November 3, 2024
কলামফিচার ৩

উই আর ফেমিনিস্ট মেন

মাসকাওয়াথ আহসান।। ফেমিনিজম শব্দটি শুনলেই ভয় লাগে। ঘুরে ফিরে “জীবন থেকে নেয়া” চলচ্চিত্রের “এ খাঁচা ভাঙ্গবো আমি কেমন করে” গানটির কথা মনে পড়ে যায়। স্ত্রী রওশন জামিলের ধমকের ভয়ে কুঁকড়ে যাওয়া খান আতার যে স্বামী চরিত্রটি; যে স্বামী স্ত্রীর ভয়ে ছাদে গান গাইতে গেলেও স্বৈরাচারী স্ত্রী সেখানে উঠে এসে স্বামীর গান গাওয়া বন্ধ করে দেয়।

আমার আব্বাই প্রথমে ফেমিনিজম সম্পর্কে আমার এই ভয় সরিয়ে দিয়েছিলেন। দর্শনের বই পড়া, ক্লাস নেয়া, এক আধটু বাজার করে আনা আর উত্তম কুমারের মতো সিগেরেটের ধোয়ার রিং ছেড়ে দেবার যে রোমান্টিক জীবন; সেখানে জীবনের বাকিটা দেখবে সুচিত্রা সেন। অযথা ইগো না দেখিয়ে; মাতবরি না করে; সংসার জীবনে সুচিত্রার ওপর নির্ভর করলে ক্ষতি কী! সে-ই দেবী দুর্গার মতো দশ হাতে কাজ করে জীবনের গুড গভর্ন্যান্সটা ধরে রাখবে। তা-ই তো হলো; আম্মা কলেজে সাহিত্য পড়ালেন, আমাদের দুই ভাইকে স্কুলে ভর্তি করে দিলেন, সংসারের সুশাসন ধরে রাখলেন।

আব্বা খেলাচ্ছলে প্লেটোর রিপাবলিক বুঝিয়ে দিলে; আমরা দুই ভাই গণতন্ত্রের ভক্ত হয়ে পড়লাম। বাসায় আক্ষরিক অর্থেই নির্বাচন করে আম্মাকে প্রধানমন্ত্রী বানিয়ে; আব্বাকে বিরোধী দলীয় নেতা করে; কার্যত “প্রাইম মিনিস্টার’স মেন হয়ে লাটিমের মতো ঘুরতে থাকলাম। আব্বার কাজ তখন আমাদের পড়ালেখায় অমনোযোগের নিরন্তর সমালোচনা করা। আব্বার সমালোচনায় তিক্ত হয়ে; গৃহের নির্বাচনগুলোতে কারচুপি করে আম্মাকে ক্ষমতায় রাখার চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করে ফেললাম। গৃহের গণতন্ত্রের এই হাল থেকেই খুব সম্ভব দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যত আঁকা হয়ে গিয়েছিলো।

শুধু একটাই পার্থক্য ঘটে গেলো; আমাদের দুই ভাইয়ের মঙ্গলের প্রশ্নে আম্মা ও আব্বা কীভাবে যেন একমত হয়ে পড়তেন। প্রাইম মিনিস্টার’স মেন হিসেবে বাড়াবাড়ি করে ফেললে; ঝাড়ি খেয়ে যেতে শুরু করলাম। পরে বড় হবার পরে আব্বা বলেছিলেন; উনি আম্মার সঙ্গে যুক্তি করেই নিজে ব্যাড কপ সেজে আম্মাকে গুড কপ হতে পরামর্শ দিয়েছিলেন। উনি আম্মার ওপর নির্ভর করেছিলেন; আব্বা আমাদের একটা বেসিক এভারেজ লাইফ ধরে রাখার হিতোপদেশ দিয়ে যাবেন; আর আম্মা আমাদের সৃজনশীল মানুষ হিসেবে সুখী হতে শেখাবেন। আব্বা করতেন সমালোচনা আর আম্মা দিতেন স্বাধীনতা।

আব্বার মৃত্যুদিনে তাকে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে আম্মা যখন হাসপাতালের পথে; সে যেন স্বামী লখিন্দরকে নিয়ে বেহুলার বেদনা যাত্রা। আব্বা চলে গেলে, আম্মা একদিন বললেন, “তোমার আব্বার একটা উদাসীন ভাব থাকলেও সংসারের খুঁটিনাটি কতো কাজ করতেন তিনি। দু’জন মিলে আলোচনা করে সব সিদ্ধান্ত নেবার এমন অভ্যাস হয়েছে; আজো কোনো কাজ করার আগে মনে হয়; তোমার আব্বার সঙ্গে একটু কথা বলে নিই।”

আমার তখন মনে হয়, “বিশ শতকের মহাপ্রয়াণে স্মরণযোগ্য ইহজাগতিক প্রেম নেই।”

আম্মার মাধ্যমেই “আলফা উইমেন” বা ক্ষমতায়িত নারীর সঙ্গে পরিচয় আমার; যে স্বর্ণলতা নয়; ঋজু বৃক্ষের মতো; যেখানে রোদ-জল-বৃষ্টিতে আশ্রয় পাওয়া যায়। এ কারণে অধুনা বিপুলভাবে উচ্চারিত ফেমিনিজম বা নারীবাদ শব্দটিকে বুঝতে এক মুহূর্তের জন্য অসুবিধা হয়নি।

বরং নারী ও পুরুষ সবাই সমান মানুষ; প্রত্যেকেই মানুষ; এই ভাবনা নিয়ে পারসন ভেবে মিশতে গিয়ে কলেজ জীবনে কয়েকজন মেয়ের সঙ্গে ভুল বোঝাবুঝি হয়েছিলো। কারণ মেয়েদের কেউ কেউ তখনো “নারী” হিসেবে স্পেশাল বা বিশেষ গুরুত্ব পাবার কথা ভাবতো। অবশ্য দ্রুতই এই ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটেছিলো। তারা বুঝে যায়, আমি ছেলেদের সঙ্গে যেভাবে কথা বলি; মেয়েদের সঙ্গেও ঠিক সেভাবেই কথা বলি। কারণ ঐ যে সবাই পারসন; সবাই সমান। ছেলে বন্ধুর সঙ্গে গপ্পে যদি সার্কাজম থাকে; মেয়ে বন্ধুর সঙ্গে গপ্পে কেন সার্কাজম থাকবে না!

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে এসে দেখি অনেক আলফা উইমেন হেনরিক ইবসেনের “ডলস হাউজ” কিংবা ভার্জিনিয়া উলফের ফেমিনিজম বারুদে ঠাসা বই পুস্তক হাতে ঘুরছে। ফলে আলাদা করে কাউকে বোঝানোর ঝামেলাটা নেই যে; নারী-পুরুষ সবাই সমান; পারসন; “তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি” টাইপের ভি আই পি ট্রিটমেন্টও কাউকে দিতে পারবো না; কিংবা “চুমকি চলেছে একা পথে” বলে ইভটিজিং গান গেয়ে হ্যাংলার মতো বান্ধবি জুটানোর কসরত করারও কোন প্রয়োজন নাই। সমান্তরালে এসো, বন্ধু চলো হাঁটি।

আর কখনো বয়সোচিত নার্সিসিজম আসারও কোন উপায় ছিলো না; একটু ফ্যাশনেবল চুল কেটে বাসায় এলে আম্মা বলতেন, চুলে শাহরুখ খানের মতো পদ্ম ফুল ফুটিয়ে লাভ নাই; পড়াশোনার পদ্ম ফোটাও। আর একটু সেজে ডিপার্টমেন্টে আসার সুযোগ ছিলো না। সৈয়দ মঞ্জুরুল ইসলাম স্যার টিপ্পনী কেটে বলতেন, কী হে ডেট আছে নাকি আজ! একমাত্র আব্বাই মাঝে মাঝে বলতেন, আমরাও সেকালে ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে কফি হাউজে যেতাম; সবাই মিলে ডাচ করে বিল দিতাম। কাজেই ছেলে-মেয়ে সবাই মিলে আড্ডা দাও; এটা খুব স্বাস্থ্যপ্রদ অনুশীলন; এতে বাড়তি অপ্রয়োজনীয় আগ্রহের গুঞ্জন মনের মাঝে থাকবে না।

মা-শিক্ষক-বাবা; এরকম অভিভাবকেরা ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে একটু প্রাণখুলে কথা বললে; আড্ডাচ্ছলে তাদের চিন্তার ভ্রান্তি সম্পাদনা করে দিলে তাদের মানসিক বিকাশটা খুব স্বাভাবিক হতে বাধ্য।

আমাদের সমাজটা বড্ড ঢাক ঢাক গুড়গুড়ের; বজ্র-আঁটুনি ফস্কা গেরোর সমাজ বলেই; আজো ফেসবুকের ইনবক্সে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে অবদমিতেরা লেট ইয়ুথের বর্জ্য নিক্ষেপ করে; আবার স্ক্রিনশট দেখিয়ে পঞ্চায়েত ডেকে দোররা মারারও খুব দরকার পড়ে যায়।

ফেসবুকে চরিত্রের বিশুদ্ধতা নিয়ে যে রকম সব ট্রায়াল চলে; আর সেইখানে ঝাঁকে ঝাঁকে যে ততোধিক বিশুদ্ধ চরিত্রের যাজকেরা উপস্থিত হয়ে যায়; সেটা দেখে বোঝা যায়; এ সমাজের এখনো অনেকটা পথ যেতে হবে। নারী-পুরুষের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কাসুন্দি নিয়ে পাতকূয়া কিংবা কলতলায় মজমা বসানোর যে অন্ধকার গ্রাম; সেই গ্রাম মস্তিষ্কের মধ্যে এমন শেকড় গেড়েছে; যে রবীন্দ্র সংগীত শুনে মাথা দুলালে কিংবা ইতালির ভেনিসে গিয়ে চেক ইন দিলেও কাজ হয় না। মননটা তার ওয়াজিরিস্তানের ওয়াজিটিউবারদের মতো ফতোয়াবাজ; এটা ধরা পড়ে যায়; অন্যের প্রাইভেসিতে ফুচকি মেরে এসে বিরাট বিশুদ্ধ যাজক সেজে; পাইছি তরে; খাইছি তরে বলে কাসুন্দির পুলকে হুটোপুটি খাওয়ার দৃশ্য দেখে।

পিছিয়ে থাকা চিন্তার অনড় সমাজে পূর্ব সংস্কারগুলো আঁকড়ে পড়ে থাকা আধমরাদের ঘা দিয়ে বাঁচাতে নিরন্তর সংলাপ-আত্মসমালোচনা ও আত্মবিশ্লেষণ প্রয়োজন। এই কাজটি গত এক বছর ধরে “ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর”-এ চলছে। এই চিন্তার আন্দোলন কাউকে আঘাত করার জন্য নয়; এ হচ্ছে রিসেসিটেশন বা সিপিআর দিয়ে আধমরা সমাজকে বাঁচানোর চেষ্টা।

“ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর”-এর এই সংলাপ কোন ঝগড়া নয়; এ হচ্ছে বিতর্ক; যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি দিলে ভুল চিন্তাগুলোকে পরাস্ত করা; যাতে নতুন প্রজন্মকে অন্ধকার সমাজের উইচ হান্টিং বা হুরমতীর কপালে ছ্যাঁকা দেয়ার আদিম প্রবণতা থেকে উদ্ধার করা যায়।

যেহেতু শতবর্ষ ধরে “উই আর মেল শভিনিস্ট মেন”; জোর করে ক্ষমতা ধরে রেখেছি; ক্ষমতার বিকৃতিগুলোকে লালন করে চলেছি; আমাদের মেকি পৌরুষের দম্ভের রোলারে চাপা দিয়ে চলেছি অসংখ্য প্রতিভাময়ীকে; এ জনপদের কবরস্থান-শ্মশানগুলোতে ঘুমিয়ে অসংখ্য নারী যারা মাদাম কুরি, ভ্যালেন্টিনা টেরেসকোভা হতে পারতো; তাই সেই প্রাণ সংহারী মেল শভিনিজম-এর ক্ষমতা কাঠামোর বিরুদ্ধে ফেমিনিজমের ব্যারিকেড এখন সময়ের দাবী।

নারীদের “মেল শভিনিজমের উইমেন” করে রাখায়; তাদের মধ্যে অনিশ্চয়তার মেদ জন্মেছে। তা থেকেই বিশ্রামে হত “ফুচকি দেয়া” বেগম তৈরি হয়; সেক্স পলিটিক্স করে “সফল যারা কেমন তারা” হবার মতো ফেইক আলফা উইমেনের ফ্যাশান প্যারেড তৈরি হয়। ঘরের বাইরে জগত না থাকায়; শতাব্দী পুরোনো বউ-শাশুড়ি রাজনীতির দ্বন্দ্বে আজো ধূসর সমাজ। সেই কবে কোন শাশুড়ি ছেলের বউকে কষ্ট দিয়েছিলো; সেই অনিশ্চয়তার জীনগত হীনমন্যতার বোধ থেকে একবিংশের নারী প্রবীণ শাশুড়ি থেকে নিজের স্বামীকে বিচ্ছিন্ন করে রাখার চেষ্টা করে। সেই কবে কোন ছেলের বউ তার শাশুড়িকে অপমান করেছিলো; সেই ভ্রান্ত অধ্যাসে আজো শাশুড়ি তার ছেলের বৌ-এর মাঝের ইতিবাচকতা খুঁজে দেখে না। এইসব নানারকম ভুল চিন্তার আশ্লেষে জীবন অপচয়ের মহাভারত রচিত হচ্ছে প্রতিদিন।

এই সব সংকীর্ণ চিন্তার দেয়াল ভাঙ্গতেই “ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টর” নতুন জীবনের আহ্বান। এ হচ্ছে কথা বলার আহ্বান, যাতে মন থেকে ক্লেদ ঝরে যায়। বেঁচে থাকে জীবনের স্বপ্ন; আনন্দময় সভ্য আগামীর স্বপ্ন।