‘‘এখন বিয়ে না করলে পরে ভালো ছেলে পাবে না’’
তাসনীম সূচনা।। খুব ছোটবেলায় আমরা অধ্যবসায় বিষয়ে বাংলা রচনা লিখতে গিয়ে প্রায়ই একটা বাক্য লিখতাম – মানবজীবনে অধ্যবসায়ের গুরুত্ব অপরিসীম। আমাদের এই কথার গুরুত্ব কাগজে কলমে শেখানো হতো সেই ছোটবেলা থেকে। আজ এতদিন পরে এসে এই কথা বলার অবশ্য ভিন্ন একটা কারণ রয়েছে। আমাদের সমাজ নারীর জীবনে বিয়ের গুরুত্ব যে অপরিসীম তা প্রতিনিয়ত নারীকে শেখায়। তবে তা কাগজে কলমে নয়। কখনও পরিবার, কখনও বা আত্মীয়, আবার কখনো বা সহকর্মীরা নানা রূপে নানাজন একজন নারীকে সেই ছোটবেলা থেকেই অনুধাবন করতে শেখায় বিয়ে ছাড়া গতি নেই নারীর।
একটা সন্তান যখন পরিবারে বড় হতে থাকে তখন তাকে তার স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে যেতে শেখানো হয়। সন্তান এটা ভেবেই বড় হতে থাকে যে এই স্বপ্নপূরণ করতে পারলে সে জীবনে সফল হবে। কিন্তু আসলেই কি তা হয়? না। হয় না। যদি সে নারী হয়।
ধরুন কোনো নারী তার জীবনে কর্মক্ষেত্রে সফল। কিন্তু সে যদি অবিবাহিত হয় তখন সমাজ তাকে কীভাবে দেখে? ‘‘বেশি শিক্ষিত দেখে জামাই পায় না। এজন্যই মেয়েদের বেশি শিক্ষিত হতে নেই” – এমন বিরূপ মন্তব্য তাকে প্রায়ই শুনতে হয়। কখনো তাচ্ছিল্যের স্বরে বা কখনো করুণার স্বরে। আবার ধরুন কোনো বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া মেয়েকে প্রায়ই শুনতে হয় – ” ভালো সম্বন্ধ আসার এটাই ভালো সময়। এখন বিয়ে না করলে পরে ভালো ছেলে পাবে না।”
এভাবে পরিবার সমাজ আত্মীয়স্বজন একজন মেয়েকে পদে পদে বুঝিয়ে দিতে থাকে জীবনে বিয়ে কতটা গুরুত্বপূর্ণ!
আবার ধরুন, সেমিস্টার ব্রেকে বন্ধুরা ঘুরতে যাবে সবাই মিলে। চায়ের টং-এ আডডায় বন্ধুদের সাথে বসে পাহাড় – সমুদ্র জয় করার স্বপ্নে বিভোর মেয়েটির হঠাৎ মনে পড়ে যায় মায়ের কথা – ‘‘এখন কোথাও ঘুরতে যেতে হবে না।বিয়ের পরে স্বামীর সাথে যেও।’’ প্রকৃতির সান্নিধ্যে হারিয়ে যাবার স্বপ্ন তার স্বপ্নই থেকে যায়।
আমাদের বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই উচ্চশিক্ষার জন্য দেশের বাইরে যাবার স্বপ্ন দেখে। দিন দিন এই বাইরে পড়তে যাবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কিন্তু আমাদের পরিবার বা সমাজ একজন অবিবাহিত মেয়েকে দেশের বাইরে পড়তে যাবার বিষয়কে এখনো বাঁকা চোখে দেখে। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে এখনো বিয়ে হয় নি এমন মেয়ে বিদেশে গেলে অনেক রকম কথা শুনতে হয়। কিন্তু যদি কোনো ছেলে যায় তখন বিষয়টা একেবারেই ভিন্নভাবে দেখা হয়। মেয়ে হলে তাকে শর্ত জুড়ে দেওয়া হয় বিয়ে না করে দেশের বাইরে পড়তে যেতে পারবে না। কি অদ্ভুত সব দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের!
আমরা মেয়েরা হয়তো ছোটবেলায় কম বেশি সবাই একটা কথা শুনে অভ্যস্ত – মেয়েটা ঘরের সব কাজ পারে। কী লক্ষী! বিয়ের পর এই মেয়েকে নিয়ে কোনো চিন্তা নেই। আর যদি কেউ আমার মত উড়নচণ্ডী ভবঘুরে হয়েছে তো শেষ! সবাই বলতে বলতে কান পচিয়ে দেবে যে – বিয়ের পর কপালে শনি আছে। এত শত কথার ভিড়ে মেয়েরা যদি নিজেদের আত্মনির্ভরশীল প্রাণী না ভেবে চার হাত পেয়ে পরজীবী প্রাণী ভেবে বসে তবে কি খুব দোষের হবে? কারণ জন্মের পর থেকে বড় হওয়া অবধি জীবনের পদে পদে তাকে স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয় – সে স্বাধীন স্বকীয়ভাবে কোনো স্বপ্ন দেখতে পারে না। জন্ম যেন তার বিয়ে করতেই! সমাজ পরিবার একটি ছেলেকে বেড়ে ওঠার সময় কি এগুলো মনে করিয়ে দেয়? না। দেয় না। তবে শুধু মেয়েদের ক্ষেত্রেই কেন? আমার কথায় এটা ভেবে বসার কারণ নেই যে আমি বিয়েবিমুখ। আমি একদমই তা নই। কিন্তু এই যে মেয়ে ও ছেলেকে বড় করে তুলতে যে পরিবারের দ্বিমুখী আচরণ, আমি এর পক্ষপাতী নই। একটি শিশুকে মানুষ হিসেবে নিজেকে নিজে মানুষ ভাবতে শেখান, মেয়েমানুষ হিসেবে না। মানুষ হিসেবে বেড়ে উঠতে দিন। নিজের স্বপ্ন, ইচ্ছা, ভালোলাগাকে মেলে ধরতে দিন। যেন তার মনে কখনো এমন প্রশ্ন না জাগে – ‘আমার ভাই এটা করতে পারে কিন্তু আমি কেন পারবো না। আমার বন্ধু এটা করতে পারছে কিন্তু আমি কেন পারব না?’ আমাদের সমাজে জীবনে কখনো না কখনো এমন প্রশ্ন হয়তো সব মেয়ের মনেই এসেছে।
হয়তো অনেকেই আমার সাথে একমত হবেন না। না হতেই পারেন। অনেকেই সেই পুরোনো অদ্ভুত মিথ্যে যুক্তিটা দেবেন- ছেলে মেয়ে এক না। তাদের উদ্দেশ্যে আমি বলতে চাই- ক্ষুধা যেমন ছেলে বা মেয়ের ক্ষেত্রে ভিন্ন নয় তবে স্বপ্ন কেন ছেলে মেয়েতে ভিন্ন হবে? মানুষ মাত্রই তার ক্ষুধা থাকবে, তেমনি মানুষ মাত্রই তার স্বপ্ন থাকবে। খাবার মৌলিক চাহিদা। এটি মানুষকে বাচিঁয়ে রাখে। স্বপ্নও মানুষকে বাচিঁয়ে রাখে। শুধু একটি শরীরকে অন্যটি মনকে।কারো গুরুত্ব কোনো অংশে কম না।
ব্রায়ান ডাইসন জর্জিয়া টেকনিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তার এক ভাষণে বলেছিলেন “স্বপ্নপূরণই জীবনের একমাত্র লক্ষ্য নয়। তাই বলে, স্বপ্নকে ত্যাগ করে নয়, তাকে সঙ্গে নিয়ে চলো। স্বপ্ন ছাড়া জীবন অর্থহীন”।
তাই নারীর স্বপ্নগুলোতে পাখা লাগিয়ে মেলে ধরতে দিন। নারীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি বদলান। আর জীবনসঙ্গী তার জীবনের প্রয়োজনে বেছে নিতে দিন। একে নারীর জীবনের সফলতার সূচক করে তুলবেন না।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]