‘ওই মেয়েকে বদনাম করে দেবো, যেন মুখ দেখাতে না পারে’
তাসনিয়া আল সুলতানা।। একটি ঘটনা দিয়ে শুরু করি। একজন ভদ্রমহিলা তার বাল্যকালের বন্ধুকে অংশীদারী ব্যবসা করার উদ্দশ্যে নিজস্ব ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে একটি বড় অংকের টাকা দেন। শর্ত থাকে যে, ব্যবসার ফলে যে লাভ হবে তার একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ লভ্যাংশ প্রতি মাসে ওই ভদ্রমহিলাকে প্রদানের মাধ্যমে ব্যবসার উদ্দেশ্য প্রদেয় টাকা উসুল করা হবে। যথারীতি শর্ত মেনে ব্যবসা শুরু হল এবং মহিলা মাসের শেষে ব্যবসার লভ্যাংশও পেতে থাকলেন। কিন্তু এভাবে কয়েকমাস যাওয়ার পর মহিলার বন্ধু হঠাৎ লভ্যাংশ প্রদান করা বন্ধ করে দেন। যেহেতু লোকটি ভদ্রমহিলার অনেকদিনের পুরনো বন্ধু, মহিলা প্রথম কয়েকমাস লভ্যাংশ না পেলেও চুপ থেকে যান। কিন্তু অনেকদিন অতিবাহিত হয়ে যাওয়ার পরও যখন তিনি টাকাটা পাচ্ছিলেন না, তখন বাধ্য হয়ে তিনি তার বন্ধুর সাথে যোগযোগ করেন। বন্ধুও যথারীতি সমস্যায় আছি, ব্যবসায় লস যাচ্ছে, আজ দেবো, কাল দেবো এসব বলে বলে মহিলাকে তার পেছনে ঘুরাতে থাকেন। এভাবে করতে করতে প্রায় এক বছর পার হয়ে গেল। মহিলা তখন আইনী পরামর্শ অনুযায়ী তার বন্ধুর বিরুদ্ধে টাকা উদ্ধারের মামলা করার সিদ্ধান্ত নেন। মহিলা যখন আইনী নোটিশ পাঠান, সেটি পেয়ে তার বন্ধু অতি উত্তেজনার স্বরে তাকে টাকা ফেরত দেবে না এবং তার বিরুদ্ধে মামলা করা হলে ভদ্রমহিলাকে সবজায়গায় “বদনাম” করে ছাড়বে বলে হুমকি দেন। “বদনাম” এর হুমকিতে ভয় পেয়ে মহিলা আমাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন এখন মামলা করা উচিৎ হবে কিনা। আমি তাকে অভয় দিয়ে বলি ওই লোক যা ইচ্ছা বলে হুমকি দিক, এতে পিছপা হলে চলবে না। মামলা অবশ্যই করতে হবে, এর বিকল্প নেই।
এখানে ভদ্রমহিলার কোন দোষ ছিল না। তিনি অপরিচিত কাউকে নয়, বরং টাকাটা তার বন্ধুকেই দিয়েছিলেন। কিন্তু তার বন্ধু টাকাটা না দিয়ে তো প্রতারণা করলোই, সেই সাথে তার বিরুদ্ধে যদি মামলা করা হয় তাহলে “বদনাম” করে দেওয়ার হুমকিও দিল।
আমাদের সমাজে “বদনাম” মেয়েদের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত বহুল প্রচলিত একটি শব্দ। মেয়ে বেশি অ্যাগ্রেসিভ? তার চরিত্রে হানা দাও। মেয়ে অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়? তাকে বদনাম করে দাও। চরিত্রে হানা দেবো কীভাবে? ধর্ষণ কর। সমাজে একজন ধর্ষিতার কোন বেইল নাই। সে একজন নষ্টা। ধর্ষণ না করলেও এমন কিছু তার বিরুদ্ধে ছড়াও যার কারণে সে সমাজে কোন মুখ দেখাতে না পারে। অবশ্যই সেটি মেয়েটির চরিত্র বিষয়ক হতে হবে। আর চরিত্র নিহিত কীসে? মেয়ের সতীত্বে।
সম্প্রতি একটা বিষয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো সরগরম। ইদানিং রক্ষিতা, গোল্ড ডিগার,পতিতা এই শব্দগুলোর ট্রেন্ড চালু হয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। বলছিলাম সদ্য টিন এজ পার হওয়া তরুণী মোসারাত হোসেন মুনিয়া আর বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সায়েম সোবহান আনভীরের কথা। মুনিয়া মেয়েটি পৃথিবীতে নেই। কিন্তু সে পৃথিবী থেকে বিদায় নেওয়ার সাথে সাথে আরো একবার এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের মুখোশ উন্মোচিত হয়েছে।
যেকোনো ধর্মমতে একজন মানুষ যখন পরলোকগমন করেন তখন তিনি সকল সমালোচনার উর্ধ্বে চলে যান, তিনি যতই ভালো বা খারাপ হন না কেন। যখন মুনিয়ার লাশ উদ্ধার হল, সাথে সাথে মিডিয়ার সাংবাদিক, যাদের আমরা সভ্য সমাজের প্রতিনিধি হিসেবে জানি, তারা সংবাদটি প্রচার করল এভাবে- “গুলশানের বিলাসবহুল লাখ টাকার ফ্ল্যাটে তরুণীর আত্মহত্যা।” আই রিপিট, “বিলাসবহুল ফ্ল্যাট।” অর্থাৎ একজন মেয়ের লাশ পাওয়া গেছে এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটার তদন্ত চুলোয় যাক, বিলাসবহুল লাখ টাকার ফ্ল্যাটে তার লাশ পাওয়া গেছে তার মানে এই মেয়ের মধ্যে ঝামেলা আছে। যেখানে তথাকথিত সভ্য সমাজের সাংবাদিকরা তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে রমরমা সংবাদ ছাপছে সেখানে আসলে সাধারণ জনগনের কাছ থেকে ভালো কিছু আশা করাটা বোকামী।
মুনিয়া আর আনভীরের সম্পর্কটা একটু ব্যখ্যা করি। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী মুনিয়ার সাথে দু’বছর আগে আনভীরের পরিচয় হয়। মুনিয়ার বর্তমান বয়স যদি ২১ হয় তাহলে ১৯ বছর বয়সেই সে তার চেয়ে দ্বিগুনেরও বেশি বয়স্ক একজন মানুষের সাথে প্রেমের সম্পর্কে জড়ায়। এমন একজন মানুষ যে কিনা মাল্টি মিলিয়নার, যার স্ত্রী, সন্তান সবই আছে। প্রেম তো আর একতরফা হয় না। স্ত্রী সন্তানসহ লোকটি নিজের মেয়ের বয়সী একজন মেয়ের দিকে আকৃষ্ট হওয়ার কারণ কী? এই প্রশ্ন কি কেউ তুলেছেন? ঢাকার একটি ফাইভ স্টার হোটেলের পুলসহ একটি লাউঞ্জ বুক করে পুরো জায়গাটি ফুল আর বেলুন দিয়ে সজ্জিত করে একটি ১৯ বছরের কিশোরীকে “সারপ্রাইজ” দেওয়ার কারণ জানার চেষ্টা করেছেন কী? দিনের পর দিন বিয়ে করে বিদেশে সেটেলড হওয়ার আশ্বাস দিয়ে একটি মেয়েকে একা বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে রাখার কী যৌক্তিকতা আছে, এই কথা মনকে ভাবিয়েছে কখনও? মুনিয়া কি এসব চেয়েছিল তার কাছ থেকে? নাকি আনভীর তার নিজের প্রতি আস্থা আর বিশ্বাসের ক্ষেত্র সৃষ্টি করার জন্য মুনিয়ার থাকা খাওয়াসহ তার যাবতীয় সকল প্রয়োজন মিটিয়ে যাচ্ছিল?
এবার মুনিয়ার কথায় আসি। আমি কখনও বলবো না যে মুনিয়ার দোষ ছিল না। দোষ অবশ্যই ছিল। কিন্তু একে আমি তার ভুল হিসেবে ব্যাখ্যা করবো। এমন এক ভুল যেটি টিন এইজের ফ্যান্টাসির বশে এসে মেয়েটা করে ফেলেছে। মনঃস্তত্বের ভাষায়, টিন এইজের সময়টা এমন একটা রূপান্তরের সময়, যে বয়সে ছেলেমেয়েরা মারত্মক রকমের অজস্র ভুল করে বসে। এটাও সেরকম একটি মারাত্মক ভুল। ভুলটা সে করেছে আর সেই ভুলের মাসুল তাকেই গুনতে হয়েছে চরমভাবে। যে বয়সে বাবা মায়ের উপযুক্ত গাইডলাইন সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সেই বয়সে মুনিয়ার অভিভাবক বলতে কেউই ছিল না।
আচ্ছা মুনিয়া আর আনভীরের পরিচয় কীভাবে হল এটা কি কেউ একটু জেনে দেখার চেষ্টা করেছেন? একজন টিন এইজ মেয়ে বাংলাদেশের সর্বাপেক্ষা ধনী পরিবারের সন্তান এবং বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নাগাল পাওয়া কি চাট্টিখানি কথা? মুনিয়া তো আনভীরকে চেনার কথাও নয়। তাদের পরিচয় আর সম্পর্ক হওয়ার পিছনে নিশ্চয়ই কোন না কোন নিয়ামক কাজ করেছে আর সেই সুযোগ আনভীর ভালোভাবেই কাজে লাগিয়েছেন। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, মুনিয়ার বড় বোন এই সম্পর্কের বিষয়ে সবই জানতেন। কিন্তু সব জেনেও কেন নিজের বোনকে তিনি এই বিপথ থেকে ফিরিয়ে আনলেন না? এই বিষয়টি খুব ভালোভাবে খতিয়ে দেখা দরকার।
মুনিয়া-আনভীরের সর্বশেষ ফোনে কথোপকথন নিশ্চয়ই শুনে থাকবেন। মেয়েটি অঝোরে কাঁদছিল আর অপর পাশ থেকে আনভীর বলছিল “চুপ *নকির বাচ্চা *নকি। আমার ৫০ লাখ টাকা ফেরত দে।” মুনিয়া যতবার বলেছে কোন টাকার কথা বলা হচ্ছে সে কিছুই বুঝতে পারছে না, ততবারই প্রতিউত্তরে তাকে বলা হয়েছে “চুপ *নকি *গি। টাকা ফেরত দে আমার।” পুরো কনভার্সেশনে একটাবারও মুনিয়াকে বাজে শব্দ উচ্চারন করতে শুনেছেন? মেয়েটা অঝোরে শুধু কেঁদেই যাচ্ছিল। বাজে আর অশ্লীল শব্দ উচ্চারণ করে যাচ্ছিল শুধু সায়েম সোবহান আনভীর নামক মাল্টিমিলিয়নার ব্যক্তিটি, যার নাকি শিশুর মতো মন আর পা থেকে মাথা পর্যন্ত পুরো শরীরটাই কলিজা- কোনো কোনো পা চাটা ব্যক্তিদের ভাষায়!
লেখার শুরুর ঘটনাটা কেন ব্যাখ্যা করেছি জানেন? কারণ শুধু মুনিয়া-আনভীর নয়, যখনই কোন নারী কোন পুরুষের পথের কাটা হয়ে দাঁড়ায়, সে হয়ে যায় পতিতা। তার চরিত্রে কালিমা লেপন করে তাকে বদনাম করতে উঠে পড়ে লেগে যায় পুরুষটি। এখানে পুরুষ নারীটিকে ভোগ করলো কি করলো না সেটি মুখ্য বিষয় নয়। ভোগ না করলেও কোন নারী তার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললেই হল। সাথে সাথে নারীটির চরিত্র নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়ে যায়। কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজের বদ্ধমূল ধারণা হল, চরিত্র নিহিত থাকে নারীর সতীত্বে। সতীত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুললাম, ব্যাস হয়ে গেল বদনাম।
ভুল। নারীর চরিত্র নিহিত থাকে তার মেধায়, যোগ্যতায়, তার সৃষ্টি ও সৃজনশীলতায়, ভালো কাজে। এসব ছাড়া একজন মানুষ সে নারী হোক কিংবা একজন পুরুষ আর কিছুই নয়। আর একটা বিষয়, একজন মহিলা পতিতা হয় পুরুষের শরীরের চাহিদা মেটানোর জন্য। পুরুষই তাকে পতিতা বানায়। পতিত পুরুষও হয়, কিন্তু মেল এসকর্ট সম্বন্ধে আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ধারণা থাকলেও সেসব শব্দ আমাদের সমাজে উচ্চারণ করতে একেবারেই দেখা যায় না। পুরুষের আঁতে ঘা লাগবে যে তখন!
অন্য কোন উন্নত দেশ হলে প্রথমেই ঘটনাস্থল (ক্রাইম সিন বলছি না, কারণ যেহেতু এটা হত্যা নাকি আত্মহত্যা সেটি এখনও প্রমাণ হয় নি। অবশ্য কখনও প্রমাণ করার চেষ্টা করা হবে বলেও মনে হয় না, যদিও আপাতদৃষ্টিতে আমরা সকলেই বুঝতে পারছি আসলে কী হয়েছিল) সীল করে সম্ভাব্য সব জায়গা থেকে নমুনা সংগ্রহ করা হতো, লাশ দ্রুত থেকে দ্রুততর সময়ের মধ্যে ময়নাতদন্তের জন্য পাঠানো হতো, ময়নাতদন্তের সঠিক প্রতিবেদন প্রকাশের মাধ্যমে মেয়েটিকে ন্যায়বিচার দেওয়া হতো। আর আমাদের দেশে ন্যায়বিচার দূরে থাক, সংবাদপত্রের শিরোনাম হয় “পোশাক বদলানোর মত প্রেমিক বদলাতেন মুনিয়া।” যেন এই শিরোনাম ছাপলেই তার সাথে হওয়া সকল অন্যায় “হালাল” হয়ে যায়। মানলাম, মুনিয়ার ‘চরিত্র’ খারাপ, মানলাম সে একাধিক পুরুষের সাথে সম্পর্কে ছিল। কিন্তু আনভীর কি কচি খোকা যার নাক টিপলে এখনও দুধ গলে পড়ে? মুনিয়া সেই কচি খোকাকে কোলে তুলে চকলেট দিয়ে প্রলুব্ধ করে বলেছিল “আসো বাবু, প্রেম প্রেম খেলি।” আর চকলেট পেয়ে মুহূর্তেই খোকার মন গলে গেল। মিডিয়ার চলনে এখন এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে।
মিডিয়া আর কত নির্লজ্জতার পরিচয় দেবে? এই সমাজের চোখ খুলবে কবে? আর কী কী ঘটলে সমাজের প্রতিস্তরে আনভীরের মতো ওঁত পেতে থাকা এসব হায়েনাদের বিরুদ্ধে এই সমাজ রুখে দাঁড়াবে? উত্তর একটাই, জানা নেই।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]