পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা হয়েছে “গুহান্তরাল”, ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হচ্ছে। আজ পড়ুন এর দ্বাদশ পর্ব।।
আজ পড়ুন এর তেরোতম পর্ব।।
– সুরমা আপা, ভালো আছেন?
– ভালো আছি আপা। আপনারা ভালো আছেন?
– আপা, অনেকদিন এদিকে আসেন না। একবার এসে ঘুরে যান।
– আপনাদের সব ঠিক আছে? কোন সমস্যা?
– না আপা, কোন সমস্যা নাই, ভালো আছি।
– আগামী সপ্তাহে এডভোকেসি ট্রেনিং, তখন আসবো
– আচ্ছা আপা যখন আসবেন তখন কথা হবে।
মেহেরুন আপা ফোন রেখে দেয়। সে কি কিছু বলতে চেয়েছিল? সুরমার মনটা খুঁতখুঁত করতে থাকে। হাতের কাজ শেষ করে উঠতেই আবার ফোন এলো, ঢাকার একটি বড় সংস্থার টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে। সুরমা দ্রুত ফোন ধরে হ্যালো বলতেই, ওপাশ থেকে রহমানের গলা, “সুরমা আপা শিউলী পালিয়েছে।”
– মানে কি?
– শিউলি পালিয়েছে
– আপনাদের ওখান থেকে?
– জি আপা
– সেটা কীভাবে সম্ভব? আপনাদের সিকিউরিটি সিস্টেম কি?
– আপা সকালে রুম থেকে বের হয়েছিল ক্লাসে আসার জন্য। কিন্তু ক্লাসে না এসে পালিয়ে গেছে।
– কীভাবে পালালো? আপনাদের অতবড় গেইট, গার্ড, সুপারিন্টেন্ড তারা কী করছিল?
– আপা গার্ডকেও পাওয়া যাচ্ছে না, মেইন গেইট খোলা। আমরা অনুমান করছি তারা একসাথে পালিয়েছে।
– থানায় জানিয়েছেন?
– জি আপা, পুলিশ কিছুক্ষনের মধ্যে এসে যাবে।
– যে সংস্থাটি ওর কাস্টোডিয়ান তাদেরকে জানিয়েছেন?
– জি, ওনাদের সাথে কথা বলেই আপনাকে ফোন দিলাম।
– আমার কি কোন সাপোর্ট লাগবে?
– আপা ব্রোথেলগুলোতে কি জানানো যাবে?
– জানানো যাবে, কিন্তু সেটা ঠিক হবে কিনা বুঝতে পারছি না। ওদেরকে জানালে, যদি দালালরা জেনে যায় তবে মেয়েটা আরো বিপদে জড়িয়ে পড়তে পারে। আমাকে অফিসের সাথে কথা বলতে হবে। আপনারা বরং পুলিশি বিষয়গুলো দেখেন। আপনাদের সংস্থার নিয়ম অনুসারে যা করার সেসব করেন, আপনাদের উপরের লোকজনদেরকে জানান আর আমাকেও একটা ইমেইল দিয়ে রাখেন।
– প্রিন্সিপ্যাল ম্যাডামই পুলিশকে জানিয়েছে, তদন্ত কমিটি করেছে।
ফোন ছেড়ে সুরমা তার সুপারভাইজারকে জানায়। সেক্সওয়ার্কার্স নেটওয়ার্ক বাংলাদেশকে জানায়। তার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। কতদিন ধরে মেয়েটার পিছনে কতগুলো সংস্থা সাপোর্ট দিচ্ছে। অথচ এই শেষ সময়ে এসে এমন কাণ্ড করলো! শিউলি মেয়েটাকে পেয়েছিল বছর তিনেক আগে বাগেরহাট ব্রোথেলে। বাবা মুক্তিযোদ্ধা শুনে সুরমার চোখে পানি এসে গিয়েছিলো। এসএসসি পাশ করে প্রেমিক শাহেদের সাথে পালিয়েছিলো। শাহেদ যৌনপল্লীতে এনে বিক্রি করে দিয়েছিলো। ২ বছর ধরে সে যৌনপল্লীতে আছে, নিজেকে সেখানেই মানিয়ে নিয়েছিলো। একবার নারীর জীবনে এমন কিছু ঘটলেই এ সমাজে সব শেষ হয়ে যায়, তার উপর সে দুই বছরে কত পুরুষের সাথে শুয়েছে তার হিসাব নেই। কাজেই তার আর ফেরার উপায় নেই, সমাজের এই প্রচলিত ধারার বাইরে তো আর সে নয়।
শিউলি নিজেকে সেভাবেই তৈরি করেছে। মেয়েটার বয়স কম, দেখতে সুন্দর, আয় রোজগারও ভালো। কিন্তু সুরমার মাথায় ঘুরছিল মুক্তিযোদ্ধার মেয়ে, এসএসসি পাশ। তাকে পড়াশোনা করিয়ে, কোন একটা চাকরিতে দেবার চেষ্টা করা যেতে পারে। সে মেয়েটার সাথে কথা বলে, সে কিছুটা দোটানায় পরে যায়। একবার যৌনকর্মী হলে সেখান থেকে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফেরা যায়, শিউলির বিশ্বাস করতে কষ্ট হয়। আবার মনে মনে স্বপ্ন দেখতেও চায়।
অবশেষে তার অনুমতি নিয়েই সে স্থানীয় এনজিওদের সাথে কথা বলে, নিজের সংস্থার সাথেও কথা বলে। একটা কেইস ফাইল তৈরি করে, নিড অ্যাসেসমেন্ট সহ সম্ভাব্য কি কি উপায় হতে পারে, শিউলির কি স্বপ্ন এসব কিছু সেই ফাইলে জায়গা করে নেয়। বেশ কিছু দেশি বিদেশি সংস্থার সাথেও কথা হয়, কোনো কোনো সংস্থায় প্রেজেন্টেশনও দিতে হয়। শিউলির কম্পিউটারে কাজ করার খুব ইচ্ছা। সিদ্ধান্ত হয় তাকে কম্পিউটারে ডিপ্লোমা কোর্সে ভর্তি করা হবে, দুই বছরের কোর্স। একটি বড় দেশি সংস্থার টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট আছে। সেখানে হোস্টেল ব্যবস্থাও আছে। একসাথে দুটো বিদেশি সংস্থা ফান্ড করবে- একটা সংস্থা কম্পিউটারসহ পড়াশোনার খরচ, আরেক সংস্থা থাকা খাওয়া সহ কিছু হাত খরচ ও চিকিৎসার খরচ দেবে।
ঢাকার একটি নারী সংগঠনকে কাস্টোডিয়ান হিসাবে রাখা হল। অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে তার এসএসসির সার্টিফিকেট বের করা হলো। এলাকা থেকে চেয়ারম্যানের প্রত্যয়ন পত্র, থানা থেকে অন্যান্য কাগজপত্র সব তৈরি করে সেশন ধরতে এক বছর লেগে গেল। এক শুভ দিনে তাকে বাগেরহাট যৌনপল্লী থেকে ঢাকায় আনা হলো। যৌনপল্লীতে বেশ একটা শুভেচ্ছা উৎসবের আয়োজন করা হলো। টিভি ও পত্রপত্রিকায় ঘটা করে খবর বের হল “মুক্তিযোদ্ধার মেয়ের যৌনকর্মী জীবনের অবসান” ইত্যাদি। এই খবর চোখে পড়লো শিউলির সেই প্রেমিক শাহেদের। সে মনে মনে আবার ফন্দি ফিকির শুরু করলো। এদিকে অফিসের দায়িত্বের বাইরেও সুরমা মেয়েটির প্রতি খুব মায়া ও দায়িত্ব অনুভব করে। সে পড়াশোনাসহ সব কিছুর খোঁজখবর রাখে, দুই মাসে একবার দেখতে যায়। কাপড়চোপড় আর কিছু প্রসাধন সামগ্রী, ঈদের জামা, জুতা এসব সে নিজেই সাথে নিয়ে যায়।
ইন্সটিটিউটের ক্লাস ও অফিস এক ব্লিডিংয়ে, আর হোস্টেল আরেক বিল্ডিংয়ে। দুটো বিল্ডিং একই বাউন্ডারির ভিতরে। ভিতরে খেলার জায়গা আছে, বাগান আছে। সেখানে সবকিছু নিয়ম করে মানে ঘড়ি ধরে করতে হয়। এমন বাঁধাধরা নিয়ম শিউলির একদম পছন্দ হচ্ছিলো না। শিউলি চার মাসের মাথায় প্রথমবার হোস্টেল থেকে পালালো। তার সেই প্রেমিক শাহেদ ঠিকই ঢাকার হোস্টেলের খোঁজ বের করে ফেলেছিল। দাড়োয়ানকে পটিয়ে শিউলির কাছে চিঠি পাঠায়- তাকে ছাড়া সে বাঁচবে না, এবার সে তাকে নিয়ে সোজা কাজি অফিসে গিয়ে বিয়ে করে বাড়িতে নিয়ে তুলবে।
শিউলিও সেই চিঠি প’ড়ে আবার পুরোনো প্রেমে ভেসে গেলো। তবে এবার সে ভাবলো বিয়ে করুক আর না করুক এখান থেকে তো বের হওয়া যাবে। দাড়োয়ানের সাথে কারসাজি করে শিউলি পালালো। শুরু হলো থানা পুলিশ, তদন্ত। খুব বেশিক্ষণ লাগেনি। শাহেদ শিউলিকে সোজা দৌলতদিয়া ব্রোথেলে নিয়ে বিক্রি করে দিলো। এক শিউলিকে দুইবার বিক্রি করতে পারার আনন্দে শাহেদ নিজেকে খুব হিরো হিরো মনে করতে লাগলো। খবর পেয়ে ঢাকা থেকে একটি দল দৌলতদিয়ায় পৌঁছল। পুলিশের তৎপড়তা টের পেয়ে শাহেদ পলাতক।
শিউলি সোজা জানিয়ে দিলো হোষ্টেলে ওর দমবন্ধ লাগে তাই পালিয়েছে। মাসে একবার তাকে বাইরে ঘুরতে নিয়ে যাওয়া হবে, এমন শর্তে আবার শিউলিকে ঢাকায় আনা হলো। এর পরের সময়গুলোতে ভালোই ছিল। সেই শিউলি আবার পালালো দেড় বছরের মাথায়। আর মাত্র দুই মাস বাকি তার কোর্স শেষ হতে। একটি বিদেশি এনজিওতে চাকরিও ঠিক করা আছে। ফাইনাল পরীক্ষার পরে সেখানে জয়েন করার কথা। একটি কর্মজীবী মহিলাদের হোস্টেলে সিটের আবেদনও করা আছে। চাকরিটা জোগার করতে সুরমার অনেক কষ্ট হয়েছে। এতগুলো সংস্থার এতোদিনের চেষ্টা সব বিফলে গেলো। সুরমার বুকের ভেতরটা মোচড়ায়। একটা স্বপ্ন সেও দেখতে শুরু করেছিল, অন্তত একজনের তো নতুন জীবন হতে পারতো! কেন পালালো মেয়েটা? গতমাসে যখন দেখা করতে গেল তেমন কোন পরিবর্তন চোখে পড়েনি! সুরমার ভারি অভিমান হয়, একবার তাকে বলতে পারতো!
শিউলির খোঁজ পাওয়া গেলো পঞ্চম দিনে, পটুয়াখালী ব্রোথেলে ঢোকার সময়, এইবার সে নাম বদলে ডালিয়া নামে ঢুকতে গিয়েছিল। যেহেতু ১৮ বছরের উপরে এবং স্বেচ্ছায় নাম লিখিয়েছে, তাকে ঢুকতে দিয়েছে। এবার ঢাকা থেকে তক্ষুনি কেউ গেল না। কিন্তু যেহেতু পুলিশি কেইস তাকে যৌনপল্লীর বাইরে যাওয়া নিষেধ করে সেখানেই জিজ্ঞাসাবাদ করলো। টেকনিক্যাল ইন্সটিটিউট থেকে দুজন গেল। সুরমার খুব ইচ্ছে করছিল একবার ফোন করে কথা বলে। পরে নিজেকে সামলে নেয়। তদন্ত আর আইনি প্রক্রিয়া নিজস্ব গতিতে চলতে থাকে।
সপ্তাহের শুরুতেই বাগেরহাট ভিজিট, দুইদিনের “এডভোকেসি অ্যান্ড নেটওয়ার্কিং” রিফ্রেশার ট্রেনিং। সেটা শেষ করে ঢাকায় ফিরবে, আবার পরের সপ্তাহে পটুয়াখালীতে যাবে। বাগেরহাট জেলা ভৈরব নদীর তীরে অবস্থিত। শহরের বাণিজ্যিক এলাকা ঘোষপট্টিতে সিনেমা হলের কাছাকাছি প্রায় নদীর তীর ঘেঁষে ৮৩ শতাংশ জমি নিয়ে যৌনপল্লীটি অবস্থিত। জমিটির স্থানীয় বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি টাকা। ১১টা বাড়ীতে ৭৬টা ঘর আছে, ৬৫ জন যৌনকর্মীর তাতে বাস। বাড়িগুলো ইটের তৈরি আর টিনের ছাউনি। ৪৭ জন মেয়ের জাতীয় পরিচয়পত্রও আছে। ফেরিঘাট, নারিকেল আর সুপারির পাইকারি বাজার, বাস ও ট্রাক স্ট্যান্ড, সিনেমা হল এগুলো সবই যৌনপল্লীর আশেপাশে। আবার এই জেলার উপর দিয়ে মংলা স্থলবন্দরেও যেতে হয়। ফলে এই এলাকায় প্রচুর মানুষের আনাগোনা হয়। ধারণা করা হয় ১০০ বছরেরও আগে থেকে যৌনপল্লীটি এখানে আছে। অন্যান্য পল্লীগুলোর মত পুলিশ, বাড়িওয়ালি আর কিছু ক্ষমতাসীন মানুষ মিলে পল্লীটি নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিটি মেয়েকে যৌনপল্লীতে ঢুকতে গেলে ২০০০ টাকা করে দিতে হয় পুলিশকে। এমনকি কেউ যদি একবার বের হয়ে গিয়ে আবার আসতে চায়, তাকে আবারও টাকা দিতে হয়। এখানেও একটি যৌনকর্মীদের সংগঠন আছে।
হোটেলে পৌঁছতে রাত আটটা বেজে গেলো। ফ্রেশ হয়ে রুমেই রাতের খাবার আনিয়ে নিলো। সকালের কাজগুলো গুছিয়ে রাখলো। কয়েকটা পোস্টার পেপারে ডায়াগ্রাম আঁকা বাকি। ডিনারের পরে সেগুলো শেষ করে গুছিয়ে ঘুমিয়ে পড়লো। পরের দিন সকাল ১০টায় ট্রেনিং শুরু হবে। সে, সহযোগী সংস্থার প্রজেক্ট কোর্ডিনেটর আসাদ ও প্রজেক্ট অফিসার শুক্লা তিনজন মিলে দুই দিনের সেশনগুলো ভাগ করে নিয়েছে। সুরমা সাড়ে নয়টায় পোঁছে গেলো প্রজেক্ট অফিসে। আসাদ আগেই এসেছে, শুক্লা তখনো আসেনি। ট্রেইনিং রুম ও লজিস্টিক সব গুছিয়ে রাখা হয়েছে। অংশগ্রহনকারীরা আসতে শুরু করেছে। এই ট্রেনিং নেত্রী ও নেতৃত্বের বৈশিষ্ট্য আছে এমন ১৫ জনকে দেওয়া হবে। যৌনপেশা সম্পর্কিত আইন, আইনি জটিলতা, মানবাধিকার বিষয়ক জাতীয় ও আন্তর্জাতিক টুল ইত্যাদিও থাকবে। কিছুটা নিরস প্রকৃতির বিষয়। মাঝে মাঝে গল্প, গান এসবও রাখা হয়েছে। দুপুরের খাবারের আগে সুরমা আর আসাদের সেশন ছিলো। সেগুলো শেষ করেছে। খাবার এখনো এসে পৌঁছয়নি। মেয়েরা শুক্লাকে গানের জন্য অনুরোধ করলো। শুক্লা গান ধরলো-
“কিছুদিন মনে মনে ঘরের কোনে
শ্যামের পিরিত রাখ গোপনে
ইশারায় কইবি কথা গোঠে-মাঠে
রাই রাই লো
দেখিস যেন কেউ না জানে
কেউ না বোঝে কেউ না শোনে
শ্যামকে যখন পড়বে মনে
চাইবি কালো মেঘের পানে
রাই রাই লো
আর রান্নাশালে কাঁদবি বসে
ভিজে কাঠ দিয়ে উনুনে
বলি শ্যাম শায়রে নাইতে যাবি
গায়ের বসন ভিজবে কেনে
শায়রে সাঁতার…”
মেয়েটা এতো ভালো গায়! শুক্লার বয়স হবে ২৭-২৮ বছর। বিবাহিত, এক ছেলের মা। ও সুরমাকে দিদিমনি বলে ডাকে। এনজিওতে কাজ করার এটাই মজা। ডাকাডাকি নিয়ে কোন সমস্যা নেই। অফিসে কাউকে স্যার বলতে হয় না। নাম ধরে ডাকলেও কোন সমস্যা নেই। ও চোখ বন্ধ করে গাচ্ছে। সুরমার কেন যেন মনে হচ্ছে শুক্লা আজ বড্ড বিষন্ন। চোখ খুললেই ওর চোখ দিয়ে পানি পড়বে। আসাদ সুরমার পিছনে চুপচাপ বসা। গান শেষ হলে সুরমাই জিজ্ঞেস করে, “শুক্লা, আপনার কি মন খারাপ?”
“নাগো দিদিমনি”, শুক্লার বিষন্ন গলায় উত্তর।
সুরমার মনে হল শুক্লার চোখ মুখ ফোলা। সে একবার আসাদের দিকে তাকায়, ভাবে আসাদ হয়তো জানে কিছু। কিন্তু সে কিছু না বলে রুম থেকে বের হয়ে যায়। সুরমা আবার জিজ্ঞেস করে “ছেলে ভালো আছে?”
“ভালো আছে দিদিমনি”, বলেই চুপ হয়ে যায়।
ট্রেনিংয়ে সভানেত্রী মেহেরুন আপাও আছে। সে সুরমার দিকে অর্থপূর্ণভাবে তাকিয়ে আছে। সুরমার মনে হলো সে কিছু বোঝাতে চাচ্ছে। হঠাৎ মনে পড়লো গত সপ্তাহে সে ফোন দিয়ে আসতে বলেছিল। মাঝে শিউলির ঝামেলায় একদম মনে ছিল না। আজই তার সাথে আলাদা বসতে হবে। এমন সময় খাবার এসে গেল।
প্রথম দিনের ট্রেনিং শেষ করে সুরমা মেহেরুন আপার সাথে মিটিংয়ে বসলো একা একা। সংগঠনের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা শেষ করে সুরমা জানতে চায় “আপা, আপনি যে ঢাকায় ফোন করেছিলেন, বিষয় কী? কিছুই তো বললেন না।”
“আপা আপনি কিছু কি বুঝেছেন?” মেহেরুন আপার প্রশ্ন।
– কীসের কী বুঝবো? না বললে বুঝবো কীভাবে?
– আপা শুক্লাদির বিষয়ে কিছু জানেন? কিছু বুঝতে পারেন?
– মানে কী?
– আপা, আমরা যৌনকর্মী নানান ব্যাডাগো লগে শুই। সেইডাই আমাগো পেশা, কিন্তু আমাগো কাছে আপনেরা ভগবানের মত, আপনাগো দেইখাই আমরা শিখি। এই যে আপনি পল্লীর ভিতরে আসছেন, একটা পুরুষ মানে খদ্দের, দালাল, মাস্তান কেউ আপনের দিকে চোখ তুইলা তাকায় নাই। আপনেরে দ্যাখলে রাস্তা ছাইড়া খাড়াবে। আপনাগোরে আমরা সেই সন্মানের চোখেই দেখি।
– সে তো বুঝলাম মেহেরুন আপা। কিন্তু বিষয়টা একটু খুলে বলেন আপা।
– আসাদ ভাইয়া আর শুক্লাদি’র মধ্যে একটা সম্পর্ক আছে। ঢাকায় যখন ট্রেনিংয়ে গেলাম তখন প্রথম বোঝতে পারলাম। আমরা পাশাপাশি রুমে আছিলাম। টের পাইছি, কিন্তু মানতে পারি নাই। পরে নিজেরে বুঝাইছি দুইজন মানুষের মইধ্যে প্রেম ভালবাসা হইতেই পারে। তাগোর মইধ্যে সম্পর্ক, কিন্তু আমার সমস্যা কী? আস্তে আস্তে এইখানকার মেয়েরা বোঝতে পারে কারণ তারা অফিসের মইধ্যে হাত ধরাধরি করতে, কেউ কেউ জড়াইয়া ধরতেও দ্যাখছে। এতে কইরা অফিসের পরিবেশ নষ্ট হয়, মাইনষে খারাপ কয়।
সুরমা ধাক্কা খায়। বিষয়টা একেবারে নতুন, এমন নয়। আরো দুটো পার্টনারের কর্মীদের মধ্যে হয়েছিল, মিটেও গেছে। কিন্তু এইবার একটু চিন্তায় পড়ল।
– আপা, শুক্লাদি বিবাহিত, একটা ছেলে আছে। বাসায়ও জানে। গেল সপ্তাহে তার জামাই আইসা চিল্লাচিল্লি কইরা গ্যাছে। আইজকাও কেমন চোখমুখ ফোলা ফোলা, বাড়িতে হয়তো ঝামেলা হইছে। আপা, শুক্লাদি হিন্দু ও বিবাহিত আর আসাদ ভাই মুসলান। বিষয়টা জানাজানি হইলে বড় রকমের ঝামেলা হবে। দুই ধর্মের লোকগুলাই কিন্তু পল্লী উচ্ছেদ করতে আসবে।
সুরমা নিজেও কিছুটা শংকিত। বলে সহযোগী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক নজরুল ভাইয়ের সাথে কথা বলে দেখবেন। দিনের কাজ শেষে সুরমা সোজা হোটেলে ফিরে আসে। মনের মধ্যে একটা অস্বস্তি নিয়েই রাতের খাবার শেষে শুয়ে পড়ে। পরের দিন ট্রেনিংয়ের সময় শুক্লা আর আসাদকে খুব খেয়াল করে। আসাদের আচরণে কিছু বোঝা যায় না, কিন্তু শুক্লাকে খুবই বিমর্ষ লাগে। কোন একটা সময় দুজনের চোখাচোখি হয়। সুরমার মনে হয় শুক্লার চাউনিতে অনেক ব্যাথা, অনেক কাতরতা আর অসহায়ত্ব। কিন্তু আসাদের দৃষ্টি স্থির। সেটা দেখে কিছু বোঝার উপায় নেই।
দুপরের খাবারের সাথেই ট্রেনিং শেষ। টুকিটাকি সব শেষ করে সুরমা আর আসাদ নজরুল ভাইয়ের সাথে দেখা করতে যায় মূল অফিসে।
অফিসে নজরুল ভাইয়ের সাথে প্রজেক্ট নিয়ে কথাবার্তা শেষে আসাদ বাইরে যায়। সুরমা তখন আসাদ আর শুক্লার বিষয়ে যৌনকর্মীরা কী ভাবছে সেটা বলে। উনি প্রথমে পাত্তা দেয় না। বলে “দুজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী পুরুষ যদি প্রেম করে তাতে সমস্যা কোথায়! আপনারা জেন্ডার ট্রেইনিংয়ে এই সবইতো শিখিয়েছেন সুরমা আপা!”
– আপনারা কতটা প্রস্তুত সেটা মানতে নজরুল ভাই? তাছাড়া কোন ঝামেলা হলে সামাল দিতে পারবেন তো? প্রজেক্টের কাজ আর যৌনকর্মীদের কোন সমস্যা হবে না তো?
ভদ্রলোক চিন্তিত হয়, হিন্দু-মুসলিম বিষয় একেবারে দাঙ্গা বেধে যাবে। আবার মেয়েটা বিবাহিত, বাচ্চা আছে। বিষয়টা জটিল যদি সত্যি হয়। বলে, “আমি দুজনের সাথে আলাদা আলাদা করে কথা বলবো। প্রয়োজনে একজনকে অন্য প্রজেক্টে ট্রান্সফার করে দেব।”
– মেয়েটা যেন কোনভাবেই চূড়ান্ত মানসিক কষ্টে না পড়ে, প্রয়োজনে কাউন্সেলরের পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে। আপনি চাইলে আমিও কথা বলতে পারি শুক্লার সাথে।
– অবস্থা ততটা খারাপ হয়নি আপা, এতো টেনশন নিয়েন না। আমি দেখবো। আমি কথা বলে আপনাকে জানাবো।
সুরমা হোটেলে ফিরে। ব্যাগ গুছিয়ে রাখে। পরেরদিন সকালেই ঢাকায় রওয়ানা হয়। জার্নিতে কিছুটা ক্লান্ত ছিল, রাত নটাতেই ঘুমিয়ে গেল। পরের দিন যথা সময়ে অফিস। ঢাকা শহরে লোকজনকে অনেক ভোরে উঠতে হয় জ্যাম এড়িয়ে অফিসে সময়মত পৌঁছার জন্য। কফির মগটা হাতে করে পত্রিকাটা খুলেছে, মোবাইলে রিং- নজরুল ভাই। সুরমা রিসিভ করতেই- “সুরমা আপা, শুক্লা কাল রাতে সুইসাইড করেছে!”
সুরমা কফির মগে চুমুক দিতে ভুলে যায়! স্তব্ধ হয়ে বসে থাকে। ওপাশ থেকে নজরুল ভাই বলেই যাচ্ছে- “আপা, শুনতে পাচ্ছেন? সুরমা আপা? হ্যালো, হ্যালো…”
সুরমা কিছুটা ধাতস্থ হয়ে দেখে নজরুল ভাই লাইন কেটে দিয়েছে পাঁচ মিনিট আগেই। সে কল ব্যাক করে।
– কী হয়েছিল?
– আসাদের সাথে তার একটা সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। বেশ কিছুদিন ধরেই এটা নিয়ে তাদের স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে সমস্যা হচ্ছিলো, দু’বাড়িতেও জানাজানি হয়েছিলো। স্বামী-সন্তান-সংসার-মানসন্মান একদিকে আর আসাদ একদিকে। আসাদ সম্পর্কটা এভাবেই রাখতে চায় কারন এর কোন ভবিষ্যত পরিনতি নেই। শুক্লা নিজেকে ফেরানোর চেষ্টা করেছিল, পারেনি। রাতে স্বামী-স্ত্রীর কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে শুক্লাকে গলায় দড়ি দিয়ে মরতে বলে। ভোর রাতে সে ঠিক সেই কাজটিই করে। পুলিশ এসে লাশ নামিয়েছে। পরিবার পোস্টমর্টেম করতে চায় না। আসাদ গা ঢাকা দিয়েছে, পুলিশ আসাদকে খুঁজছে। এতদিন বাড়ির লোকজন কেউ আমাকে কিছু জানায়নি। এখন দুইবাড়ি থেকেই আমার কাছে লোক এসেছে। দুই বাড়িই চায়না বিষয়টা জানাজানি হোক, তারা আপোশে লাশের সৎকার করে ফেলতে চায়। দুইবাড়ি-থানা-পুলিশ, সাংবাদিক, এলাকার লোকজন কী হবে কে জানে।
– নজরুল ভাই আমাকে টাইম টু টাইম জানাবেন।
সুরমা ফোন রেখে দিয়ে দ্রুত ইমেইল করে অফিস ও কিছু নেটওয়ার্ককে জানিয়ে রাখে।
মানুষ কখন নিজের জীবনের মায়া ত্যাগ করে, যখন আর কোন উপায় থাকে না? উপায় কি সত্যিই ছিলো না? মেয়েটা ভিতরে ভিতরে শেষ হয়ে গিয়েছিল। কাউকে মন খুলে বলতে পারেনি। ধর্ম, সমাজ, সংস্কার এসবের উর্ধ্বে উঠে শেয়ার করতে পারেনি। আসাদের ভূমিকাটাকেও হয়তো মানতে পারেনি। একটু মানসিক সাপোর্ট পেলে নিজের সংসারেই দিব্যি হেসেখেলে নিজের জীবনটা কাটিয়ে দিতে পারতো। হয়তো তার স্বামীও বুঝতো বিষয়টা।
পোস্টমর্টেম ছাড়াই লাশ সৎকার হয়েছিল, নজরুল ভাই থানা-পুলিশ সামলেছে। কিন্তু এলাকা উত্তপ্ত হয়ে উঠলো দ্বিতীয় দিনে। ‘শুক্লা হিন্দু, সংখ্যালঘু ঘরের মেয়ে ও বউ ! আর সেজন্যই কি একজন মুসলিম পুরুষ তাকে নষ্ট করবে, অনৈতিক সম্পর্ক করবে? যার জন্য মেয়েটাকে শেষ পর্যন্ত সুইসাইড করতে হলো? এর কি কোন বিচার নেই? আসাদ মুসলিম জন্যই সব কিছু থেকে পার পেয়ে যাবে?’ আস্তে আস্তে হিন্দুরা আরা মুসলিমরা আলাদাভাবে সংগঠিত হতে থাকে। এর মাঝে কেউ একজন বলে উঠলো, ‘যে মেয়ে যৌনপল্লীতে চাকরি করতে যায় সে কি ভালো?’ এবার শুরু হল যৌনপল্লী আর যৌনকর্মীদের গুষ্টি উদ্ধার। অবশেষে হিন্দু মুসলিম দুই দল একমত হল যে যৌনপল্লী থাকার জন্যই সকল সমস্যা। যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে আর কোন প্রেম, পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না। অতএব সব ক্ষোভ যৌনপল্লী উচ্ছেদের ঘোষণায় রূপ নিলো।
রিতা আর গীতা দুইজন যৌনকর্মী একটা ঘর ভাড়া নিয়ে থাকে। একজনের খদ্দের এলে আরেকজন বাইরে যায়। দু’জনের খুব বন্ধুত্ব আর মায়া। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে রাতে শোয়ার আগে টাকা পয়সার হিসাব করে। দুইজনে দুইটা কৌটায় টাকা জমায়।একটু বেশি হলে পলিথিনে জড়িয়ে বালিশের সেলাই খুলে তার ভিতরে রেখে আবার সেলাই করে দেয়। তাদের স্বপ্ন, আরো কিছু টাকা হলে দুজনে এখান থেকে চলে যাবে। একটা বস্তিতে ঘর ভাড়া করে থাকবে আর রাস্তার পাশে পিঠা বানানোর কাজ করবে। নেত্রী কতবার বলেছে ব্যাংকে একাউন্ট খুলতে, ওদের ভালো লাগে না। ভাবে এত কষ্টের টাকা অন্য অফিসে রেখে আসবে! শুক্লাদিদি মারা যাবার পর থেকেই পল্লীর আশে পাশে থমথমে ভাব। অনেক পুলিশ পাহাড়া দিচ্ছে কয়েকদিন থেকে, দিনে বেশি রাতে কম। নেত্রীরা বলেছে টাকাপয়সা, জিনিসপাতি গুছিয়ে রাখতে, হামলা হলে যেন দ্রুত নিয়ে নিরাপদে বের হতে পারে। রিতা গীতা ভাবে, কোন সমস্যা হলে বালিশ দুটো হাতে নিয়ে বের হয়ে যাবে। দু’জনেই বালিশ বুকের মধ্যে আঁকড়ে ধরে ঘুমায়। সেই রাতেও দু’জনে বালিশ জড়িয়ে ঘুমিয়ে ছিলো। গভীর রাতে হঠাৎ চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম ভেঙ্গে যায়। চোখ মেলে কিছুই বুঝতে পারে না, চোখের সামলে শুধু আলো আর আলো। মুহূর্তেই মনে হয় দাউ দাউ আগুন জ্বলছে চারিদিকে। তাদের ঘরের টিন পুড়তে পুড়তে পিছন দিকে প’ড়ে গেল। তারা এখান থেকে বেরোবে কী করে? কী করবে, কোনদিকে যাবে কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। রিতার শুধু মনে হল, পানির কথা। সে চিৎকার করে বলতে পারলো “গীতা গাঙয়ের দিকে চল। তারা একসাথে ঘর থেকে বের হয়ে দৌঁড় শুরু করে। প্রাণপনে দু’জন দৌঁড়াচ্ছে, পিছনে আগুনের লেলিহান শিখা, মানুষের আর্তচিৎকার আর প’রে থাকলো দুটো বালিশ, তাদের এতদিনের সঞ্চয়। শুধু প্রাণটা সাথে নিয়ে একেবারে শূন্য হাতে রিতা-গীতা দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে ঝাঁপ দিল নদীতে।
[চলবে]
পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?
পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না
পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’
পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’
পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’
পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’
পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’
পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”
পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”
পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’
পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”
পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”
পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন
পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে
শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?