September 20, 2024
জীবনের গল্পফিচার ৩

নিজেকে নারী ভেবে আলাদা করিনি, ব্যবসায় তাই কনফিডেন্স হারাইনি

একজন সফল ব্যবসায়ী সাবিনা ইয়াসমিন। পাশাপাশি তিনি একজন সম্পাদক এবং সমাজকর্মী। লেখেন কবিতাও। ১৯৯৮ সালে প্রচিত আইএমসি লিমিটেড নামে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে একে একে তা বিস্তৃত হয়েছে প্রচিত আইটিএস, প্রচিত হলিডেজ এবং নারী বিষয়ক ম্যাগাজিন রোদসীতে। এছাড়াও আন্তর্জাতিক ট্যুরিজম প্ল্যাটফর্ম আমুজামু ডট কম নামের প্রতিষ্ঠানেরও উদ্যোক্তা তিনি। তার ছেলে এই ব্যবসার দেখাশোনা করছে। ছোটসন্তান মেয়ে ইন্টারমিডিয়েট প্রথম বর্ষের ছাত্রী আর স্বামী ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের আজকের সফল নারীর জীবনের গল্পটা সাবিনা ইয়াসমিনের। ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরের সাথে আলাপচারিতায় নিজের সংগ্রাম আর জীবন দর্শনের কথা বলেছেন তিনি।

গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার দাউদকান্দি হলেও বাবার চাকরিসূত্রে সাবিনা ইয়াসমিনের জন্ম চট্টগ্রামের পাহাড়তলিতে। ছেলেবেলা সেখানেই কাটে। পরে গ্রামে ফিরে আসে তার পরিবার এবং কুমিল্লা থেকে এসএসসি পরীক্ষা দেন তিনি। পরিক্ষার আগেই বিয়ে হয়ে যায় ইয়াসমিনের। বয়স তখন মাত্র ১৪। তার স্বামীও তখন ছাত্র। ১৬ বছর বয়সে প্রথম সন্তানের মা হন। অল্প বয়সে বিয়ে, বাচ্চার পর অধিকাংশ নারীই হাল ছেড়ে দেন। বিয়ে আর সন্তানের জন্য সাবিনারও লেখাপড়ায় বছর দুয়েকের গ্যাপ পড়ে। কিন্তু থেমে যাওয়ার পাত্রী তিনি নন।

তার প্রকৌশলী স্বামীর ঢাকা ওয়াসাতে চাকরি হওয়ার পর সাত/আট মাসের ছেলেকে নিয়ে ঢাকায় আসেন। এখানে আসার পর মিরপুর আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজে ভর্তি হন এইচএসসি’তে। ছোট বাচ্চাকে নিয়ে কলেজে ভর্তি হওয়ার পথটা তেমন সুগম ছিল না। কিন্তু সাবিনা একরকম জোর করেই ভর্তি হন। তার আত্মবিশ্বাস ছিল যে ভালো ফলাফল তিনি করবেনই। ৮৮ সালে এসএসসি পাশ করলেও তাই এইচএসসি করেন ৯৩ সালে।

এভাবেই শুরু, ভালো ফলাফল করে পাশ করার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলায় অনার্সে ভর্তি হন। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা ঢাকার কোথাও ভর্তি পরীক্ষা দেওয়া বা খোঁজখবর করা হয়ে ওঠেনি সেসময়। একহাতে সংসার, বাচ্চা সামলে লেখাপড়া করাটাই অনেক বেশি ছিল। এমনকি জগন্নাথে ভর্তি করার কাজটিও তার ভাই করে দেন। ৯৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়ে ২০০০ সালে মাস্টার্স করে বের হন। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে হওয়া সেই পরীক্ষায় ষষ্ঠ স্থান অর্জন করেন তিনি।

এদিকে অনার্স পরীক্ষা দেওয়ার পরপরই কিছু একটা করার ইচ্ছা ছিল। ভেবেছিলেন, বাংলা সাহিত্যে পড়ার কারণে কপিরাইটিং ভালো পারবেন। তাই কোনো একটা অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সিতে যোগদানের ইচ্ছা ছিল। তার এক কাজিন ছিল এখানে। তিনিই তাকে সাহায্য করছিলেন কেরিয়ার বাছাইয়ের ব্যাপারে। সেই কাজিনের কাছ থেকেই অ্যাডভার্টাইজিং, বিজ্ঞাপন এই বিষয়গুলো বুঝতে শুরু করেছিলেন। এদিকে তার ভাইও তখন ভোরের কাগজের বিজ্ঞাপন বিভাগে কাজ করতেন। ফলে ভাইয়ের কাছ থেকেও কিছুটা ধারণা জন্মে।

কাজিনের উৎসাহে জব না করে নিজেই অ্যাডভার্টাইজিং এজেন্সি শুরু করার পরিকল্পনা করেন। যেই ভাবা সেই কাজ, অনার্স ফাইনাল পরীক্ষার পরপরই ১৯৯৮ সালের জানুয়ারিতে দুজন কর্মী নিয়ে ‘প্রচিত অ্যাডভার্টাইজিং অ্যান্ড মার্কেটিং কোম্পানি’ নামে নিজের অ্যাড ফার্ম শুরু করেন। অফিস নেন আজিজ সুপার মার্কেটে। ব্যাবসা করতে করতেই মাস্টার্স শেষ করেন।

ব্যবসা যত ছোটই হোক না কেন, ক্যাপিটাল তো লাগেই। পিয়নসহ তিনজন কর্মীর বেতন, অফিস ভাড়া, রেজিস্ট্রেশন, অফিস সেটআপ সব মিলিয়ে খরচ তো কম না। কিন্তু না, ঋণ নিতে হয়নি। সংসার খরচ থেকে জমানো কিছু টাকা ছিল, তাই দিয়েই শুরু করেন নিজের অ্যাডভার্টাইজিং কোম্পানি। সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, তার অভ্যাসই কিছু না কিছু টাকা জমিয়ে রাখা। বাজার করার জন্য ১০০ টাকা দিলে তিনি হয়ত ৬০ টাকার বাজার করতেন। এভাবেই টাকা জমাতেন। তার বাবা ও সেই কাজিনের কাছ থেকেও কিছু সাহায্য নিয়েছিলেন। সংসার খরচের টাকা জমিয়ে ব্যবসা শুরু করলেও ব্যবসা শুরুর ব্যাপারে তার স্বামীর প্রত্যক্ষ কোন অবদান ছিল না।

অল্প সময়ের মধ্যেই কাজটি বুঝে নেন আর উত্তরোত্তর সমৃদ্ধি আসতে থাকে তার কাজে। প্রথম মাসেই লাখ টাকার উপরে আয় করেন যা ছিল স্বপ্নের মতো। সেই তেইশ-চব্বিশ বছর বয়সেই এতটা অর্জন করতে পেরে অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি হত সাবিনার। ব্যবসা কিছুটা বড় হলে আজিজ মার্কেট থেকে পান্থপথ চলে আসেন। দুইরুমের অফিস নেন। কর্মীসংখ্যা বেড়ে তখন দশ। দুইবছর পরে প্ল্যানার্স টাওয়ারের ফোর্থ ফ্লোরে সাড়ে চৌদ্দশ স্কয়ারফিটের অফিস স্পেস কিনে চলে আসেন। ব্যবসা শুরুর চার বছরের মাথায় ব্যবসাস্থলের পাশাপাশি নিজের জন্য স্থায়ী ঠিকানারও মালিক হন। সে সময়ই বনানীর ফ্লাটের বুকিং দেন যেখানে তিনি পরিবার নিয়ে এখনও বাস করছেন।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: বাংলা সাহিত্যে পড়েও সফল ব্যবসায়ী হয়েছেন। এটি কীভাবে সম্ভব হল? ব্যবসায় সাফল্যের রহস্য কী?

সাবিনা ইয়াসমিন: আসলে আমার ইচ্ছাটা তীব্র ছিল। তাছাড়া আমি ব্যবসা শুরুর আগে যতটা পারি খোঁজখবর করেই নেমেছিলাম। বাজারের চাহিদা জেনেই কাজ শুরু করেছিলাম, যাকে এখন বলা হয় মার্কেট রিসার্চ। অন্যান্য এজেন্সিতে গিয়ে কাজের ধরণ সম্পর্কে জেনেছিলাম। টিভিসি বা আরভিসির কাজ সম্পর্কে জানতাম না, তাই সেগুলোতে হাতও দেইনি। আমি মূলত পত্রিকার বিজ্ঞাপনের কাজ করতাম।

কাজের ক্ষেত্রে সবসময় স্বচ্ছতা আর গুনগত মানকে গুরুত্ব দিয়েছি। তাই আমার কিছু কিছু ক্লায়েন্ট একদম শুরু থেকেই আছেন আমার সঙ্গে। এছাড়া আমার কর্মীদেরকেও আমি সম্মান করি। আমি মনে করি আমিও কাজ করছি, তারাও কাজ করছে। সবাই আসলে সমান সম্মানের দাবিদার। দেখা যায় তারাও আমার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গেই কাজ করছে। মিলি (রওশন আরা জামান, উপ-সম্পাদক, রোদসী) তো সেই শুরু থেকেই বলতে গেলে আমার সঙ্গে আছে। ওকে এই ফিল্ডে চেনে না এমন মানুষ নাই। এমন অনেকেই আছে। কেউ অন্য কোথাও গেলেও আবার আমার কাছে ফিরে আসে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: তরুণী বয়সে ব্যবসা শুরু করেন, নারী হিসেবে কোন ধরণের বাঁধা বা তিক্ততার মুখোমুখি হননি?

সাবিনা ইয়াসমিন: এখন আমার পজিশনের জন্য তেমন কোনো সমস্যার মুখোমুখি না হলেও তখন তো হতামই। আসলে অত কিছু ভাবার সময় পাচ্ছিলাম না। কোন বাঁধাকেই তখন বাধা মনে হত না। নারী হিসেবে বিশেষ ধরণের সমস্যার মুখোমুখি যে হতে হয়নি তা না, তবে সেগুলো খুব কৌশলে পাশ কাটানোর চেষ্টা করতাম। বিচক্ষণতার সঙ্গে হ্যান্ডল করতাম এসব বিষয়। ভাগ্যও আমাকে সহায়তা করেছে আজকের এই পর্যায়ে পৌঁছাতে। নারী হিসেবে যেসব সমস্যার মুখোমুখি আমরা হই, সেগুলো আসার আগেই আমি পাশ কাটিয়ে চলে আসতাম। অফিস-বাসা ছাড়া খুব একটা কোথাও যেতামও না। সারাজীবন টিম নিয়ে মিটিংয়ে গিয়েছি। একা গেলে হয়ত বিপদে পড়তে পারতাম।

তাছাড়া আমি সবসময়ই নিজের কাজ ও কাজের কোয়ালিটির প্রতি মনোযোগ দিতাম। সাফ বলে দিতাম আমার কাজ পছন্দ হলে কাজ দেবেন, নাহয় দেবেন না। এর জন্য আলাদা করে লাঞ্চ করতে যাওয়ার সময় নাই।

জানেন যে আজিজ মার্কেট মূলত ছেলেদের আড্ডার জায়গা। সেখানে খুব যে নিরিবিলি কাজ করতে পেরেছি তা না। তবে আমি সবসময়ই প্রতিবাদী। বড় কোন সমস্যা আসার আগেই তাই তা প্রতিবাদ করে দূর করে দিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় বা অফিস যাওয়া আসার পথে কোন ধরনের হয়রানি বা টিজিংয়ের মুখোমুখি হলেও কড়া করে জবাব দিতাম। এভাবে একবার কিছু ছেলের সঙ্গে কিছুটা ঝামেলা হয়। তারা খোঁজ নিয়ে জানে যে আমার অফিস এখানে। চাকরি করি ভেবে আমার দোকানের সামনে এসে আমার মালিককে খোঁজে। আমিও দমে যাবার পাত্রী না, খুব চোটপাট করছিলাম। তারপর যারা শোনে যে আমিই মালিক, সেটি জেনে ওরা চলে যায়। আশপাশের লোকজন এসেও আমার সমর্থনে দাঁড়িয়ে যায়।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: ব্যবসার ক্ষেত্রে কোনো ধরণের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকার পরেও  নিজের চেষ্টায় যে ব্যবসা শুরু করলেন, আপনার ভয় লাগেনি একটুও?

সাবিনা ইয়াসমিন: আসলে তখন বয়স এতো কম। ভয় যে লাগতো না তা না। তবে ভীষণ কনফিডেন্ট ছিলাম। তাছাড়া বেড়ে ওঠার সময় নিজেকে মেয়ে হিসেবে আলাদা কিছু ভাবিনি। আমার মাও সেভাবেই বড় করেছেন। তিনি ছিলেন খুবই খোলামনের নারী। আজ যতটুকু যা হয়েছি তা মায়ের কারণেই। আর আমি ছিলাম ডানপিটে টাইপের। খেলাধুলা আর আড্ডা ছিল সব ছেলেদের সঙ্গে। হাডুডু, ফুটবল ইত্যাদি খেলাধুলা করে বড় হয়েছি বলতে গেলে। এরপর তো ১৪ বছর বয়সে বিয়েই হয়ে গেল। জীবনের মোড় ঘুরে গেলেও মানসিকতা যা গড়ার তা ছোটবেলাতেই মা গড়ে দিয়েছিলেন। যেহেতু নিজেকে নারী হিসেবে আলাদা ভাবতে শিখি নি, তাই ব্যবসা করতে এসেও কখনও কনফিডেন্স হারাইনি। ছাত্রজীবনেও মানুষকে মানুষের মত করে ট্রিট করতাম। প্রচুর ছেলেবন্ধু ছিল যাদের সঙ্গে কথা বলে আরাম পেতাম।

অনেকেই ভাবতে পারেন, আমি বোধহয় কিছুটা পুরুষালি আচরণের নারী। আসলে তা না। আমি আপাদমস্তক একজন নারীসুলভ নারী। কিন্তু মেয়েদের সঙ্গে মিশতে পারতাম না। এর কারণ হয়ত হবে আমার চিন্তা চেতনার সঙ্গে মিলত না। ওদের অনেক কথায় হয়ত ঝগড়াই হয়ে যেত। সেখানে ছেলেবন্ধুদের সঙ্গে খোলামনে আড্ডা দেওয়া যেত। আবার বয়সে বড় যারা তাদের সঙ্গেও আমার সহজে বন্ধুত্ব তৈরি হত। শিক্ষকদের সঙ্গেও বন্ধুত্বের সম্পর্ক তৈরি হয়ে যেত।

মানুষকে সহজভাবে নেওয়ার এই অভ্যাস আমাকে ব্যবসায় অনেক সাহায্য করেছে। তাছাড়া আমি সাধারণত একা মিটিংয়ে যেতাম না। সঙ্গে কোন না কোন সহকর্মী থাকত। তাছাড়া আমি মানুষের থেকে ইতিবাচক আচরণই পেয়েছি সাধারণত। সবার কাছ থেকে শ্রদ্ধা, স্নেহ আর ভালোবাসাই পেয়েছি। আমার দিক থেকেও নিজের কর্মী থেকে শুরু করে ক্লায়েন্ট সবার সঙ্গেই আমি শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণ করেছি, মানুষ হিসেবে সবাইকে সমান বিবেচনা করে কাজ করেছি। তাই চলার পথ মোটামুটি মসৃণ ছিল। কাজের ব্যপারে আমি সবসময়ই সিরিয়াস। ফলোআপ করি সবসময়। মিডিয়াও আমাকে সবসময় সাহায্য করেছে। আমি কাজ দিয়েই মানুষের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করেছি। এই কারণেই হয়তো করোনার এই দুঃসময়েও আমি টিকে আছি। বেশ ভালোভাবে টিকে আছি।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: পরিবার থেকে কোনধরনের বাধার মুখোমুখি হননি?

সাবিনা ইয়াসমিন: আমার স্বামীর তেমন কোন সাহায্য আমি পাইনি। আর দশটা স্বামীর মতই বরং কিছুটা বাধাই পেয়েছি। তবে এই নিয়ে খুব একটা অশান্তি করার পথে আমি হাঁটিনি। যেকোন কিছু নিয়েই জোরালো প্রতিবাদ বা ঝগড়াঝাঁটি করা আমার স্বভাব না। যে যা বলার বলেছে, আমি মনোযোগ দিয়ে আমার কাজ করে গিয়েছি। আমার ভেতরে ভেতরে অত্যন্ত জিদ কাজ করত। যা করার তা আমি করবই। আমি সবসময়ই যুক্তি দিয়ে বোঝানোয় বিশ্বাসী। তাই আমাকে একটা কথা বলে থামানো সম্ভব না, সেটির পেছনে জোরালো যুক্তি থাকতে হবে। আমার কাজের বিরুদ্ধে উল্টাপাল্টা কথা বলার অধিকার আমি কাউকেই দেইনি। দৃঢ়ভাবে এগিয়ে গিয়েছি।

আমার স্বামী আমাকে ঘর থেকে বের হতে দেয়নি বা নির্যাতন করেছে, তা না। সে তার কাজে ব্যস্ত থেকেছে আর আমি আমার ব্যবসা নিয়ে। তবে আশপাশের মানুষ অনেকসময় অনেক নেতিবাচক কথা বলেছে। সন্তান রেখে ব্যবসা করা নিয়ে আপত্তিকর কথা বলেছে। আমি সেসব তেমন একটা পাত্তা দেইনি। আমার দুই সন্তানের কারও মায়ের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ নাই। আমি কিছুটা হোমসিক থাকায়, তাদের সঙ্গে সময় কাটাতে কার্পন্য করিনি। অফিস টু বাসাই আমার জীবন। এমনকি বাইরে আড্ডা দেওয়া বা খেতে যাওয়ার মত ব্যাপারেও আমি অযথা সময় নষ্ট করিনি। চেষ্টা করেছি ওদেরকে কোয়ালিটি টাইম দিতে। ব্যবসা করলেও সন্তানের দেখাশোনা, পড়াশোনার খোঁজখবর সবই আমি করেছি।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: ব্যবসা করতে গিয়ে বেশিরভাগই নিশ্চয় পুরুষ ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কাজ করতে হয়েছে? তারা কি কখনও আপনার অনভিজ্ঞতা বা নারী হিসেবে আপনাকে ছোট করেছে বা কোন অবমাননাকর আচরণের শিকার হয়েছেন?

সাবিনা ইয়াসমিন: আসলে আমি বরং সবার কাছ থেকে সম্মানই পেয়েছি। শুরু থেকেই শ্রদ্ধার জায়গা ধরে না রাখলে আজ হয়ত এই পর্যন্ত আসতে পারতাম না। সবাই আমাকে আন্তরিকতা আর ভালোবাসার সঙ্গে গ্রহণ করেছে। এর কারণ আমি জানি না, তবে আমি পেয়েছি। আর সামান্যতম অবমাননাকর আচরণের চিহ্ন দেখলেও আমি চরম প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছি। ফোনে হয়ত বলেছি- কাজে সমস্যা দেখলে কাজ দেওয়া বন্ধ করেন নাহলে আমিই আপনার কাজ করবো না। এভাবে জোরালো অবস্থান নেওয়ার ফলে সেসব সমস্যা উৎরেও যেতাম।

লেখাপড়া শুরু করার সময় কেউ যদি বলত, বিয়ে হয়েছে, বাচ্চা হয়েছে আবার লেখাপড়া কেন?  ঝগড়া করতাম না। মুখে বলতাম, দেখি কী হয়। এভাবে শান্তভাবে নেতিবাচক পরিস্থিতি সামলাতাম।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: আপনি কি নিজেকে একজন নারীবাদী বলবেন?

সাবিনা ইয়াসমিন: না, আমি সেই অর্থে নিজেকে নারীবাদী বলবো না। ছাত্রজীবনে তসলিমা নাসরিনের বই পড়তাম তাই নিজেকে নারীবাদী ভাবতাম। তবে কর্মজীবনে এসে আমার চিন্তাভাবনায় বদল এসেছে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: আপনি কী সমঅধিকারে বিশ্বাস করেন?

সাবিনা ইয়াসমিন: হ্যাঁ আমি মানুষের সমঅধিকারে বিশ্বাস করি। তবে সমঅধিকারের থেকেও আমি যোগ্যতায় বিশ্বাসী। যার যোগ্যতা আছে সে যেকোন বাধা পার হতে পারবে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: নারীদের যে নানারকম লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হতে হয়, এ ব্যপারে আপনার মতামত কী?

সাবিনা ইয়াসমিন: আমি মনে করি সেসব বাঁধা পার হওয়াও এক ধরণের যোগ্যতা। পুরুষতন্ত্রের যেমন সমস্যা আছে তেমনি নারীদেরও অনেক সমস্যা আছে। অনেক নারী জানেই না তারা কী চায় আর কেনই বা চায়। নারীদের নিজেদের ভেতর বিশ্বাস রাখতে হবে যে সে চাইলেই পারবে। যেকোন কাজ সে চাইলেই পারবে- এভাবে ভাবতে শেখাতে হবে। এমনকি তার শারীরিক শক্তিও কোন পুরুষের তুলনায় কোন অংশেই কম না। মেয়েদের মাথায় ঢুকিয়ে দিতে হবে যে সে ধর্ষণের মুখোমুখি হলেও শারীরিক শক্তি দিয়ে ঠেকিয়ে দিতে পারবে। মস্তিষ্কের ক্ষমতা দিয়েই তারা পারবে যেকোন বাঁধা মোকাবিলা করে এগিয়ে যেতে।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: নারীরা যে এটা পারবে না, সেটা পারবে না- সেটি কি পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাই তাদের মাথায় ঢুকিয়ে দেয়নি?

সাবিনা ইয়াসমিন: সমাজ এটি ঢুকিয়ে দিলেও নারীকে নিজের পথের বাঁধা দূর করে এগিয়ে আসতেই হবে। আমি তো গ্রামে ছিলাম। অল্প বয়সে বিয়ে, সন্তান হওয়ার পর আমিও ভাবতে পারতাম আমার জীবন শেষ। কিন্তু আমি তো থামিনি। আমি স্বপ্ন দেখেছি এবং সেই স্বপ্নের পথে অটল থেকেছি, পরিশ্রম করেছি। আমার জিদ ছিল লেখাপড়া করবোই। আমি ভাবতাম যদি আমার ছেলের সঙ্গেও ইন্টার পড়া লাগে, তাও আমি ইন্টারমিডিয়েট পাশ করবোই।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: তবে কি আপনি বলবেন, পুরুষতন্ত্রের এসব বাঁধা থাকবেই। নারীকেই তার পথ তৈরি করে এগিয়ে যেতে হবে?

সাবিনা ইয়াসমিন: অবশ্যই। তাছাড়া আরেকটা জিনিস আমাদের মনে রাখতে হবে, পুরুষতন্ত্রের বাঁধা দূর করা মানে কিন্তু পুরুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ না। পুরুষের সহযোগিতা নিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। নাহলে কিন্তু যুদ্ধ বাঁধবে। আর যুদ্ধ ভালো কিছু বয়ে আনে না। যুদ্ধ মানে ক্ষয়। তাই আমরা যুদ্ধে যাবো না, কৌশলে আমার কাজ আদায় করে নেবো। সেটি মেধা আর কৌশল দিয়ে। তাই আমি বারবার বলি একজন মানুষ সে নারী হোক কি পুরুষ- তাকে সফল হতে হলে যোগ্য হতেই হবে।

একজন মাকেই তার মেয়ে সন্তানের মগজে ঢুকিয়ে দিতে হবে যে সে চাইলেই পারবে। আমার স্বল্পশিক্ষিত মা হয়ত সরাসরি এভাবে বলেননি, কিন্তু তিনি আমাদের চিন্তাচেতনার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন যে আমি পারবোই। প্রতিটি সন্তানকই বোধসম্পন্ন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। নাহলে সমাজের সবার সঙ্গে ক্ল্যাশ সৃষ্টি হবে যা ভালো কিছু বয়ে আনবে না। ঘটনার পেছনের কারণ খুঁজে বের করতে হবে। এভাবেই সমস্যার সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। আমিও আমার মেয়েকে সব পারবে এই চিন্তাভাবনা দিয়ে বড় করতে চেষ্টা করছি। তাকে নানারকম কর্মকাণ্ডের সঙ্গে যুক্ত করছি যাতে সে ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত হয়। তাকে জাস্ট একজন যোগ্য মানুষ হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করছি।

ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।

সাবিনা ইয়াসমিন: ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরকেও ধন্যবাদ।