November 21, 2024
সাহিত্যফিচার ৩স্যাটায়ার

একটি ক্যানডিড ফটোর জন্য

মাসকাওয়াথ আহসান।।

নানা কাজের ভীড়ে ‘একটি ক্যানডিড’ ফটোর খোঁজে হন্নে হয়ে ঘোরে সারা, মোনা, তানিয়া, ফারহানা, প্রীতি এমনকী রাবা। অনেক কাজ তাদের; পেশাগত কাজ, সংসার সামলানো, অসুস্থ মা আর শাশুড়িকে একইসঙ্গে দেখভাল করা। সুপার উইমেন যাকে বলে। দেবী দুর্গার মতো দশহাত, রাবণের মতো দশ মাথা। কিন্তু যেখানে যায়, যাই করে, কী জানি কিসেরও লাগি প্রাণও করে হায় হায়! সেটি আর কিছুই নয়, একটি ক্যানডিড ফটো, ফেসবুকে ও ইনস্টাগ্রামে আপলোড করার উপযুক্ত ছবি; যেখানে নিজেকে কম হেলদি দেখাবে, মুখমণ্ডলের ডাবল চিন একেবারেই দেখা যাবে না, চোখের তলায় কালি যেন একেবারেই দৃষ্টিগ্রাহ্য না হয়। বিউটি অ্যাপ্লিকেশানে ফেলে নিঁখুত ছবি বের করে আনার এই যে বিশাল কর্মযজ্ঞ, এ আর কিছুই নয়, সোশ্যাল মিডিয়ায় মন্তব্যের ঘরে প্রাণের সখিদের ‘কিউট লাগতেছে, উমা কী সুন্দর, কানের দুলডা কই থিকা কিনছো, যা মানাইছে’; ইত্যাদি শোনার জন্য। ছেলেরা কেউ এসে মন্তব্য করলে মুড ভালো থাকলে থ্যাংকু; আর মুড খারাপ থাকলে ফ্রেন্ডলিস্ট থেকে অর্ধচন্দ্র।

নারী অধিকারের পক্ষে দশটি স্টেটাস দিয়ে প্রখ্যাত ফেমিনিস্টদের বিএসটি আই সিল পাওয়া পুরুষ হলে থ্যাংকু, আর বিভিন্ন ইস্যুতে কুতায় নারীবাদীরা বলে চিক্কুর দেয়া পুরুষ হলে ‘অর্ধচন্দ্র’। নারী ছবিতে লাইক দেবার জন্য রীতিমত ‘রামের অগ্নিপরীক্ষা’।

আর বেচারা স্বামী তো অফিশিয়াল ফটোগ্রাফার। ছবি খারাপ তো মুখ ঝামটা। ‘একটা ভালো ছবি তো কোনদিন তুলতে পারলানা, অকম্মা কুনহানকার।’ আজকাল বিবাহের আগে ফটোগ্রাফির কোর্স করে আসা অবশ্যকর্তব্য।

ক্যানডিড ফটো আপ্পিদের আবার থাকে বিভিন্ন অকেশনে সারপ্রাইজ দেবার ও নেবার নেশা। মোনার বার্থডে উপলক্ষে বোন সারা হোয়াটস অ্যাপে সারপ্রাইজ বার্থ ডে পার্টি গ্রুপ খোলে। মোনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের ফোন নম্বর জোগাড় করে দিতে হয় মোনার হাবিকে। তাকে পুরো সারপ্রাইজ নাটকে বিবেকের চরিত্রে অভিনয় করতে হয়। বার্থডে সামনে রেখে সবার মনের মধ্যে একটা ক্যানডিড ফটোর অপেক্ষা কাজ করতে থাকে।
নির্ধারিত দিনে কোন একটা রেষ্টুরেন্টে মোনাকে নিয়ে আসার দায়িত্ব তার হাবির। হোয়াটস এপে ঘন ঘন রিমাইন্ডার আসে, এখন কোথায়, কতক্ষণ লাগবে, গেস্টরা সবাই রেডি, রেস্টুরেন্টের গেটে এসে মেসেজ করলে রেডি হয় সারপ্রাইজ দেয়ার কোরাস শিল্পীরা। জন্মদিন পালন কক্ষে প্রবেশ মাত্র ‘হ্যাপি বার্থ ডে টু মোনা’ গেয়ে ওঠে সবাই। ক্যানডিড ফটো তুলতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে বাধ্য স্বামীর দল, ছবি মোনারই তুলবে কিন্তু নিজের স্ত্রীর ক্যানডিড ফটোও থাকা চায়।

গল্পগুজবের ফাঁকে ফাঁকে ‘ক্যান্ডিড ফটো’ উঠলো কীনা সেই টেনশন কাজ করে সারা, মোনা, তানিয়া, ফারহানা, প্রীতি এমনকী রাবা’র মনে। গল্পে মনোযোগ থাকে আবার থাকেও না। মাস্ক পরায় লিপ গ্লস ফিকে হয়ে এলে ওয়াশরুমে গিয়ে রিফ্রেশ করে আসতে হয়।

সারাবছর যারা ফেসবুকে লেখে নারীর অলংকার পরিধান আসল শেকল আর বেড়ি পরা, নারীর সাজগোজ হচ্ছে পুরুষের সামনে নিজেকে পণ্য করে তোলা; সারপ্রাইজ পার্টিতে আসার সময় আর তা মনে থাকে না; প্রত্যেকেই এক একজন ক্লিওপেট্রা, আফ্রোদিতি সেজে চলে আসে।

ক্যানডিড ফটোর দিকে মন পড়ে থাকায়, গল্পগুলো ছেঁড়া ছেঁড়া হয়, বিচূর্ণ হাহাহিহির অ্যানাসথেসিয়া অপারেশান টেবিলের মতো যেন সে কোলাহল। জন্মদিনের কেক কাটার সময় স্বামী প্রবরকে নিয়ে এসে মোনার পাশে দাঁড়াতে বাধ্য হতে হয়। এগুলো পোস্টমডার্ন রিচ্যুয়াল। নিজেদের ঢং নিজেদের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখবে না তারা। এই ঢং এর সং হবার নিয়তি যেন হাবির।

পার্টি শেষ হয়ে গেলে গাড়ির বনেটে গিফট তোলার দায়িত্ব স্বামী ও ভাইয়ের। বাসায় ফেরার পথে পার্টির অকুন্ঠ প্রশংসা করাটা মাস্ট। সবশেষে বাড়ি ফিরে সেই ভয়ংকর প্রশ্ন, আমার ক্যানডিড ফটো কই, কী সব ছাতার ছবি তুলছো। দেখে শুনে একজন রুচিশীল শিক্ষিত আধুনিক মেয়ে বিয়ে করলেও বিশেষ মুহূর্তে সে এমন করে চেঁচাবে যে রাস্তা থেকে সে সি শার্পের গলার আওয়াজ শোনা যাবে। ভাবতে অবাক লাগে রবীন্দ্রনাথ তাঁর ছোট গল্পে এতো নীচু স্বরের শৈল্পিক নারী কোথায় পেয়েছিলেন, নাকি তখন ‘একটি ক্যানডিড ফটোর বাতিক ছিলো না’ জন্য তার হাসির শব্দ রিনরিনিয়ে উঠতো, রাগের বীণা ঝরণাধারায় বইতো। কোথায় সে সাদত হাসান মান্টোর নারী যার কন্ঠে সেতারের ঝংকার ছিলো মন্দ্র কোমল গভীর অনুরাগে। দাও ফিরিয়ে সাদাকালো ফটোর কাজল চোখের প্রেমময় দিন; চাইনা স্মার্ট ফোনের ক্যানডিড ফটো তোলার ঝুঁকিময় সারপ্রাইজ সাঁঝ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *