মতো শিক্ষককে পেয়ে অভিনয়ের ভিত্তিটা তৈরি হয়ে যায় তাঁর। এরপর সত্যজিৎ রায়ের ডাক পেয়ে তিনি ঘাবড়ে যান; মঞ্চের অভিনেতা চলচ্চিত্রের জগতে কী পেরে উঠবেন এই সংশয় তার ছিলো। কিন্তু সত্যজিৎ রায়ের মতো আরেকজন শিক্ষক; তাকে নিয়ে রবিবারের বিকেলগুলোতে সিনেমায় যেতেন। হলিউডের ছবিগুলো দেখাতেন। প্রাচ্য-প্রতীচ্যের অভিনয় ধারার এক মিশেলে তাঁর অবচেতনেই তৈরি হয়ে যায়; স্বকীয়তাটুকু অক্ষুণ্ণ রেখে।

এ কারণেই হয়তো তার অভিনয়ে কোন অতি-অভিনয় ছিলো না; চরিত্র অনুযায়ী ঠিক ঐ মানুষটি হয়ে ওঠার এক স্বকীয় বৈশিষ্ট্য সৌমিত্রের মাঝে উজ্জ্বল হয়ে ধরা পড়ে। “অপুর সংসার”-এর প্রেম-বিরহ-বেদনায় ম্লান যুবকটি; “অরণ্যের দিনরাত্রি”-র শহুরে যুবক ছুটি কাটাতে গিয়ে অরণ্যের সরলতার নেশায় খানিকটা বেপরোয়া হয়ে ওঠার গল্পে; “চারুলতা”-র দোলনার দুলুনিতে প্রেম-অপ্রেমের বিহ্বল কাহিনীতে, “ঘরে বাইরে” খল প্রতারক দেশপ্রেমিকের চরিত্রে, “হীরক রাজার দেশে”-র দ্রোহী শিক্ষক; যে স্বৈরাচারের পতন ঘটায়; তেমন প্রতীকী এক চরিত্র চিত্রণে; এমনকী “গণশত্রু” ছবিতে সেই জনদরদী ডাক্তার চরিত্রে; মানুষের মনের কু-সংস্কারের সুযোগ নিয়ে ধর্ম-ব্যবসা করা ক্ষমতা কাঠামোর লোকেদের বিরুদ্ধে লড়াকু হয়ে ; সব জায়গায় সব চরিত্রে সৌমিত্র দর্শকের মনে সৌমিত্রকে ভুলে ঐ চরিত্র হিসেবে তাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

নিজের তারকা ইমেজ না গড়ে; এক একটা চরিত্রে বিলীন হয়ে গিয়ে অভিনয়ের এক ধ্রুপদী তারকা হয়ে রইলেন যেন তিনি। আমিত্বকে বিসর্জন দিয়ে অভিনয়ের চরিত্রটিকে প্রধান করে দেখার এই সৌমিত্রীয় বৈশিষ্ট্যটি যে সব তরুণ অভিনয় শিখতে চান; তাদের জন্য অভিনয়ের টেক্সট বুক উদাহরণ হয়ে রইলো।

সৌমিত্র ‘অশনিসংকেত’, ‘সোনার কেল্লা’, ‘দেবদাস’, ‘নৌকাডুবি’, ‘গণদেবতা’, ‘আতঙ্ক’, ‘সাত পাকে বাঁধা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘তিন কন্যা’, ‘আগুন’, ‘শাস্তি’, ‘জয় বাবা ফেলুনাথ’সহ ৬১ বছরের দীর্ঘ ফিল্মি কেরিয়ারে প্রায় ২৫০টি ছবিতে অভিনয় করেছেন।

২০০৪ সালে তিনি পদ্মভূষণে সম্মানিত হন। এ ছাড়া জাতীয় পুরস্কার, দাদাসাহেব ফালকেসহ অনেক পুরস্কার পেয়েছেন। সবচেয়ে বড় পুরস্কারটি অবশ্য তার মৃত্যুর খবর শোনার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে খুঁজে পাওয়া গেলো। দেখা গেলো তাঁর মৃত্যু সংবাদের মন খারাপে-শোকে-তাঁর সুকৃতির গল্পে-গভীর শ্রদ্ধায় তাঁকে বিদায় জানানোর মিছিলে অনেকগুলো প্রজন্মকে ভালোবাসার মায়ায় বেঁধেছেন তিনি।

অভিনয়ের পাশাপাশি কাব্যচর্চা, আবৃত্তি, রবীন্দ্রপাঠ, সম্পাদনা, নাট্যসংগঠন করেছেন তিনি। ৮৫ বছরের সক্রিয় জীবন; বয়সের শাসনে বুড়ো না হয়ে যাওয়া জীবন তার। করোনাভাইরাসের সঙ্গে যোদ্ধার মতো লড়েছেন তিনি। তাকে বাঁচানোর চেষ্টায় ডাক্তারেরা সম্ভব সব চেষ্টা করেছে; “গণশত্রু” ছবিতে ডাক্তার চরিত্রটিকে যে উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তিনি; তাতে তাঁর শেষ যুদ্ধের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা ডাক্তারেরা কতটা আকুলতা নিয়ে তাঁকে বাঁচিয়ে রাখতে চেষ্টা করেছেন তা অনুমান করা যায়। কিংবদন্তীর সৌমিত্রকে ধরে রাখার আকুতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও কান পেতে শুনেছি।

বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালী অধ্যায়ের পতনের পর যে তরুণ চলচ্চিত্রকারেরা আবার বাংলা চলচ্চিত্রের নতুন সূর্যোদয়ের জন্য লড়েছেন; সৌমিত্র তাদের সঙ্গে অভিভাবক আর বন্ধুর মতো কাজ করেছেন। তিনি যেন তাদেরকেই পড়ে শোনালেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর থেকে,
‘‘আমাদের গেছে যে দিন
একেবারেই কি গেছে,
কিছুই কি নেই বাকি।’’
একটুকু রইলেম চুপ করে;
তারপর বললেম,
‘‘রাতের সব তারাই আছে
দিনের আলোর গভীরে।”

 

মাসকাওয়াথ আহসান: শিক্ষক ও লেখক