পেশাদারি সম্পর্ক ও বয়সভিত্তিক সামাজিক কাঠামোর সীমাবদ্ধতা
অপর্ণা হাওলাদার ।। লিখছি এমন একটা বিষয় সম্বন্ধে যা নিয়ে যতটা আলোচনা হওয়া প্রয়োজন বলে আমি মনে করি, তা দেখি না। অথচ, আমার অভিজ্ঞতা বলে যে বাংলাদেশে (এবং অন্য সাউথ এশিয়ান সংস্কৃতিতেও) নারীর জন্য কোলাবরেশন বা যৌথ প্রজেক্ট পরিকল্পনা করতে না পারার পেছনে এটা অন্যতম বড় কারণ। আইডিয়া শেয়ার করা, তা নিয়ে দীর্ঘমেয়াদে অন্যদের সাথে মিলে কাজ করা, পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত করা – এই বিষয়গুলো একজন মানুষের পেশাগত জীবনে উন্নতির পরিচায়ক। যুক্তিতর্ক করা, বিভিন্নভাবে আইডিয়া শানিয়ে নেওয়া বুদ্ধিবৃত্তিক যেকোনো কাজে সাফল্যের পেছনে মূল কারণ। প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিংকে তাই সারা দুনিয়াতেই এত মূল্য দেওয়া হয়, নারীবাদী আন্দোলনগুলো নারীর প্রফেশনাল নেটওয়ার্কিং এর জন্য এত কাজ করে।
দীর্ঘমেয়াদে এবং বড় পর্যায়ে কোলাবরেশন তৈরিতে বাংলাদেশে নারীর জন্য প্রতিবন্ধকতাগুলো বোঝা তাই জরুরি। আমি এই লেখাটায় একটা দিক নিয়ে কথা বলবো যেটা হয়তো নারীপুরুষ সবার জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতা বলে, পুরুষের তুলনায় নারীর জন্য এই বাঁধা অতিক্রম করা তুলনামূলকভাবে বেশি কঠিন। শুরু করছি কিছু উদাহরণ দিয়ে বিষয়টা ব্যাখ্যা করে।
ধরুন, সম্পূর্ণ প্রফেশনাল পর্যায়ে অপরিচিত বাংলাদেশি নারী বয়সে কয়েক বছরের বড় হলেও সাথে সাথে “তোমাকে তুমি করে বলি” বলে “তুমি”তে নামবেন, এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই হুকুমদারির সুরে কথা বলবেন। অন্যদিকে, বয়সে কয়েক বছরের ছোটো হলেই নারী স্নেহের আবদার তুলবেন। একেবারেই প্রফেশনাল সেটিং এ “আপ্পি” বলে সম্বোধন করবেন। প্রফেশনাল দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলার, আলোচনা করার পরিবেশটাই বেশিরভাগ ক্ষেত্রে পাওয়া যায় না। আমি স্যোশাল এক্সপেরিমেন্ট চালিয়ে ব্যাপারগুলো যেহেতু বোঝার চেষ্টা করি, তাই অপরপক্ষের অনেক উস্কানি থাকার পরেও প্রফেশনাল দূরত্ব বজায় রেখে কথা বলি, সেটাকে বেশিরভাগ নারী “ওয়েস্টার্ন” মনে করেন। আবার ধরুন, প্রবাসে দেশি পার্টিতে অপরিচিত নারীর সাথে পরিচয় হলে বয়স বুঝে অন্য সব ক্যাটাগরি ঠেলে দিয়ে উপদেশ দেবেন বা স্নেহের আবদার করবেন। ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে প্রশ্ন করবেন, উপদেশ দেবেন। আমি বয়সে বড়, তাই বয়সে ছোটো সবাইকে “তুমি” করে বলার অধিকার রাখি এবং তাদের অযাচিত উপদেশ দেওয়ার ক্ষমতা রাখি – এটাই আমাদের সামাজিক শিক্ষা।
এরপর যদি প্রফেশনাল পর্যায়ের কথা বলি, কোলাবরেশনের সুযোগ আসলেও এই ব্যক্তি পর্যায়ের বয়সভিত্তিক বৈষম্যের ধারণা কাজ আগাতে বাধা দেয় না। বয়সে ছোটো কারো আইডিয়াকে একেবারেই নস্যাৎ করে দেওয়া, আইডিয়া নিয়ে কথাই বলতে না দেওয়া, যুক্তিকে আবেগের জায়গা থেকে দেখা – এই আচরণ বজায় রেখে কোলাবরেশনের কাঠামো গড়ে তোলা তো সম্ভব না। যৌথভাবে কোনও পরিকল্পনা বাস্তবায়নের একটা মূল ধারণা হচ্ছে সহকর্মীদের নিজের সমকক্ষ মনে করা। প্রতিটা পদক্ষেপে সেখানে যদি বয়স বাধা হয়ে আসে, কাজ আগানো অসম্ভব হয়ে যায়। বাংলাদেশের সামাজিক বাস্তবতায় বয়সভিত্তিক বৈষম্য প্রায় কাস্ট সিস্টেমের মতই প্রবল। আনন্দ নিয়ে কাজ করার জন্য কলিগদের মধ্যে সম্মানবোধ থাকা দরকার, প্রতিনিয়ত কেউ বড় বলেই সম্মান, ছোটো বলেই স্নেহ দাবি করলে এই প্রফেশনাল ন্যাভিগেশন প্রায় অসম্ভব।
বয়সভিত্তিক এই কাঠামো আমাদের সমাজে একেবারে জন্ম থেকেই নারীদের শেখানো হয়। নারীদের আলাদা করে বলছি কারণ আমি নিজে নারী হিসেবে বড় হয়েছি এবং সেই অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে লিখছি। “বড় বোন” হওয়ার কারণে দায়িত্ব সবাইকে সব বিলিয়ে যাওয়া – এটা মেয়েদের প্রায় জন্ম থেকে শেখানো হয়। “জননীর প্রতিনিধি অতি ছোটো দিদি” রোমান্টিসিজমের কারণে আমাদের বড় মেয়েগুলো শৈশব কী তাই জানে না। একেক বয়সে নারীদের মধ্যে কাজের সূত্রে সম্পর্ক তৈরি শেখাতে পারতো স্কুল কলেজ বিভিন্ন ক্লাবের মাধ্যমে। সেটাও দেশে প্রায় অনুপস্থিত। এমনকি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক বছরের সিনিয়র আন্ডারগ্র্যাডের ছাত্রদেরও দুইবার সালাম দিয়ে কথা বলতে হয়।
বাড়ির মধ্যের এই সম্পর্কগুলো পরবর্তীতে প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ মেন্টাল ব্যাগেজের মতো সাথে করে প্রফেশনাল লাইফে নিয়ে আসে – আমি এই বিষয়টা নিয়েই প্রচন্ড শংকা প্রকাশ করছি। প্রফেশনাল সাফল্যের জন্য যে সমতা বোঝা প্রয়োজন, কাজকে ইমোশনাল যুক্তিবোধের জায়গা থেকে সরানো প্রয়োজন, সেটা নারীদের মধ্যে কম গড়ে উঠছে। নারী বয়সকে নিজের সামাজিক অবস্থানের অন্যতম প্রধান ধারকের জায়গায় রেখে যাচ্ছেন।
আবার অন্যদিকে, নারীর প্রতি পুরুষেরও একই ধরনের দাবি আছে। আমি বিদেশে একেবারেই প্রফেশনাল পর্যায়ে পরিচিত হওয়া বয়সে কয়েক বছরের ছোটো পুরুষের কাছে থেকে ইমেইল পেয়েছি এমন ভাষায় যেন তিনি আমার আদরের ছোটো ভাই। নিত্যদিন প্রবাসে দেশের মানুষের সাথে সংযোগ থাকলে আপনি বয়সে বড় নারী হলেই আপনার কাছে সবাই অনেক অন্যায় আবদার করবে। আপনার কাজের চাপ, প্রফেশনাল পরিচয় কিছুই বাধা হবে না। “আপু”দের দায়িত্ব রান্না করে খাওয়ানো, রান্না করে না খাওয়ালে হাজার সমালোচনার মধ্যে যেতে হবে। এই কারণে প্রফেশনাল নারী অনেকেই প্রবাসে দেশি পরিমণ্ডল থেকে একেবারেই দূরে থাকছেন।
সাউথ এশিয়ান এই সামাজিক কাঠামোতে পুরুষেরাও বড় হচ্ছেন। অবশ্যই পুরুষদের মধ্যেও “বড় ভাই” মানসিকতা অনেকের আছে, দাদাগিরি সেখানেও চলছে। কিন্তু একত্রে খেলাধুলা করা, বিভিন্ন ক্লাব করা, অর্গানাইজ করা, প্রফেশনাল এক্সপোজার হওয়া – এই অভিজ্ঞতাগুলো নারীর তুলনায় পুরুষের বেশি থাকায় তাদের পক্ষে অচলায়তনটা ভাঙ্গা সহজ। আজকের প্রফেশনাল নারী হিসেবে আমরা যদি নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে চাই, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামো ভেঙ্গে নিজেদের তুলে আনতে চাই – আমাদের ভেতরের বৈষম্যগুলো আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে। আমাদের বারবার করে নিজেকেই প্রশ্ন করে বোঝা দরকার যে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক আর প্রফেশনাল সম্পর্ক আলাদা। আমি বয়সে বড় সবার কাছে “ছোটো বোন” আর বয়সে ছোটো সবার কাছে “বড় বোন” নই। সমতার বিভিন্ন দিকের মধ্যে এই কথাটাও মাথায় রাখা তাই দরকার। আপনি, তুমি, তুই – এই তিন সম্বোধনের রাজনীতি বোঝাটাও তাই জরুরি। বাংলাদেশের প্রেক্ষিতে গত এক দশকে ফেসবুকও রেখেছে ভূমিকা – প্রফেশনালি নারী নিজেকে শানিয়ে নিতে পারছে না নতুন ধরণের সামাজিক সম্পর্কের চাপে।
এর সমাধান কী? সামাজিক কাঠামোতে আমাদের যে বয়সভিত্তিক ভূমিকা ধরিয়ে দেওয়া হয়, তার থেকে একদিনে বের হওয়া নিশ্চয়ই সম্ভব না। আমাদের প্রজন্মের এই দায়িত্ব নিজেই নিতে হবে – অন্তত আমি তাই মনে করি। সমাজ আমাদের কাছে জন্ম থেকে “মা/বোন”, আরেকটু পর “বউ” এর ভূমিকা দেখতে চায়। এই চাওয়ার জায়গায় বয়সভিত্তিক বৈষম্য বজায় রাখা সমাজের জন্য, পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর জন্য প্রয়োজন।
বয়সে বড় হলেই যে অভিজ্ঞতায়, বুদ্ধিতে, বিচারবোধে বড় নয়, এবং সবার কাছে থেকেই শেখার আছে – এই বোধে না গেলে আমি কোলাবরেশন গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখি না। পুরুষতান্ত্রিকতা নারীর পেশাগত জীবনে অযুত-নিযুত বাধা তৈরি করেই রেখেছে; নারী যদি সেই বাধা ভাঙতে পরস্পরের সাথে কাজ না করে, দীর্ঘমেয়াদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সহযাত্রী না হয় – আমি আর কোনো উপায় দেখি না। নারীদের নিজেদের কোলাবরেশনের মাত্রা খুঁজে পাওয়া, পরস্পরকে প্রফেশনালি উপরে উঠতে সাহায্য করা – পুরুষতান্ত্রিক কাঠামোর একটা বড় ভয়ের জায়গা এটাই। “বড় বোন” “ছোটো বোন” না হয়ে সহকর্মী, বন্ধু হয়ে উঠতে পারাটা আমাদের জন্য তাই জরুরি।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত কলাম লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]