November 21, 2024
কলামফিচার ২

মুড সুইং-এর রাজনীতি

সাব্বির এ মুকীম।। মুড সুইং আসলে কী? বায়োলজিক্যাল হিস্ট্রির ব্যাকগ্রাউন্ডে মুড সুইং-কে সারভাইভাল অ্যাংজাইটি বলা যায়। টিকে থাকার লড়াইয়ে বারে বারে নতুন কিছু করার চিন্তা করতে বাধ্য হওয়াজনিত অবসাদের একটা রকম হলো সারভাইভাল অ্যাংজাইটি।

আজতক প্রকৃতিকে যে পাঠ আমরা করেছি তার সারাংশ হলো যে কোনো প্রাণীকে ঘিরেই প্রকৃতি চায় যে প্রাণীটি প্রাণে বেঁচে থেকে সংখ্যা বৃদ্ধি করুক- তাই প্রাণে বেঁচে থাকুক। সেজন্য প্রকৃতিই প্রাণিকূলের মধ্যে বেঁচে থাকার প্রতি চরম তৃষ্ণা কিংবা আরও স্পষ্ট করে বললে মৃত্যু রোধ করার দূর্বার বাসনার বীজ প্রাণের গাঠনিক স্তরে প্রচণ্ড কাঙ্ক্ষিত করে রেখেছে। এর ফলেই সারাক্ষণ প্রাণনাশের ভয়ের ভেতরে থেকে প্রাণীরা সারাক্ষণ সাবধান থাকে- কিছু হলেই হতচকিত হয়। তার শরীর যে কোনো ডাটা পেলেই সবার আগে ডাটার যে প্রাথমিক অনুবাদ করে, তা হলো খুব সম্ভবত এটা প্রাণনাশের সম্ভাবনা তৈরি করবে। ফলে প্রাণী হতচকিত হয়- এটাই সারভাইভাল অ্যাংজাইটি, যা প্রাণীর অভ্যাসে পরিণত হয়।

মরে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য প্রাণীর শরীরে এই স্বয়ংক্রিয় বায়োকেমিক্যাল মিথস্ক্রিয়া প্রকৃতির কল্যাণে প্রায় সব প্রাণীর জীবদ্দশায় যার যার তার তার দেহের চলমান সবচেয়ে স্থায়ী প্রাণবিক ক্রিয়া। শারীরিক শক্তি বিবেচনায় নিম্ন শ্রেণির প্রাণীদের মাঝে সারভাইভাল অ্যাংজাইটি সহজে চোখে পড়ে। খরগোশকে, হরিণকে যতবার হতচকিত হতে দেখা যায়, ততবার বাঘ বা ভাল্লুককে তত সহজে হতচকিত হতে দেখা যায় না। সাপ যতটা আক্রমনাত্মক তার তুলনায় হাতি ততটা আক্রমনাত্মক নয়। আবার খাদ্যশৃঙ্খলে নিচের দিকের প্রাণীগুলো উপরের দিকের প্রাণীগুলোর চেয়ে বেশি অনুপাতে সারভাইভাল অ্যাংজাইটিতে থাকে। খাদ্য শৃংখলে মানুষের অবস্থান মাঝামাঝি স্তরে। তবে অন্যান্য প্রাণীর তুলনায় মানুষ মগজের কাজ বেশি করে করে মানুষ ভিত্তিক নেটওয়ার্কিং গড়ে তুলেছে। এই নেটওয়ার্কিং-এর ফলে মানুষের কালেক্টিভ মেমরি বা সামষ্টিক স্মৃতি তৈরি হয়। কালেক্টিভ মেমরি দিয়ে মানুষ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যতের মানুষের সাথে মানুষ খুব সহজে সংযুক্ত হয়ে যায়। কালেক্টিভ মেমরির সবচে সুলভ ভাণ্ড হলো আমাদের ভাষা- বাচিক, সাংকেতিক এবং ইতিহাসের কিছু পথ পেরিয়ে লিখিত- এই তিন  মিলে।

এই নেটওয়ার্কিং-এর ফলেই যখনই একটা পশু ও একটা মানুষের মধ্যে লড়াই লাগে, তখন কালেক্টিভ মেমোরির সুযোগ নিয়ে সেই একটা পশুর সাথে আসলে একটা বিরাট মানবগোষ্ঠী লড়াই করে। লড়াইয়ে পশুটি কেবলই একটি পশু অথচ মানুষটি কেবল একটি মানুষ নয়- বরং সে একটি মানবগোষ্ঠির প্রতিনিধি। লড়াইয়ে পশুটি কেবল তার  জৈব বৈশিষ্ট্য এবং জীবনধারণজনিত ব্যক্তিগত উৎকর্ষকে কাজে লাগিয়ে লড়াই চালিয়ে যায়। অন্যদিকে লড়াই করার ক্ষেত্রে ওই দুই বৈশিষ্ট্য’র সাথে মানুষের জন্য আরও একটি বৈশিষ্ট্য যুক্ত হয়- কালেক্টিভ মেমোরি। ফলে খুন-জখম-ধ্বংস করায় মানুষ শ্রেষ্ঠ হয়ে ওঠে। খুন-জখম-ধ্বংস করায় শ্রেষ্ঠ হতে হতে- মানুষ প্রকৃতি জগতে চালকের আসনে ঘাঁটি গেড়ে বসে। আপাতদৃষ্টিতে চালকের আসনে বসলেও খাদ্যশৃঙ্খলে মানুষের অবস্থান খুব একটা পরিবর্তন না হওয়ায় মাঝামাঝি পর্যায়ে অবস্থানের কোনো হেরফের হয় না।

মানুষ খাদ্যশৃঙ্খলে তার অবস্থানের অনুপাতে আসলে সেই আদি যুগের তাৎক্ষণিক সারভাইভাল অ্যাংজাইটিসম্পন্ন প্রাণীই রয়ে গেছে। শরীরের গহীণ জৈব অংশ অর্থাৎ ব্যাসাল গ্যাংলিয়া- মস্তিষ্কের সবচে আদিম অংশে সে এখনো আদিম স্তরের সারভাইভাল অ্যাংজাইটি ভরা প্রচন্ড অ্যাংশাস প্রাণীই রয়ে গেছে।

প্রণিধানযোগ্য যে আমাদের মস্তিষ্কের সারভাইভাল অ্যাংজাইটি’র বিহেভিওরাল বা ব্যবহারগত প্রকাশ হলো মুড সুইং। মুড সুইং-কে চলতি ভাষায় মেজাজ খারাপ বলে বোঝানো যায়। তবে মুড সুইং মানেই মেজাজ খারাপ তা নয়। মুড সুইং হলে যেমনি মেজাজ খারাপ হয় তেমনি আরো অনেক কিছু হলেও কিন্তু মেজাজ খারাপ হয়। যেমন টাকা না থাকলে মেজাজ খারাপ হয়, খাবার পছন্দ না হলে মেজাজ খারাপ হয়, অতিরিক্ত কাজের চাপে থাকলে মেজাজ খারাপ হয়। এরকমই মুড সুইং হলেও মেজাজ খারাপ হয়। মেজাজ খারাপ হয় তখনই যখন ব্রেইন হ্যাং করে, সে আর অন্য কাজের চাপ নিতে অস্বীকার করে মেজাজ খারাপ প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে। তাই মুড সুইং যেহেতু তার সারভাইভাল অ্যাংজাইটি, মুড সুইং-এ খুবই বেশি মেজাজ খারাপ দেখায়।

সারভাইভাল অ্যাংজাইটি বলেই নারী-পুরুষ নির্বিশেষে মানুষের মুড সুইং-এর ইতিহাস- মানুষের সৃষ্টির ইতিহাস এর সমবয়সী। তবুও মুড সুইং বলতেই কেন আমরা নারীর মুড সুইং-কে বুঝি?

এর কারণ ক্ষমতা এককেন্দ্রীকতা, যার ফলে সৃষ্ট নারী পুরুষের মাঝে ক্ষমতার ভারসাম্যহীনতা- সাথে যুক্ত হয় ক্ষমতাবানদের ভোগকেন্দ্রীকতা। ক্ষমতা-কেন্দ্রে ভোগবাদ শক্ত ঘাঁটি গেড়ে বসায় ক্ষমতা সব কিছুকে পণ্য করে ফেলছে। ক্ষমতার সব কিছু, একেবারে সবকিছু বেচতে হবে। তাই ক্ষমতা মুড সুইং বিক্রি করা শুরু করেছে। ক্ষমতার রাজনীতিতে নারীর মুড সুইং কীভাবে পণ্য তা খুঁজে দেখার জন্যই আমাদের এই আলাপ।

আগেই বলেছি মানুষ মাত্রই সারভাইভাল অ্যাংজাইটিতে ভোগে। মানুষের গভীর গহীণে সারাক্ষণ মূলত একই জিগির চলে- এই বুঝি মরে যাই, এই বুঝি মরে যাই- নমস্য তারাশংকরের বিখ্যাত আক্ষেপ- জীবন এতে ছোটো ক্যানে’র পুনরাবৃত্তি? দৃশ্যমান বড় সংখ্যক প্রানীর তুলনায় শারীরিক গড়নে ও সামর্থে হীন অবস্থানের কারণে মানুষ যতটা না জীবিত থাকতে চায় তার চেয়েও বেশি মরার হাত থেকে বাঁচতে চায়। প্রকৃতি তার নিজের খুশিতে মানুষের কনায় কনায় মৃত্যুকে প্রলম্বিত করে করে বাঁচতে চাওয়ার এই বৈশিষ্ট্য দিয়ে রেখেছে। তবে নারীর ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত এই অ্যাংজাইটির সাথে আরো একটি পরত সারভাইভাল অ্যাংজাইটি প্রকৃতি যোগ করে দিয়েছে। নারী আরেকটা মানুষের মানে নারী তাঁর সন্তানের বেঁচে থাকাকেই নিজের বেঁচে থাকা মনে করে। অর্থাৎ সন্তানের সারভাইভাল অ্যাংজাইটি কিছুটা হলেও নারী নিজেও করতে বাধ্য হয়। এটাকে ম্যাটারনাল অ্যাংজাইটি বলা যায়। যখন একজন নারীর মধ্যে সারভাইভাল অ্যাংজাইটি-এর সাথে মেটারনাল অ্যাংজাইটি যোগ হয় তখনই নারী ও পুরুষের মধ্যে মুড সুইং জনিত তফাতটা তৈরি হয়।

তাই যেহেতু আমরা দেখিয়েছি দুই পরতের সারভাইভাল অ্যাংজাইটি, তাই নারীর মুড সুইং মূলত বংশরক্ষার চাহিদার বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। বংশ রক্ষা বা বংশবৃদ্ধি না বলে প্রকৃতির ভাষায় বরং প্রজাতি রক্ষা বা প্রজাতি বৃদ্ধি বললে ধারণাগুলো স্পষ্ট হয়। সেই মুড সুইংকেই ক্ষমতাবানেরা যৌনগন্ধী দ্রষ্টব্যে পরিণত করেছে। নারীর মুড সুইং নিয়ে  হালে এক লাইনের তাচ্ছিল্য মোড়ানো প্রতিবাদ তৈরি করা হয়েছে- ‘‘এক জনের মুড সুইং সামলাতে পারে না, ৭০ জন হুর আশা করে।’’ অথচ “মুড সুইং”  শব্দজোড় এর অন্তর্গত ধারণা এবং ”হুর” শব্দের অন্তর্গত ধারণায় কোনো মিল নেই। ‘‘হুর” মানে হল নিখাদ যৌন সম্পর্কের মানচিত্র- এ ধারণায় বংশবৃদ্ধির কোনো সুযোগ নাই; ফলত বংশরক্ষার তাগিদ থাকার প্রশ্নই আসে না। অন্যদিকে “মুড সুইং” এর সাথে যৌনতার ততটুকুই সম্পর্ক যতটা সম্পর্ক ‘‘ভৌগলিক অবস্থান” এর সাথে যৌনতার রয়েছে। এটুকুই বলা যায় প্রকৃতির তত্ত্বাবধানে প্রজাতি বৃদ্ধির অন্যতম একটি প্রক্রিয়া হল যৌনতা আর প্রজাতি রক্ষার চেষ্টার প্রাকৃতিক উপজাত স্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মুড সুইং।

প্রকৃতির বৈশিষ্ট্য হচ্ছে প্রকৃতি তার নির্বাচিত প্রজাতির সংখ্যা বৃদ্ধি করার পরিপার্শ্ব প্রকৃতি নিজেই প্রস্তুত করে। এই পরিপার্শ্ব প্রস্তুতি প্রজাতি আপেক্ষিক; এক এক প্রজাতির জন্য প্রকৃতি এক এক রকম পরিপার্শ্ব তৈরি করে। প্রকৃতির চোখে তাকালে আমরা দেখবো সব প্রাণী আসলে এক একটি বায়োকেমিক্যাল অবজেক্ট। বায়ো-রিফ্লেক্স আর কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন- এই দুই কার্যবিধি মিলিয়ে এসব বায়োকেমিক্যাল অবজেক্টগুলো জীবন বহন করে। বায়ো রিফ্লেক্স এবং কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন এর বিবেচনায় মানুষের হিসেবে মানুষ মূলত কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন নির্ভর প্রাণী। অপরাপর প্রাণীগুলো বায়ো রিফ্লেক্স নির্ভর বায়োকেমিক্যাল অবজেক্ট। উদাহরণ হিসেবে প্রজনন প্রক্রিয়ার একটি প্রক্রিয়া যৌনতাকে টেনে আনি। মানুষের আজ পর্যন্ত অর্জিত জ্ঞান মতে- প্রায় সব প্রাণীর সংখ্যা বৃদ্ধি করতে প্রকৃতি যৌনতাকে ব্যবহার করে। সব প্রাণীর তুলনায় মানুষের যৌনতা অনেক বেশি কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন নির্ভর। অন্যান্য প্রাণীর যৌনতা বায়ো রিফ্লেক্স নির্ভর। তাই বেশিরভাগ প্রাণী প্রজনন বয়সে কেবল প্রজনন ঋতুতে বা প্রজনন সময় যৌনতা খুঁজে বেড়ায়। মানুষের যৌনতার ক্ষেত্রে সময়ের এমন কোনো সীমা দেখা যায় না। সে কারণেই লোকে ঘৃণা করে বলে, পুরুষ মানুষের চোখ কেবল কাপড় নয় বরং সম্পর্কও ভেদ করে। মানুষের যৌনতার বেশি অংশ মস্তিষ্কে চলমান কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। অন্যদিকে পশুরা যতটা না কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন নির্ভর, তারচেয়েও বেশি পশুর প্রজনন অঙ্গের বায়ো রিফ্লেক্স নির্ভর। অবশ্যই যৌনতার ফলে পশুর মস্তিষ্কেও কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন হয়। আবার মানুষেরও যৌনতার সময় কিছু বায়ো রিফ্লেক্স হয়।

কেবল যৌনতা নয়, মানুষের প্রায় সব ধরনের জীবন কর্মেই কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন এর প্রাধান্য। বলার অপেক্ষা রাখে না, মুড সুইং শুরু হয় কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন দিয়েই- প্রচলিত ভাষায় আমরা বলি হরমোন সিক্রেশন। কেন নারীর মুড সুইং নামের কেমিক্যাল রিঅ্যাকশনকে প্রজাতি রক্ষার বৈশিষ্ট্য হিসেবে চিহ্নিত করা? কারণ নারী-মানুষ প্রকৃতির ম্যান্ডেট মতোই তার বৃদ্ধি করা বংশকে রক্ষা করতে বাধ্য হয়- এই বাধ্যবাধকতা প্রকৃতি তার মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়েছে। বংশরক্ষার প্রেক্ষিত বিবেচনায় মানব সৃষ্টির ইতিহাস এর আনুপতিক বিশ্লেষণ করে একথা বলা যায়- আদিযুগের মা এবং আজকের মা-এর মধ্যে তফাৎ খুব একটা না থাকলেও আদি যুগের বাবা এবং আজকের বাবা’র মধ্যে বংশ রক্ষাকেন্দ্রীক আচরণে অমিল সুস্পষ্ট। আজকের বাবা আর আদিম যুগের বাবা তফাৎ না থাকা তাই অসম্ভবই।

মা সৃষ্টির প্রথম থেকেই জননী এবং পালক উভয় দায়িত্ব পালন করে আসছে। কিন্তু অনিবার্যভাবেই প্রথম থেকেই বাবা জনক হলেও ইতিহাসের অনেক পরবর্তী স্তরে বাবা পালক হয়েছেন। আদিযুগে বংশরক্ষার দায়টা প্রকৃতি মায়ের ঘাড়েই বেশি করে দিয়েছিল। বংশবৃদ্ধির দায় আর বংশ রক্ষার দায় দুইটি ভিন্ন ভিন্ন বিষয়। আমরা এই দুইয়ের পার্থক্য অনুধাবন করব মা-মাছ এবং মা-মুরগির দিকে তাকালে। মা-মাছ ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়। মা মুরগিও ডিম থেকে বাচ্চা ফোটায়। তার মানে এই দুই প্রাণীর বংশবৃদ্ধির প্রক্রিয়াটা মোটামুটি একই রকম বলা যায়। কিন্তু কিছু কিছু ক্ষেত্রে ডিম ফুটে বাচ্চা বের হওয়া মাত্রই এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ডিমপাড়া মাত্রই মা মাছের দায়িত্ব শেষ করতে দেখা যায়। অর্থাৎ মা মাছের প্রতীক হলো কেবল ডিম। অথচ মা মুরগির প্রতীক যুগপৎ ডিম এবং বাচ্চা। সম্ভবত সংখ্যাই এই পার্থক্যের নিয়ন্তা। মা মাছের সন্তান এত বেশি হয়- সংখ্যা বৃদ্ধি করেই তার বংশ বৃদ্ধি হয়ে যায়। কিন্তু মা মুরগির ক্ষেত্রে সংখ্যা বৃদ্ধি করলেই বংশবৃদ্ধি হয় না- বরং বৃদ্ধি পাওয়া বংশ রক্ষা করতে পারলেই কেবল তার বংশ বৃদ্ধি পায়। তাই মা মুরগি অতন্দ্র প্রহরী হয়ে তার বাচ্চাদের পাহারা দেয়- বাচ্চাদের স্বার্থে হিংস্রতম হতে সে সময় নেয় না- সন্তানদের নিয়ে অ্যাংশাসনেসই মা মুরগীকে হিংস্র করে তোলে। সন্তান নিয়ে মায়ের হিংস্রতা তাই লোভ নয় বরং মাতৃত্বের একটি অনিবার্য বৈশিষ্ট, সন্তানকে বাঁচাতে হলে মাকে হিংস্র হতেই হবে।

বোঝা গেল বংশবৃদ্ধি আসলে দুই প্রকারের হয়, যথা- ১. বংশবৃদ্ধি করে বংশবৃদ্ধি এবং ২. প্রজনন করে সন্তান রক্ষার মাধ্যমে বংশবৃদ্ধি। দ্বিতীয় প্রকারের বংশবৃদ্ধি করে বলে, কেবল জন্ম দিলেই চলে না, মানুষকে তার বাচ্চা রক্ষাও করতে হয় বাচ্চার বড় হওয়া পর্যন্ত। মাতৃত্বের কিছু সময় পর্যন্ত কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন বিবেচনায় হিংস্রতার কেমিকেল রিঅ্যাকশন-এ মা-মুরগির হিংস্রতা আর মা-মানুষের হিংস্রতার মাঝে কোনো তফাৎ নাই। কিন্তু মানুষ যেহেতু দুর্বল প্রাণী, মানুষ যেহেতু কেমিকেল রিঅ্যাকশন নির্ভর প্রাণী- তাই মা মুরগির বংশরক্ষার কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন প্রাণীসুলভ হিংস্রতাতে শেষ হলেও, মা মানুষ-এর বংশ রক্ষার কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন প্রাণীসুলভ হিংস্রতাতেই শেষ হয় না। হিংস্রতা আরো জটিল হয়ে মানবিক হিংস্রতায় রূপ নেয়। এই মানবিক হিংস্রতা কেবল আক্রমণাত্মক দৈহিক প্রতিক্রিয়া তথা বায়োরিফ্লেক্স এ সীমিত থাকে না। এই হিংস্রতা মা-মানুষের চিন্তায়ও বিস্তার লাভ করে। সন্তান রক্ষায় মা মানুষ হয়ে উঠে একজন দুশ্চিন্তিত মানুষ, প্রচন্ড অ্যাংশাস। মা মানুষ সারাক্ষণ অ্যাংজাইটি তে ভোগে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের মায়ের দৃষ্টিতে আমরা  সন্তানেরা সারাক্ষণ শুকিয়ে যাই, আমরা সন্তানেরা কখনোই ঠিক মতো কিছু খাই না। ঠিক এই অ্যাংজাইটির কারণেই নবাব সিরাজউদ্দৌলার খালা ঘসেটি বেগম যতোটা না রাজনৈতিক কারণে তারচেও বেশি তার সন্তানের প্রতি অ্যাংশাসনেস থেকেই সিরাজ-বিরোধিতায় জড়িয়ে পড়েছিলো বললে অস্বাভাবিক শোনায় না।

বংশ রক্ষার এই অ্যাংজাইটির দায় হাজার হাজার বছর ধরে বহন করার ফলে এই আ্যাংজাইটি ক্রমে ক্রমে মা মানুষ তথা নারীদের কালেক্টিভ মেমোরি হয়ে যায়। এই অ্যাংজাইটির ফলে মা হওয়ার আগেই নারী হয়ে জন্মানো মাত্রই নারীরা সেই কালেক্টিভ মেমোরিজনিত ম্যাটারনাল অ্যাংজাইটির বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হয়। নারীর ব্রেইনে যখন কালেক্টিভ মেমোরির জন্য দায়ী অংশ গঠিত হয়, সেই গঠনের সাথে সাথে এই অ্যাংজাইটির চিহ্ন স্বয়ংক্রিয়ভাবে ব্রেইনের মধ্যে পুনরুৎপাদন হয়। সেই অ্যাংজাইটিই নারীর ব্রেইনের সাথে পুরুষের ব্রেইনের কালেকটিভ মেমোরিজনিত অন্যতম একটি তফাৎ তৈরি করে। এই অ্যাংজাইটি বা কেমিক্যাল রিঅ্যাকশন আচরণগতভাবে প্রকাশ হয় মুড সুইং হিসেবে।

একজন অ্যাংশাস মা নিজে পুরোপুরি সচেতনভাবে জানেন না তিনি আসলে কী করছেন, কীভাবে করছেন। আমরা জানি একজন মানুষ যখন অ্যাংশাস থাকে সে নিজেও আসলে কী করে চলেছে তা সে বুঝতে পারে না। ঠিক একইভাবে কালেক্টিভ ম্যাটারনাল অ্যাংজাইটির কারণেই মা না হয়েও  নারী অনেক ক্ষেত্রেই এমন আচরণ করে যা সে নারী নিজেও বোঝে না সে কী আচরণ করছে। কবিরা এই ঘটনার বয়ান করেন ‘নারীর মন জানা নাকি ঈশ্বরের জন্যও সম্ভব না’ রেটরিকে। চেতন বা অবচেতনেই একটি প্রাকৃতিক দায়িত্বকে ব্যক্তিগত দায় হিসেবে পরিগণিত করানোর এক কাব্যিক রূপ- যে নেতিবাচক এককেন্দ্রীক ভারসাম্যহীনতাকে ঘিরে এই আলোচনা- তার কাব্যিক উপজাত। মুড সুইং প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত একটা অনিবার্য অত্যাবশ্যক আচরণগত সংকট- যা বংশ রক্ষার কার্যধারার ক্রমিকে আসে। মানুষের বংশ বৃদ্ধি দুই পরতের বংশবৃদ্ধি প্রক্রিয়া- যেখানে দ্বিতীয় পরত তথা বংশরক্ষা একটি সামাজিক কাজ।

বংশরক্ষা প্রক্রিয়ার সাথে যৌনতার সম্পর্ক অতি দূরবর্তী- তাই বংশরক্ষা প্রক্রিয়ার অনিবার্য যে পরিণতি নারী বহন করে তার সাথে যৌনতার সম্পর্কে একই রকম দূরতম সম্পর্ক। কিন্তু ক্ষমতাবানেরা মুড সুইং-কে যৌনপণ্য বানিয়ে ফেলেছে। মুড সুইং ঘটনাকে ‘‘মুড সুইং” শব্দ-জোড় দিয়ে যৌনপন্য বানানোর ইতিহাস সাম্প্রতিক। তবে মুড সুইং ঘটনা-কে যৌনপন্য করার প্রচেষ্টা অনেক আগে থেকেই চলে এসেছে। আমাদের চলচ্চিত্রে বহুল ব্যবহৃত একটি ইংরেজি ভাষার শব্দজোড় ‘‘ওয়াইল্ড ক্যাট”, ১টি হিন্দি ভাষার শব্দজোড় ‘‘জংলি বিল্লি”, একটি বাংলা ভাষায় শব্দজোড় ‘‘বুনোবিড়াল।” যে নারী যত বেশি অবোধ্য বা ব্যাখ্যার অতীত আচরণ করে, সে  নারী ততো বেশি ওয়াইল্ড, তত বেশি কামনার বস্তু। নারীর বিড়াল মার্কা খামচি সিনেমার ভিলেনদের ফেভারিট ফ্লেভার বলে দেখিয়ে হাতাতালি কুড়ানো হয়- দর্শকও হাততালি দেয়। হাল আমলের বাংলা নাটক গুলোতেও দেখা যায় প্রেমিকা প্রচন্ড রকম যুক্তিহীন স্বৈরাচার; রাত আড়াইটার সময় ও প্রেমিকাকে চমচম খাওয়াতে হবে; না খাওয়ালে প্রেমিকা উথাল পাথাল ঝগড়া করে, ব্রেকআপ করে। আবার একটু পরেই প্রেমিকা কাদামাটির চেয়ে নরম আচরণ শুরু করে- এটাই অডিয়েন্স ডিমান্ড। এভাবেই নারীর মুড সুইং-কে পণ্য তথা যৌনপণ্য করে করে বেচা হয়ে আসছে।

যে কথাটা এখন লিখবো, তা আমরা অনেকেই বলি, বাস্তবতার স্পষ্ট ধারণা আমাদের থাকুক আর না থাকুক। কথাটা হলো- ক্ষমতাবানদের দ্বারা নারীকে যৌনপণ্য করার চিহ্ন এটাই প্রথম নয়। একটি সহজপাচ্য উদাহরণ দেই। যুক্তরাষ্ট্রের বর্ণবাদবিরোধী লড়াইয়ের অন্যতম লড়াকু মুখ ইউলিসিস গ্রান্ট-  তিনি যুক্তরাষ্ট্রের ১৭তম প্রেসিডেন্ট। দাস প্রথাকে কেন্দ্র করে ১৫তম প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকনকে হত্যা করে দাসপন্থীরা যখন একটু কোণঠাসা, তখন নির্বাচনের মাঠে ইউলিসিসকে ঠেকানোর জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ভিক্টোরিয়া উডহলকে মাঠে নামানো হয়। নিমিষেই নারী ক্ষমতায়নের জনপ্রিয় প্রতীক হয়ে ওঠা উডহল তার কয় যুগ পরেই অকাট্য প্রমাণসহকারে চিহ্নিত হন প্রতারক হিসেবে- ধরা পড়ে তার পুরো ইতিহাস আসলে প্রতারণার ইতিহাস। প্রমাণ হয় যে ক্ষমতাবানরা উডহলকে নারীর ক্ষমতায়নের পতাকা হিসেবে সামনে এনেছিল ছদ্মবেশ ধারণের মুখোশ তৈরি করতে। তারা নিজেরা ছিল ভয়াবহ রকম নারীবিদ্বেষী। হালে ভারতের ইতিহাসের প্রথম নারী অর্থমন্ত্রী নির্মলা একের পর এক নীতিমালা দিয়ে নারী দমন করে এমন অর্থনৈতিক পদক্ষেপ নিচ্ছেন তা সে ক্ষমতাসীন দলের নারী বিদ্বেষের সমান্তরাল বৈ আর কিছু নয়। ক্ষমতাবানেরা এসব করে নারীদের মধ্যে একটা ফলস সেন্স অব এমপাওয়ারমেন্ট দিয়ে উল্টো নারীর মর্যাদা কৌশলে অনায়াসে হানি করে।

ইতিহাসের তেমন প্রেক্ষাপটে ক্ষমতায়ন শব্দটার শানে নযুল দুইভাবে করা যায়- প্রকৃত অর্থেই ক্ষমতাহীনকে ক্ষমতাবান করা আর ভণ্ড অর্থে ক্ষমতাশালীকে ক্ষমতাহীন ঘোষণা করে তাকে ক্ষমতাবান করতে চাওয়ার ছল করা- যার ফাঁদে পড়ে মূলত বিদ্যমান ভিক্টিমের ক্ষমতাকে অগ্রাহ্য করা হয়, অবমাননা করা হয়, ক্ষমতা তাত্ত্বিকভাবে কেড়ে নেয়া হয়।

নারীর ক্ষমতায়নে ধারণায় এই দুই ধরনের শানে নযুল প্রতিযোগিতা করে। নেতিবাচক দ্বিতীয় শানে নযুল কীভাবে কাজ করে তার আভাস আগেই দেয়া আছে। সে হলো মানুষের প্রজাতি বৃদ্ধি এক মিশ্র প্রক্রিয়া- যাতে বংশ সংখ্যায় বৃদ্ধি করা হয়ে এবং লালন পালনে বংশ রক্ষা করে প্রজাতি বৃদ্ধি করা হয়। প্রজাতিগতভাবে সন্তান লালন বংশবৃদ্ধিতে সবচেয়ে সময়সাধ্য কাজ গুরুত্বপূর্ণ ধাপের একটি, প্রথমটি জন্মদান- সেও নারীর-ই ভার। মানুষের এরপরের গুরুত্বপূর্ণ কাজ খাদ্য প্রস্তুতি। আদিম মানুষ যখন খাদ্য সংগ্রহের স্তর থেকে খাদ্য প্রস্তুত স্তরে প্রগত হল, তখন খাদ্য প্রস্তুতি মানবসমাজের জন্য অনিবার্য হয়ে ওঠে। গৃহে অবস্থানের ফলশ্রুতিতে সন্তান পালনের পাশাপাশি খাদ্য প্রস্তুতির প্রতীক হয়ে গেল নারী। বিখ্যাত গ্রিক দার্শনিক ফয়েরবাখের-  “মানুষ তা-ই যা সে খায়”, উক্তিটির চেয়ে  সুস্পষ্ট কোনো উক্তি, খাদ্য প্রস্তুতির গুরুত্ব বোঝাতে পারে বলে আমি খুঁজে পাইনি।

তার মানে দাঁড়ালো মানুষ প্রজাতির অস্তিত্ব রক্ষায় তিনটি সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজের মধ্যে দুইটি নারীর এখতিয়ারে গেলো- সন্তান পালন আর খাদ্য প্রস্তুতি। পুরুষ অপর সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজ খাদ্য সংগ্রহে ব্যস্ত হলো। কেবল ২:১ বিবেচনাতেই দৈহিক শক্তি সংরক্ষণে বেশি সুযোগ পেলো পুরুষ। সাথে আবার দৈহিক শক্তি উদ্বৃত্ত থাকার সুযোগে দৈহিক শক্তির নিক্তিতে পুরুষ এগিয়ে গেল। অন্যদিকে ঘর পুরুষের আশ্রয়স্থল এবং বাহির কর্মস্থল হলেও, নারীর জন্য ঘর একইসাথে আশ্রয়স্থল ও কর্মস্থল হয়ে উঠলো। ফলে পুরুষ আশ্রয়স্থলে অবসর চর্চা করার কিংবা অবসর চর্চাকে ক্ষমতায় রূপান্তরের অবকাশ পেল। নারী অবসর হয়তো পেতো, কিন্তু সে অবসরকে ক্ষমতায় রূপান্তরের অবকাশে পেত না। ফলে ক্ষমতার উপর নিচ তলা তৈরি হয়ে স্বাভাবিকভাবেই পুরুষ উপরিতলে নারী নিচতলে ঠাঁই পেল; তৈরি  হলো, প্রকট হলো ক্ষমতার এককেন্দ্রীক ভারসাম্যহীনতা।

অবকাশকে আরও রঙিন করতে গিয়ে কিছু ক্ষমতাবান পুরুষ হেরেম বানালো। মজার জায়গা এই হেরেম- যেখানে পুরুষ অবকাশ যাপনে গেলেও, সেখানে নারীর যাওয়াটা হতো কর্মের খাতিরে। হেরেমের নারীদের জন্য হেরেম ছিল কর্মস্থল। ক্ষমতাবান পুরুষেরা হেরেমের স্বাদে বন্দী হয়ে গেল- হয়ে উঠলো হেরেমকামী পুরুষ। হেরেমকামী পুরুষেরা মানব সভ্যতা রক্ষায় পূর্বোল্লিখিত তিন কাজের দুই কাজ করা নারীকে আরো কোণঠাসা করতে নারীর সে দুই কাজকে অবমাননা করা শুরু করল। মূলত ক্ষমতাবান হেরেমকামী পুরুষ পূর্বোল্লিখিত ক্ষমতায়নের নেতিবাচকরূপ- ছলনা ব্যবহার করতে লাগলো। নারীর সন্তান জন্মদান অশৌচ কাজ হিসেবে চিহ্নিত করে তাকে আজঘর, আঁতুর ঘরের শরণার্থী করলো। রান্নাবান্না কোন কাজের মধ্যে ধর্তব্যই আর রইলো না। এভাবে ক্ষমতার অবমাননা করার মাধ্যমে ক্ষমতাশালী নারীকে নিজেকে ক্ষমতাহীন ভাবতে বাধ্য করে ক্ষমতাহীন করা হলো। নারীর ক্ষমতাকে নারীর মনস্তত্বে অক্ষমতা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা হলো। মনন মগজে নারীকে ক্ষমতাহীন করে নারীকে নারীর নিকটই অসহায় হিসেবে গণ্য করিয়ে দেয়া হলো। নিজের কাছেই অসহায় হিসেবে চিহ্নিত হওয়া নারীকে শেখানোর চেষ্টা করা হলো পুরুষের মতো কাজ করতে পারলেই নারীর ক্ষমতায়ন- নারীর নিজের মতো করে নিজের কাজ করলে সে সমাজের তলানিতেই পড়ে থাকবে। এ শেখানোর ভারটা যারা নিল, সেই পুরুষদের একটা অংশ ছিল হেরেমকামী পুরুষ, আর বাকিরা ছিল শ্রমিক শোষক পুরুষ- নারী তাদের কাছে সস্তা শ্রমের মেশিন মাত্র- ক্ষমতায়নের স্বপ্ন দেখিয়ে এরা মূলত সস্তায় হাতিরঝিলে বিজিএমইএ ভবন গড়তে যায়। নারীকে ফলস সেন্স অব এমপাওয়ারমেন্টের ফাঁদে ফেলে শোষণ আরও দীর্ঘস্থায়ী করা হলো, এর সাথে শোষিতের বঞ্চনা-বোধ’কে বারে বারে মিথ্যে প্রশংসা শুনিয়ে শুনিয়ে প্রাপ্তি-বোধ এ রূপান্তর করা হলো। যার ফল হলো আরও নিরাপদে নারীদের ঠকানো চলবে আরও বহু সময়।

হেরেমকামী ক্ষমতাবান পুরুষরা তাই যখন নারী ক্ষমতায়নের নাম জপে, তখনই তাদের সন্দেহ করতে হয়। এ সন্দেহ অমূলক নয়- প্রমাণ অতীতের ভিক্টোরিয়া হল আর হালের নির্মলা ইনসিডেন্টদ্বয়।

হেরেম চরিত্রের ক্ষমতাবানেরা এখন মুড সুইং-কে যৌনপণ্য আর নারীকে ঈশ্বরের অবোধগম্য যখন প্রচার দেয়, সেটাও ফাঁদ। নারীর মুড সুইং সংক্রান্ত আলাপে খুবই স্পষ্ট, এটি কোন যৌনগন্ধী বিষয় নয় বরং প্রকৃতিপ্রদত্ত প্রজাতি রক্ষার দায়িত্বের প্রতিক্রিয়ার ফলে সৃষ্ট কালেক্টিভ মেমোরি ঘটিত সারভাইভাল অ্যাংজাইটি। মুড সুইং পুরুষের যখন হয় আমরা তাকে চিনে নেই ক্ষমতার তেজ হিসেবে, বসের ক্ষমতার ঝাল হিসেব- কখনোই মুড সুইং নয়।  মুড সুইং বলতেই নারীর উগ্র মেজাজ, এমন ধারণার মাধ্যমে মুড সুইং শব্দবন্ধের জেন্ডার বায়াস স্টেরিওটাইপিং করা হলো। এটা আসলে এক ধরণের কনসেপচুয়াল শেমিং। অনিবার্য মুড সুইং-কে নেতিবাচক, আকর্ষনীয় দেখিয়ে আসলে নারীকে মুড শেমিং করা হয় বডিশেমিং এর মতো। এই শেমিং পরোক্ষ, এই শেমিং অবচেতন শেমিং। পরোক্ষ বা অবচেতন শেমিং বুঝতে স্মরণ করি জনপ্রিয় ম্যাগাজিন অনুষ্ঠান ”ইত্যাদি”র নানা-নাতি অংশ। এতে নানার বেঢপ দৈহিক স্থুলতা এবং নাতির খর্ব আকৃতি আমাদের অবচেতনে প্রভাব ফেলে এটা অস্বীকার করার জো নেই। এই যে আমরা অবচেতনে স্থুলতা, খর্বতা নিয়ে আনন্দ পাই এটারেই পরোক্ষ বা অবচেতন বডি শেমিং বলা যায়।

পয়সার টেষ্টে এবং প্রায়োরিটির ধরণ বিচারেও ধরা পড়ে প্রচলিত মুড সুইং ধারণায় যে মুড সুইং-কে আসলে পণ্যই বানানো হচ্ছে। মুড সুইং-এর আলাপগুলোতে মনে হবে মুড সুইং কেবল উচ্চবিত্ত ও মধ্যবিত্ত নারীদের হয়। নিম্নবিত্ত নারীদের, বস্তি মেয়েদের, কাজের বুয়াদের, রাস্তার ঝাড়ুদার নারীদের, রোহিংগা নারীদের যে মুড সুইং হতে পারে তা আমাদের কল্পনাতেও আসে না। পথনারীদের, পতিতাদের নিয়ে কতো রকমের গবেষণা হয় অথচ আজ পর্যন্ত পথনারীদের, পতিতাদের মুড সুইং নিয়ে কোনো গবেষণা দেখিনি। অথচ এদের সারভাইভাল স্ট্রাগল সবচে ভয়ংকর বলে মেটারনাল সারভাইভাল অ্যাংজাইটি এদের মাঝে সবচে ভয়ংকর রূপ নেয়।

নারীর মুড সুইং নারীকে প্রকৃতি প্রদত্ত ক্ষমতার চিহ্ন, প্রকৃতি মানুষ রক্ষার ক্ষমতা নারীকে অর্পণ করেছে বলেই নারীর মুড সুইং হয়। এই মুড সুইং নিয়ে ক্ষমতাবানদের নতুন সার্টিফিকেট অগ্রাহ্য করাই হবে তাদের বিরোধিতা করা আর তাদের বিরোধিতা করা বাঞ্চনীয়।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]