শো-অফের সংসারে পুতুল না হয়ে অধিকার বুঝে নিন
প্রিয়া দেব ।। আমাদের আশপাশ দু’য়েকদিন আগেও উত্তাল ছিলো একটা প্রাণবন্ত চমৎকার মেয়ের মৃত্যু নিয়ে, কিন্তু যেহেতু আমরা সহজেই সব ভুলে যাই সেজন্য এই মৃত্যু কিংবা প্রকৃত অর্থে খুনটাও আমাদের তেমন একটা ব্যস্ত রাখতে পারে নি। আমরা অন্য ইস্যু নিয়ে চিন্তা করতে বসে গেছি। কিন্তু এভাবেই কি বার বার আমরা থেমে যাই না?
বাংলাদেশে কী পরিমান মেয়ে স্বামীর ঘরে নির্যাতনের শিকার হন সে পরিসংখ্যান নতুন করে খোঁজার দরকার পড়ে না। আমি আমার পত্রিকা পড়া শুরু করার বয়স থেকে এখন পর্যন্ত এমন কোনোদিন পাইনি যে দিনে নারী নিপীড়নের কোনো সংবাদ পত্রিকাতে ছিল না। আমাদের আশেপাশে প্রচুর মেয়ে এই পারিবারিক সহিংসতা নামক ভয়াবহ জিনিসটার শিকার। আমরা আফসোস করি যখন এদেশের নামী দামী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনো মেয়েরা মারা যান তখন, আমরা চোখের জল ফেলে ভাবি একটা দামি প্রাণ এভাবে নষ্ট হলো, জাতি হিসাবে এই উঁচু নিচু জাতভিত্তিক দুঃখ আমরা জন্ম থেকেই পাই। কিন্তু সমস্যা সেটা না, সমস্যা হচ্ছে এই খুনগুলোকে আমরা হালকা ভেবে নিয়েছি, আমরা ধরেই নিয়েছি এভাবে পতি দেবতাদের হাতে মেয়েরা মার খাবেন, এরপর একদিন মরবেন এবং সেটা সুইসাইড বলে চালানোর চেষ্টা করা হবে। এরপর কদিন মিডিয়া এবং জনগন চিল্লাচিল্লি করে ঘুমিয়ে পড়বেন, তারপর সেই শীতঘুম আবার কোনো মেয়ের খুন হবার খবরে ভাঙবে। কি সুন্দর প্যাটার্ন তাই না?
কয়েক বছর আগে সিলেট শহরে একজন মহিলা ডাক্তার ঠিক এভাবেই স্বামী আর শ্বশুরবাড়ির মানুষের নির্যাতনে মারা গিয়েছিলেন, তার খুনটাও আত্মহত্যা বলে চালানোর চেষ্টা হয়েছিল, ওই ডাক্তারের শাশুড়ির খুব ইচ্ছে ছিলো বউমা ডাক্তারি না করে তার মুরগীর ফার্ম দেখাশোনা করবে। যখন বউমা চাকরি ছাড়লো না তখন সারাদিন কাজ করে ক্লান্ত হয়ে বউমা ফিরলেই তাকে মুরগী সামলাতে শাশুড়ি পাঠিয়ে দিতেন। এই ঘটনার পর আমি ভেবেছিলাম খুব সম্ভবত এদেশের শ্বশুরকূলের ডাক্তার-ইঞ্জিনিয়ার বউদের হাতের তরকারি বেশি স্বাদের মনে হয়, এইসব শিক্ষিত বউয়েরা স্বামীর হাতে মার খেলে একটা বিরাট সুখ আসে মনে মনে, মানে অনুভবটা এরকম যে ‘‘দেখ ভাই শিক্ষিত নারীকেও আমি কেমন মাইরের উপর রাখার ক্ষমতা রাখি”!
আমি আস্তে আস্তে দেখলাম এই নিপীড়ন শুধু শিক্ষা দেখে হয় না, প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাগুলো দেখলে বোঝা যায় এই দেশে মেয়েমানুষের জীবন আসলে খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ না। আমার এগারো বছর বয়সে আমার পাশের বাড়ির এক গরীব পিতামাতার কন্যাকে বিয়ের এক মাসের মাথায় পিটিয়ে মেরে ফেলেন ননদ আর শাশুড়ি, গ্রাম্য সালিশে কন্যার পিতা ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে মৃতা কন্যার শ্বশুরবাড়িকে মামলা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফিরে আসেন। আমি সেদিন থেকেই বুঝতে শিখেছি এই সমাজে একজন নারী হিসাবে আমি ছাড়া আমাকে নিয়ে ভাবার জন্য দ্বিতীয় কোনো মানুষ আসলে নেই।
আমি শিক্ষিত মা বাবাকে নিজের মেয়ে শ্বশুড়বাড়িতে নির্যাতনের শিকার হয়ে মরে যাওয়ার পর কেইস করতে দেখেছি, কেঁদে ভাসিয়ে ফেলতে দেখেছি, কিন্তু আমি আরো দেখেছি ওই মা বাবাই মেয়ে মরার আগে মেয়েকে প্রতিনিয়ত চাপ দিয়ে গেছেন সংসার করার জন্য, মার খেলে জাতীয় ডায়ালগ “স্বামীরা ওইরকম একটু গায়ে হাত তুলেই থাকেন” বলতে শুনেছি। এইজন্য আজকাল কোনো মৃত মেয়ের মা বাবার আহাজারি দেখলে আমার খারাপ লাগে না বরং হাসি প্রায় খুব। এই মা বাবাকে ডিভোর্সি মেয়ের চেয়ে মৃত মেয়ে বেশি সম্মানজনক ও সুবিধাজনক অবস্থায় রাখে। এইজন্য আমি চাই এ দেশের প্রতিটা মেয়ে নারী নির্যাতনের কেইসগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়ুক, এরা জানুক শুধু একটা কাগজে সই করে বিয়ে করা হয়েছে বলে সে কীভাবে পুতুল হয়ে যায় সমাজের। এই সমাজ একটা মেয়ে বেশি হাসলে বকুনি দেবে, দুনিয়া ঘুরতে চাইলে চোখ রাঙাবে, নারী নির্যাতনের হাজারটা উদাহরণ সামনে এনে নিজের অধিকার বুঝে নিতে চাইলে “এইসব কেসতো ভুয়া” বলে মাতব্বর সাজবে, এই সমাজ একজন মাকে শেখাবে কীভাবে সমাজের বানানো সীমারেখার ভেতরে টিকে থাকতে হবে, কীভাবে শুধু মা বলে স্যাক্রিফাইস করে বাঁচতে হবে, এই সমাজ একটা মেয়ের জন্ম থেকে মরে যাওয়া অব্দি নিজের বানানো সব শেকল নারীর পায়ে পড়াবে, এবং সংসার নামক সোনার হরিণ প্রাপ্ত কোনো নারী যখন সংসারের প্রভু স্বামীর নির্যাতনে মরে যাবে তখন সেই সমাজ ব্যস্ত থাকবে অন্য কোনো ভীষণ গুরুত্বপূর্ণ কাজে।
এজন্য আমি চাই মেয়েরা নিজের অধিকার বুঝে নিক, মায়েরা নিজের মেয়েকে বাঁচতে শেখাক, এই আইন, রাষ্ট্র, সমাজ কেউই নারীর অনুকূলে না। এজন্য নারীকে স্বার্থপর হতে হবে, ভীষণ রকম স্বার্থপর। একটা মেয়ে ভালো পড়াশুনা করে, ভালো চাকরি করেও কেন স্বামী নামক প্রভুর মার খেয়ে খেয়ে বাঁচবে এ নিয়ে মেয়েরা প্রশ্ন তুলুক, ডিভোর্স দিতে চাইলে যেসব নোংরা মিডিয়া ফলাও করে লেখে – “শিক্ষিত নারীরা ডিভোর্স দেন বেশি” – এইসব মিডিয়ার মুখে লাথি বসাক। যতক্ষন পর্যন্ত একটা মেয়ের পার্টনার মেয়েটিকে একজন মানুষের প্রাপ্য পূর্ণাঙ্গ দাম দেবে না ততক্ষন এ দেশের প্রতিটা মেয়ে সংসার ছাড়তে থাকুক। আমি কখনোই চাই না লড়াইয়ে ভূমিকা একা একটা মেয়ের হোক। বদল এই সমাজ, পুরুষ, দেশ সবার হোক। কিন্তু এই বদলটা আনার জন্য আওয়াজ কিন্তু মেয়েদেরকেই তুলতে হবে, বোঝাতে হবে নিজেদের স্বাধীন সুস্থভাবে বাঁচার আকুতি, পায়ে দলতে হবে সামনে আসা পুরুষতান্ত্রিক সমাজের স্টকহোম সিনড্রোমে ভোগা মানুষদের। কারণ যতদিন আমরা মেয়েরা আওয়াজ তুলবো না, ততোদিন এই সমাজ ভেবে নেবে মেয়েরা দাসী হয়েই বাঁচতে চায়। এইজন্য মেয়েরা শিক্ষিত হোন এবং সেই শিক্ষাকে কাজে লাগান, অনুভব করুন কত প্রান্তিক নারী প্রতিদিন মার খেয়ে খেয়ে রোজ একবার করে মরছে। আজকে শো-অফের জন্য ব্যবহৃত সংসারের পুতুল হওয়ার চেয়ে বরং চলেন আমরা মানুষ হই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]
খুব ভালো বলেছেন, অধিকার আদায়ে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে। পাশাপাশি দায়িত্বও পালন করতে হবে