‘‘আফু, উড়না ফিন্দিয়েন”
তাসনিয়া আল সুলতানা।। সময়টা ছিল ২০০৬ সাল। তখন ক্লাস সিক্সে পড়ি আমি। এক বিকালে আম্মুর সাথে বের হলাম শপিং করতে যাবো বলে। পরনে ছিল হলুদ রঙয়ের ফতুয়া এবং আসমানী লং স্কার্ট। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলাম এমন সময় উচ্চস্বরে সমন্বিত কণ্ঠে একটি বাক্য কানে ভেসে আসে- ‘‘আফু, উড়না ফিন্দিয়েন।” (শুদ্ধ ভাষায় বললে- আপু ওড়না পরবেন) ওড়না কী এবং কেন পরা হয় তা ওই বয়সে বুঝলেও নিজে ওড়না পরার প্রয়োজনীয়তা তখনও বোধ করিনি এবং পরিবার থেকে এ বিষয়ে কোনো ধরণের চাপাচাপি তখনও আসে নি। কিন্তু এই একটি বাক্য আমার মন এবং মস্তিষ্কে এমনভাবে প্রভাব ফেলেছিল যে, আমি বাসায় ফেরার পর আম্মুকে জিজ্ঞেস করি- ‘‘আম্মু, আমার কি ওড়না পড়া উচিত?”
এই একটি বাক্য আমার ছোট্ট মনে এতোটাই প্রভাব ফেলতে সক্ষম হয়েছিল যে প্রয়োজন হোক বা না হোক, সুন্দর লাগুক কিংবা বিদঘুটে, যেই পোশাকই পরি না কেন, একটা ওড়না বা স্কার্ফ গলার সাথে ঝুলিয়ে তবেই বের হতাম। ওড়না দিয়ে নিজের শরীর আবৃত করা মুখ্য উদ্দেশ্য ছিল না, উদ্দেশ্য ছিল ওড়না না পরলে পাছে আবার লোকের খারাপ মন্তব্যের শিকার হতে হয়- এই ভয় থেকে নিজেকে রক্ষা করা।
কিন্তু ওড়না নামক একটা ছোট কাপড়ের টুকরো বুকে জড়ালেই সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে- আমার মনের এই বদ্ধমূল ধারণা ভাঙলো তখন, যখন যথেষ্ট পরিমাণে ‘শালীনতা মেনে’ পোশাক পরিধান সত্ত্বেও বিভিন্ন সময় রাস্তাঘাটে মেয়েদের হেনস্থা হতে দেখলাম। তখনই ব্যপারটা মাথায় আসলো যে সমস্যা আসলে পোশাকে নয়, পোশাক কোনো মূখ্য নিয়ামক নয়, একটি অযুহাত মাত্র। আসল ব্যপারটা হলো এটি যেহেতু নারী শরীর, সেহেতু নারী শরীর নিয়ে আজেবাজে মন্তব্য করে মনের খোরাক মিটিয়ে পৈশাচিক আনন্দ পাওয়া সমাজের একটি সাধারণ নিয়মেরই অংশ।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো এই নিয়মকে শুধু পুরুষরা নয়, নারীরাও সমান তালে প্রমোট করে যাচ্ছে, যেটিকে বর্তমানে মডার্ন ইংরেজিতে বলা হয় ‘বিচিং (Bitching)।’ তার চেয়েও অবাক করা ব্যাপার হলো শিক্ষিত নারীরাই এইসব বিচিং- এ সবচেয়ে এগিয়ে। কারণ তারা পড়াশোনা করে শিক্ষিত হয়েছেন ঠিক, কিন্তু তাদের মেধা-মন মানসিকতায় শিক্ষার আলোর ছিটেফোঁটাটুকুও পৌঁছাতে পারে নি। অবশ্য এর জন্য আমাদের সমাজ ব্যবস্থাপনাকে দায়ী করতে হয়।
অদ্ভুদ আমাদের এই সমাজ। এখানে পুরুষরা রাস্তাঘাটে শটস পড়ে চলতে পারে, সাউথ ইন্ডিয়ান স্টাইলে লুঙ্গি উচু করে বেঁধে অসভ্যের মতো অশ্রাব্য ভাষায় চ্যাচাতে পারে, নির্লজ্জের মতো নালা নর্দমার ধারে যখন তখন মূত্রত্যাগ করতে পারে। কারণ আমাদের সমাজের বেশিরভাগ পুরুষ মনে করে থাকেন এসব না করলে পুরুষত্ব ঠিকমতো জাহির করা যায় না। এবং সমাজই তাদের এই লাইসেন্স দিয়ে রেখেছে। আর পুরুষ-নারী উভয়েই যেহেতু এই সমাজেরই অংশ যেহেতু পুরুষের পাশাপাশি বেশিরভাগ নারীও সমাজের এই ব্যবস্থাকে সমানে প্রমোট করে যাচ্ছে।
বর্তমান যুগে এসেও নারী যতই আত্মনির্ভর হোক না কেন, সমাজের সেই হেয় প্রতিপন্নমূলক দৃষ্টিভঙ্গি তার প্রতি বিন্দুমাত্র বদলায় নি। একজন নারী সে হোক কর্মজীবী অথবা গৃহিনী, রাস্তাঘাটে বের হলেই শরীর এবং পোশাক নিয়ে হেনস্থার শিকার হওয়া নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। সে খোলামেলা পোশাক পরুক, কিংবা বোরখা পরুক, কোনোভাবেই হেনস্থার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই। কোনো মেয়ে রাস্তাঘাটে চলার সময় অসাবধানতাবশত তার জামার ভেতর থেকে ব্রা’র স্ট্রাইপ যদি সামান্যও বের হয়ে থাকে তার প্রতি মন্তব্য ছোড়া হয় ‘পতিতা’ বলে। আবার কোনো মেয়ে, প্রাকৃতিকভাবেই যদি স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বড় স্তনের অধিকারী হয়, সে যদি বোরখা পরে নিজেকে আবৃত করেও বের হয় তাহলে সমাজের চোখ যায় তার স্তনের দিকে। অর্থাৎ পোশাক কোনো ফ্যাক্টরই নয় এখানে, ফ্যাক্টর হলো তার শরীর। এভাবেই আস্তে আস্তে তৈরি হয় একটি ধর্ষকামী সমাজ, যে সমাজে ধর্ষণের জন্য শুধুমাত্র নারীর পোশাককেই দায়ী করা হয়।
সৃষ্টিকর্তা নারী এবং পুরুষকে ভিন্ন শারীরিক কাঠামো দিয়ে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু উভয় সত্তাকেই তো আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব তথা মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। তাহলে সমাজ কেন শুধু একচেটিয়াভাবে নারীর শরীর আর পোশাকের দোহাই দিয়ে দিনের পর দিন তার সাথে জঘন্য আচরণ করে যাবে?
একজন নারী বোরখা পরে নিজেকে আবৃত করে চলুক, কিংবা বোরখা ছাড়া খোলামেলাভাবে চলুক, এটি সম্পুর্ণ তার ব্যাক্তিগত পছন্দ। যে কোনোভাবে চলাফেরা করার অধিকার সে রাখে। শরীর যেহেতু তার, এই শরীরের উপর অধিকারও শুধুমাত্র তার। আপনি-আমি কেউ হতে পারি না তার পোশাক এবং শরীর নিয়ে তাকে জাজ করার। যতদিন পর্যন্ত এই ধরণের মন-মানসিকতা সমাজের প্রতি স্তরে গড়ে উঠবে না, ততদিন পর্যন্ত এই সমাজ একটি ধর্ষকামী সমাজই রয়ে যাবে।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]