November 2, 2024
জীবনের গল্পফিচার ২

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

শাহাজাদী বেগম পেশাগত জীবনে একজন উন্নয়নকর্মী, ১৮ বছর ধরে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন। উনি বাংলাদেশে যৌনকর্মী ও শিশুদের মানবাধিকার রক্ষা, এইচআইভি ও এইডসসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যসেবা প্রদান, পাচারসহ বিভিন্ন ইস্যুতে গবেষনার কাজ করছেন। এই কাজগুলোর জন্য তাকে দেশের যৌনপল্লীগুলোতে অসংখ্যবার যেতে হয়েছে।  সেই অভিজ্ঞতাগুলোকেই গল্পে রূপান্তর করে লেখা  হয়েছে “গুহান্তরাল”। আজ থেকে ধারাবাহিক আকারে প্রকাশ হবে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর ষষ্ঠ পর্ব।।

 

– সুমু, ঘুমাচ্ছিস ? মা দরজাটা একটু আলগা করে জিজ্ঞেস করে

– না মা, সুরমা পাশ ফিরে উত্তর দেয়। ছুটির দুপুরে খাওয়া সেরে বিছানায় শুয়ে আছে, চুলখোলা বালিশের উপর, কিছুটা আবার ঝুলে নেমেছে। হাতে অরুন্ধতী রায়ের “দ্য গড অব স্মল থিংস”। এই নিয়ে ৪র্থ বারের মত পড়ছে বইটি। যতবার পড়ে, ততবারই নতুন নতু্ন অর্থ খুঁজে পায় সে। মাথার কাছের জানালাটা খোলা, ঝকঝকে আলো আর সেই আলোতেই ঘরটা আলোকিত হয়ে আছে। ঢাকা শহরে একটা দোতলা বাসার জানালা দিয়ে ঘরে আলো বাতাস আসে, ভাবাই যায় না আজকাল। গুলশানের এই টানা বারান্দাওয়ালা ডুপ্লেক্স বাসাটা সুরমাদের এক আত্নীয়ের। তারা আমেরিকায় থাকে। সুরমারা নিজেদের মত থাকে, দেখাশোনা করে, মাস শেষে  ভাড়াটা ব্যাংকে জমা দেয়। মা এসে সুরমার মাথার কাছে বসে। সেও কিছুটা আদর নেওয়ার জন্য মায়ের কোলে মাথাটা তুলে দিয়ে বইটা পাশে সরিয়ে রাখে।

শরীর খারাপ লাগছে?

মা চুলে হাত বুলাতে বুলাতে  জানতে চায়

– একটু ক্লান্ত লাগছে মা।

– মেয়েগুলো এখন কোথায় আছে?

– কোন মেয়েগুলো মা?

– ওই যে মাদারীপুর যৌনপল্লী উচ্ছেদ করলো, কতগুলো মেয়ে, কোথায়  গেল ওরা? থাকছে কোথায়, খাচ্ছে কী? জানিস কিছু?

– শুধু মেয়ে না মা, মানুষ, আমাদের মত রক্ত মাংসের মানুষ। ওদের আর আমাদের মধ্যে তো কোন পার্থক্য নেই। ওদেরও খেতে পড়তে হয় আমাদের মত, পরিবার-পরিজন আছে। ওরাও এদেশের নাগরিক, অনেকেই আবার ভোটারও। আমার প্রতি রাষ্ট্রের যে দ্বায়িত্ব, ওদের প্রতিও সমান দায়িত্ব, মানুষ হিসাবে আমার যে অধিকার, তাদেরও সমান অধিকার। ওরা যে কাজটা করে সেটাও  সরকারি একটা প্রক্রিয়া। নোটারি পাবলিকে একটা ঘোষণা দেয়। সেখানে একজন প্রাপ্তবয়স্ক নারী হিসাবে সে বলে যে তার আর কোন উপায় না থাকায়  পতিতাবৃত্তিকে পেশা হিসাবে স্বেছায় বেছে নিচ্ছে। তাহলে যৌনকর্মীদের এই অবস্থার জন্য দায়টা কার উপর বর্তায় বল?

মা দীর্ঘশাস ছেড়ে বলেন, হুম। শেষ রক্ষাটা তো করা গেলো না, সেইজন্য খারাপ লাগছে। তোদের উপর যা ধকল গেল সারাটা মাস! আচ্ছা, কত মিটিং, মিছিল, মিডিয়া ক্যাম্পেইন, টক শো, লেখালেখি, কিছুইতো হল না রে। হাইকোর্ট ডিভিশনেও তো রিট আবেদন করা হল, ওখানে কিছু হবে?

জানিনা মা, সুরমার জবাব।

টাঙ্গাইলে তো হয়েছিলো, এখানে হবে না কেন? মা আবারো জানতে চান

– মা, এখানে একজন সরকারদলীয় মহাক্ষমতাধর মন্ত্রী আছে। উনিই চাইছেন যৌনপল্লীটা ভেঙ্গে ওখানে বহুতল মার্কেট বানাবেন। কোন আন্দোলনই কাজে আসছে না ওনার  ক্ষমতার কারণে। এমনকি রিটের আবেদনের শুনানি পেন্ডিং হয়ে আছে, কবে হবে নাকি আদৌ হবে না কেউ জানে না। অথচ ওই ব্যাটাকেও ওরাই ভোট দিয়েছিল।

একটু থেমে আবার বলে, কয়েকজন যৌনকর্মী বিভিন্ন জায়গায় চলে গেছে আর বাকিরা আশেপাশেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। ভাসমান হিসাবে রাস্তার পাশে শরীর বিক্রি করছে , কোনভাবে টিকে থাকার চেষ্টা।

– রাস্তার পাশে? খোলা জায়গায়? কীভাবে?

মা আঁতকে ওঠেন! বলেন, যৌনকাজের জন্য ন্যুনতম গোপনীয়তা অবশ্যই লাগে সুমু। রাস্তার পাশে কীভাবে সম্ভব?

– আমাদের দেশে কতজন ভাসমান যৌনকর্মী জানো সেটা? সেই গল্প আরেকদিন করবো। মাদারীপুরে অনেক মেয়েরা রাস্তার পাশেই সন্তানদের নিয়ে আছে। আর অপেক্ষায় আছে যদি এর মধ্যে কোন সিদ্ধান্তের পরিবর্তন হয়, তাহলে আবার ভিতরে যেতে পারবে। মা, বুঝতে পারছো , আমি তোমার কোলে ঘুমাচ্ছি আর ওরা? বেঁচে থাকার জন্য যুদ্ধ করছে।

 মা মেয়ের অস্থিরতাটা  বুঝতে পারে। প্রসঙ্গ অন্যদিকে ঘোরাতে বলে, এ সপ্তাহে কি ফিল্ডে যাবি?”

না মা, পরের সপ্তাহ পুরোটা থাকবো জামালপুর-ময়মনসিংহ, রবি থেকে বৃহষ্পতি, মেয়ের উত্তর।

মা এবার বলে ওঠে, গান শুনবি?

সুরমা আদুরে গলায় বলে, তুমি গাইলে শুনবো।

মা স্মিত হেসে রবীন্দ্রনাথের গান ধরলেন, সুরমাও মায়ের সাথে গুনগুন করলো

 ‘‘ক্লান্তি আমায় ক্ষমা কর প্রভু,

পথে যদি পিছিয়ে, যদি পিছিয়ে পড়ি কভু…”

পরের রবিবার একটু ভোরেই বের হল সুরমা, উদ্দেশ্য সকাল থেকেই কাজে লেগে যাওয়া, সাথে দুজন বিদেশি ভিজিটর আছেন, একজন রিজিওনাল অফিসের প্রতিনিধি মার্ক আর একজন ডোনারের প্রতিনিধি জেসিকা। টুটুলের বাড়ি জামাল্পুরে, সে বৃহষ্পতিবারেই চলে গেছে। সকালে সোজা ব্রোথেলের ভিতরে প্রোজেক্ট অফিসে আসবে, সহযোগী সংস্থার নির্বাহী পরিচালক মঞ্জু  দিদি তার টিমসহ থাকবেন। মার্ক মোটামুটি বাংলা জানেন, অনেক বছর বাংলাদেশে ভলান্টিয়ার হিসাবে কাজ করেছেন। তারা দুজনে নিজেদের মত করে যৌনকর্মী, সর্দারনী, ডাক্তার, বাবু এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সাথে কথা বলবেন। সব তথ্য আগেই পাঠানো ছিল, তবুও যাবার পথে সুরমা ওনাদের  জামালপুর যৌনপল্লী নিয়ে আর এ দু’দিনের কাজকর্মগুলো আরেকবার আলোচনা করে নিল।

সকাল সাড়ে এগারোটায় প্রজেক্ট অফিসে পৌঁছে তারা দেখলো, সকলেই উপস্থিত। ভিজিটর দু’জন নিজেদের মত কাজ করবে তাই প্রাথমিক কথাবার্তা শেষে নির্বাহী পরিচালক অফিসে চলে গেলেন। মার্ক আর জেসিকাকে নিয়ে টুটুল আর শম্পা, সহযোগী সংস্থার কোর্ডিনেটর যৌনপল্লীর ভিতরে গেল। পিয়ার এডুকেটররা বিভিন্ন ক্যাটেগরিতে রেস্পন্ডেন্টের সাথে কথা বলিয়ে দেবে। সবাই চলে গেলে সুরমা রোগীদের কেস হিস্ট্রির ফাইলটা নিয়ে বসলো।

– সুরমা  আফা, একলা বইসা রইছেন? ভিতরে আসবো?

সুরমা পিছনে তাকিয়ে দেখে শিখা- যৌনকর্মী ও উঠতি নেত্রী, দরজার কাছে হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে, স্যালোয়র কামিজ আর ওড়না পরা, হাল্কা প্রসাধন, ভেজা লম্বা চুল ছড়ানো। হঠাৎ করে যে কোন গৃহস্থ বাড়ির মেয়ে বলে ভ্রম হতে পারে। মনে মনে এমনটি ভেবেই আবার নিজেকে প্রশ্ন করলো সেও কি যৌনকর্মী আর অন্য মেয়েদের আলাদা করা শুরু করলো? মুখে হাসি এনে বলল, কী খবর শিখা? আজ কাস্টমার নেই? আসেন, ভিতরে আসেন।

– আইজ কাস্টমার নিবো না, আইজ আমার বিশেষ মানুষ আসবে। আসবে দুপুরের পর, থাকবে সন্ধ্যা পর্যন্ত। উনি যেইদিন আসে সেইদিন অন্য কোন কাস্টমার নেই না, উনি সারাদিনের টাকা পোষায়ে দেয়। কথা বলতে বলতে দেয়ালে ঠেস দিয়ে মেঝেতে পা মেলে বসে।

শিখা, চেয়ারে বসেন, সুরমার অনুরোধ

– নাগো আফা, পা মেইলা বসতে ভালো লাগতেছে।  আফা, আপনেরে একটা কথা জিগাই?

– কী কথা, বলেন?

– আপনে কি বিয়া করছেন? বাইচ্চা কাইচ্চা আছে?

– সুরমা জোড়ে হেসে ওঠে, না বিয়ে করিনি এখনো। বেশিরভাগ মানুষ জিজ্ঞেস করে “বিয়ে হয়েছে কিনা” কিন্তু আপনি বললেন “বিয়া করছেন কি না”।  কেন বলেন তো?

এইডা তো আপনেরা জেন্ডার ট্রেইনিংয়ে শিখাইছেন, শিখার সোজা সাপ্টা জবাব

– আপনার মাথায়তো অনেক বুদ্ধি!

সুরমা বিস্মিত হয়

– আফা, আমার অনেক কিছু জানতে মুঞ্চায়, আপনেরে জিগাই?

– অবশ্যই। সুরমার সম্মতি।

– এই যে মনে করেন আপনেরা, মানে, সমাজের শিক্ষিত-অশিক্ষিত মাইনষেরা চাকরি বাকরি কইরা রোজগার করেন। তারপর ভালবাইসা মনের আনন্দে জামাই-বউ যৌনকাজ করেন, সন্তান আনার জন্যও করেন। আবার সেই জামাইরাই টাকা দিয়া আমাগো লগে একই যৌনকাজ করতে আসে।  সেই টাকাটাই আমাগো রোজগার। বিষয়ডা এমুন ক্যান? আইচ্ছা, আরো খোলাসা কইরা কই। মানে যেই কামডা আপনাগো আনন্দের বিষয়, ভবিষ্যত বংশ রক্ষার বিষয়, গোপনে ঘরের দুয়ার লাগাইয়া স্বামীর লগে করেন, সেই একই কাম  আমাগো কত্ত ব্যাডার লগে করতে হয়, আর যেন প্যাট বাদাইয়া না ফেলি সেই ব্যবস্থাও নিতে হয়। আর এইডাই আমাগো পেশা, এই কাম কইরাই প্যাটের ভাত জোগার করি। “পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা”- বিষয়ডা  জানি কেমুন, না?

সুরমা ফাইল বন্ধ করে সোজা হয়ে বসে। সে শিখার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে থাকে।

– আফা, আমার অনেক কিছু জানতে মুঞ্চায়। স্বামী-স্ত্রীরা কি প্রত্যেক রাইতে যৌন কাজ করে? শিক্ষিত নারী-পুরুষ কিংবা স্বামী-স্ত্রীরাও কি ওই সময় গালাগালি করে, খারাপ কথা কয়?

সুরমা এইবার নড়ে চড়ে বসে। এই প্রশ্নের উত্তর এই মেয়েকে কেমন করে বোঝাবে সে! সে তো আবার শিক্ষিত সমাজের প্রতিনিধি। কিছুটা চুপ থেকে, নিজেকে সামলে নিয়ে বলে, যৌনকাজ মানুষের একটি জৈবিক চাহিদা। মানে ক্ষুধা লাগলে আমরা যেমন খাবার খাই, সেইরকম  আর কি। খাবার সময় সব মানুষই হাত দিয়ে খায়। এই বিষয়টাও সেই রকম।

কেউ কেউ তো চামচ দিয়া খায়, শিখা বলে।

কিন্তু সেই চামচটা ধরার জন্যও হাত লাগে, সুরমার জবাব।

– কইলেন না তো তারাও খারাপ কথা কয় কিনা?

আপনি যখন কাস্টমার নেন তখন কে খারাপ কথা কয়? উলটা সুরমা জানতে চায়।

– তারাও কয়, আমরাও কই। তারা তো ঐসব শোনতেই আসে।

কেন খারাপ কথা বলেন? সুরমার আবার প্রশ্ন।

তখন কইতে ভাল্লাগে, শিখার সরল উত্তর।

– তাহলে অন্য নারী-পুরুষ কিংবা স্বামী-স্ত্রীরও ঐ সময় বলতে ভালো লাগে।

– আমরাতো ভাবি ব্যাডারা বউয়ের লগে সব কিছু কইতে পারে না তাই আমাগো কাছে আসে। শিক্ষিত মানুষ কেমনে খারাপ কথা মুখে আনে?

– শিখা,  শিক্ষিত, অশিক্ষিত, ধনী  গরীব প্রতিটি মানুষই ওই সময় শুধুই সঙ্গী, ক্ষুধার্ত মানুষ, সকলেই সবচেয়ে বেশি আনন্দ পেতে চায়। তার জন্য যা যা করার তাই করতে চায়। আবার  আপনার কথাও ঠিক,  স্বামী স্ত্রী সব সময় সব কিছু হয়ত বলতে পারে না। সংকোচ থাকে, সংগী কি ভাববে সেটাও মাথায় কাজ করে। এটা দুজন মানুষের বোঝাপড়ার বিষয়। তবে কিছু কিছু  বিষয় আছে যেগুলো নারী-পুরুষের শারীরিক-মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর, সেইগুলো থেকে দূরে থাকা দরকার।

– তাইলে মানুষ লেখাপড়া করে ক্যান? চাকরি করার জন্য? অনেক অশিক্ষিত মানুষ ব্যবসাপাতি কইরা অনেক টাকার মালিক হইছে । শিক্ষার কামডা কি? আইচ্ছা ধরেন  আমি শিখা দেহ বিক্রি কইরা, ছুকরী খাটাইয়া লাখ ট্যাকা ব্যাংকে জমাইছি। আপনে কত বড় বড় পাশ দিয়া হাজার টাকাও জমাইতে পারেন নাই। তাইলে তফাতডা কই সেইডাই বোজতে চাই। আফা, কিছু মনে কইরেন না- নিজেগোর উদাহরনডাই দিলাম  কিলিয়ার করার লাইগা।

সুরমা ভিতরে ভিতরে অসহায় বোধ করে। বলে, শিখা, মানুষ জন্মায় সমান হয়ে, সমান অধিকার নিয়ে, সমান মেধা নিয়ে। জন্মের সময় প্রত্যেক মানুষের মধ্যেই যেমন অনেক গুনের বীজ থাকে তেমনি অনেক দোষের বীজও থাকে। কিন্তু জন্মের পর থেকে সবার জীবনে একই ঘটনা ঘটে না। আলাদা আলাদা ঘটনা ঘটার ফলে একেকজন একেক জায়গায় একেক রকম জীবন যাপন করে। তখন মানুষের বৈশিষ্ট্যগুলোও একেক ভাবে বিকাশ হয়। শিক্ষার কাজ হল মানুষের নিজের মধ্যে সেই দোষ-গুনগুলোকে চিনতে পারা, দোষগুলোকে বাড়তে না দিয়ে, গুনগুলো নিজের মধ্যে ও অন্যদের মধ্যে চর্চা করা, নিজের সিদ্ধান্ত নিতে শেখা, ভালো জিনিসকে ছড়িয়ে দেওয়া, মন্দ জিনিসকে বাধা দেওয়া এইসব।

কথাগুলো বলে সুরমা মনে মনে ভাবে, আসলেই কি সে ঠিক বলছে? শিখার বোঝার মত করে বলতে গিয়ে গুন-দোষ, ভালো-মন্দ অনেকগুলো জাজমেন্টাল শব্দ বলে ফেলেছে।  নিজেকে একদম কনফিডেন্ট মনে হয় না তার।

– আফা, ভাল মন্দ কে ঠিক করে? আপনাগো জন্যে যেইডা মন্দ, আমাগো জন্যে সেইডা ভালা। আইচ্ছা বাদ দেন। আরেকখান কথা জিগাই, সমাজের মাইনষের বছরের পর বছর একই মাইনষের লগে যৌনকাজ করতে ভাল্লাগে? যাগোর লাগে না, তারাই কি আমাগো কাছে আসে? জানেন আফা, খদ্দের পাইলে আমরা সকলেই খুব খুশি হই, ঐডাই আমাগো রুটি-রুজি, চাকরি কন ব্যবসা কন সবই যৌনকাজ করা। কিন্তু সব সময় ভাল্লাগে না। আমাগোও শরীর। সবসময় ভাললাগা নিয়া কাম করিনা আমরাও। আমাগো কাম হইলো খদ্দেরগো ভালো লাগানো, তাগোরে খুশি করা। তাগোর  ভালো লাগলেই আবার আইবো, আমার ব্যবসা ভালো হইবো।

যখন ভালো না লাগে তখন কি করেন? অনেক্ষন পর সুরমা কথা বলে।

– আফা, আমার অনেক কাস্টমার। তয় সকলের লগে ভাল্লাগে না। এত বার শরীর সাড়া দেয় না। আমি তো অনেক কিছু জানি। আমি ম্যাসাজ জানি, পার্লারের ট্রেইনিংয়ের সময় শিখছি। যখন ভাল্লাগে না, তখন খদ্দেররে একটু আলগা আদর কইরা এমুন এমন যায়গায় চাপ দেই, “…… আউট” হইয়া যায়!

বলেই শিখা হাসতে শুরু করে। হাসি শেষে আবার শুরু করে, আমার তিন জন বান্ধা কাস্টমার আছে। তাগোর সাথে আমি খুব ভালা পাই। বুকের ভিত্রে কেমুন জানি করে করে, শরীরটা শিউরে শিউরে ওঠে…। তাগোর দিন-ক্ষণ ঠিক করা আছে, আমি অপেক্ষায় থাকি। সেই অপেক্ষা জনম জনম অপেক্ষার মতন গো আফা।

বলেই  সে গান ধরে-

‘‘তোমার মনে বাস করে কারা ওমন জানোনা,

তোমার মনে বসত করে কয়জনা, মন জানোনা ,

তোমার মনে বসত করে কয়জনা…’’

সুরমা কিছুটা কৌতুক করে জিজ্ঞেস করে, তার মানে আপনার মনের ভিতরে তিন জন বাস  করে, তাই তো?

শিখার ত্বরিত বলে ওঠে, না গো আফা, এই গানডার মানে অন্যরকম। ধরেন একই মানুষ একেক সময় একেক রকম আচরন করে। খাড়ান বুঝাইয়া কই, ধরেন আমি যৌনকর্মী হিসাবে আমার অধিকার পাইতে চাই, আন্দোলন করি, আবার আমিই ছুকরী রাখি। নিজে কনডম ছাড়া কাম করি না, কিন্তু ছুকরীগুলানরে কই কাস্টমার যেমন চায়, তেমন করতে হবে। কথা না শোনলে মাইর দেই, খাইতে দিই না, ট্যাকা দিই না। অথচ আমি জানি ছুকরিগো জীবন সবচেয়ে কষ্টের। আসলে  এইখানে আইসা বুঝছি যে সর্দার্নী না হইলে টিকে থাকা কঠিন। মাত্র তিনটা ছুকরী রাখছি। আবার আপনের লগে কত “বুঝের কথা” কইতেছি- এইগুলান হইল “এক আমার”  মইধ্যে “অনেক আমি”।

এইসব আপনি কার কাছে শিখেছেন? সুরমা জানতে চায়

– বাজানের কাছে। আমার বাজান জমিতে কামলা খাটতো। আমি মায় আর বাজান এই তিন জনের সুখের সংসার। কাম শেষে বাজান দোতারা নিয়া গান ধরত। আমিও তার সাথে গলা মিলাইতাম। মায় পান বানাইয়া, তালপাখা নিইয়া কাছে বইসা বাতাস দিত। বাজান সেইসব গান নিয়া অনেক কথা কইতো। তখন বোজতাম না। কিন্তু অভ্যাস হইয়া গেল, গান শোনলেই অর্থ খুঁজি। আমারে যখন ইস্কুলে দিলো তখন গেরামে বিজলি বাত্তি আইলো। ও আল্লাহ, বোতাম টিপলেই ফকফকা আলো। কেলাস ওয়ানের পরীক্ষায় প্রথম হইয়া কেলাস টুতে উঠলাম। ইসকুলের ছার বাজানরে জিগাইলো , “মেয়েকে লেখাপড়া করিয়ে কি বানাবে?” বাজানে বুক ফুলাইয়া কইলো। “ওর মায়ে কয় বিজলি বাত্তি যে বানাইছে ঐ রকম মানুষ বানাইবো, আমার মাইয়াও কিছু একটা নতুন  বানাইয়া দেখাইবো।” ছার বাজানের মুখের দিকে  কতক্ষণ চাইয়া রইছে। বাজানের  পিঠ চাপড়াইয়া কইলো, “বিজ্ঞানী। তোমার মেয়ে বিজ্ঞানী হবে, সাবাস!” “বিজ্ঞানী” শব্দটা আইজও ভুলি নাই। পরেরবারও প্রথম হইয়া কেলাস  থিরিতে উঠলাম। একদিন বাজান ক্ষেতে গেছে, মায়ও খাবার নিয়া দিতে গেছে। আমি তখন ইসকুলে। আইলের উপরে গামছা বিছাইয়া মায় খাবার দিছে, বাজানেও খাওয়া শুরু করছে। আর তখনই তাগোর উপ্রে বাজ পড়ছে। বাজান-মায়  ওইখানে একসাথে মইরা গেল। সকলে কইলো জোড়া ময়না, জোড়া হইয়াই মরছে। মরনেরকালেও বাজান মায়ের হাত ধইরা আছিল। তাগোরে পাশাপাশি কব্বরে শোয়াইলো। আমি তখন ছোড কাকার সংসারে। মনে হইতো কব্বরে গিয়া বাপ-মায়ের সাথে আমিও শুইয়া থাকি।

একদিন পাশের বাড়ির রহিমা ফুপুর লগে ঢাকায় মাইনষের বাড়িতে কামে দেওনের লাইগা পাঠাইলো। রহিমা ফুপু যেই বস্তিতে থাকত সেখানে আনলো আমারে। সকালে কইলো পাশের ঘরে এক কানাবুড়ি থাকে তারে নিয়া আমারে রাস্তায় বসাইয়া দিব। আর আমরা ভিক্ষা করমু।  আমি জিগাই, “ভিক্ষা করলে বিজ্ঞানী হমু কেমনে?” ফুপু ঠাস কইরা একটা চড় বসাইলো। আমি ব্যাথায় কানতে থাকি। যেমুন কথা তেমন কাজ। বাপ-মায়ের স্বপ্নের বিজ্ঞানী মাইয়ার শুরু হইলো ভিক্ষুকের জীবন। রাস্তার জ্যামে গাড়ি খাড়াইলেই দৌড়াইয়া যাই, হাত পাতি, কই “আমার কানা দাদীরে নিয়া না খাইয়া আছি, কিছু দেন।” টাকা পাওয়া যায়। অল্প কিছুদিন পরে একদিন রাস্তায় কানাবুড়িরে নিয়া বইসা আছি, হঠাৎ একটা বড় পুলিশের গাড়ি আইসা খাড়াইলো। কথা নাই বার্তা নাই আমাগো গাড়িতে তুইলা নিলো। গাড়ীর মইধ্যে আরো অনেক গরীব মানুষ জন আছিলো। এক অফিসে নিয়া আমার মত ছোট ছোট মাইয়াগো নামাইয়া দিয়ে চইলা গেল। কানাবুড়ির কাছ থাইকা হারাইয়া গেলাম। এইখানে এক ঘরে বসাইছে,‌ নাম লিখছে, কত কাগজপত্র, তারপরে কইছে এইখানেই থাকতে হইবো। এইখানে শুনছি আমার বয়স ১০ বছর । আমি তখন বাজান বাজান কইরা কানতেছি। সন্ধ্যার আগখান দিয়া আমারে ভিতরে নিলো। একটা বড় ঘরের মেঝেতে সারি সারি বিছানা তার একটাতে থাকতে দিয়া কইলো, এখন থাইকা আমি এইখানেই থাকবো। একটা ব্যাগে দুই সেট জামা আর সাবান, কইলো ওইগুলা আমার। এইখানে আমার সমান আর আমার চেয়ে কিছু বড় অনেক মাইয়ারা  আছে। রাইতে ঘণ্টা দিয়া খাইতে ডাকলো, একজন বড় খালা আমারে নিয়া গেলো খাওয়ার জন্য। তারে হাসু খালা কই।

একদিন বড় একজন মাইয়া আইসা আমারে খুব মারলো, কোন কারন বুঝি নাই। আমি কানতেছি আর কইতেছি ‘‘বাড়ীত যামু, মায়ের কাছে যামু”। হাসু খালা আইসা বাইরে গাছের নিচে বসাইয়া কইলো, ‘‘মায় কই থাকে?” কইলাম “মইরা গেছে”। খালাই কইলো “এইডা হইলো সরকারি আশ্রয়কেন্দ্র, মাইনষে কয় “ভবঘুরে কেন্দ্র। এইখানে ঢোকা যায়, বের হওয়া যায় না। কেন জানি খালা আমারে মায়া করলো। দিন যায় মাস যায়, আমি বড় হই, বোজতে পারি ভবঘুরে কেন্দ্র জেল খাটার থাইকাও খারাপ। জেলে মেয়াদ থাকে, কখন বাইর হবে সেইডা লেখা থাকে। কিন্তু আশ্রয় কেন্দ্রে সেইসব থাকে না। ছোডকালে আইছে, এখন খালা হইয়া গেছে, এমন অনেক মানুষ আছে এইখানে। আরো বছর দুই পরে একদিন দুই বড় মাইয়া আমারে শিরীজ গাছের আড়ালে নিয়া কাপড় খুইলা যা করলো…..!  আমি মাটিতে পইড়া আছড়াইয়া কানলাম। আমার কান্দন দেইখা অন্য মাইয়ারা হাসে। হাসু খালা আসলো, চিৎকার কইরা কইলাম “ক্যান এমন করলো।” খালা গম্ভীর, কিছু কয়না। হাত ধইরা নিয়া গোসলে ঢুকাইলো। রাইতে ফোঁপাইয়া ফোঁপাইয়া কানলাম। ওইখানে লেখাপড়া, বাগানের কাম করা, রান্নাবান্না, পরিস্কার করা এইসব শিখাইতো। সেলাইও শিখাইতো। ওইডাই তখন বাড়িঘর।

প্রথম মাসিক শেষ হওয়ার পরে এক সন্ধ্যায় হাসু খালা আসলো এক সেট নতুন জামাকাপড় নিয়া। তখন আমি ওরনা ধরছি। নতুন জামা আর শ্যাম্পু দিয়া বলল গোসল কইরা পইরা  আসতে। আমি অবাক হইয়া জিগাই, “ক্যান খালা?” খালা গম্ভীর হইয়া থাকে, আশেপাশের মাইয়ারা মুখ টিপে হাসে। আমি মনের মইধ্যে প্রশ্ন নিয়াই গোসল কইরা নতুন কাপড় পিন্দি। খালা চুল আঁচড়াইয়া সাজাইয়া আমারে অফিসে বড় স্যারের রুমে নিয়া গেল। বড় স্যার সোফায় বসে গেলাস হাতে। আমারে ভিত্রে  দিয়া বাহির থাইকা দরজা লাগায় দেয়। সেই শুরু- পুরুষের সাথে। সাত বছর আছিলাম, প্রায়ই আমারে আর অন্য মেয়েদেরও সাইজা গুইজা যাইতে হইত বড় স্যারের রুমে। কখনো কখনো দাড়োয়ানরাও সুযোগ নিত। একবার এক মন্ত্রী আসল ভিজিট করতে। তিনি আবার হুজুর। হাসু খালা কইলো তাদের দল নাকি বাংলাদেশ চায় নাই। অথচ তারা এখন বাংলাদেশের মন্ত্রী, অনেক ক্ষমতা তাগোর। খালার কথা কিছুই বোজলাম না। আমরা সাইজা গুইজা ফুল নিয়া দাঁড়াইলাম। মাইয়ারা যখন ফুল দিচ্ছে লোকটা প্রত্যেকেরই গায়ে মাথায় হাত বুলাইতেছে। আমি  যখন ফুল দিছি, সে আমার পিঠে হাত দিয়া ফিতাটা ধইরা টান দিছে। আমি আমি উলটা ঘোরার চেষ্টা করতেই সে আমারে বুকের সাথে চাইপা ধরছে! অফিসের সকল মাইনষে দাঁড়ানো, কেউ কিচ্ছু কইতে পারে নাই। আমার এমুন কান্দন আসছে! একটু পরে আমারে ছাইড়া দিয়া পরেরজনের কাছে গেল।

তারও অনেক পরে একবার কয়েকজন মহিলাগো একটা দল আসলো আমাগো লগে কথা কইতে। সেই দলে ঢাকা বিশোবিদ্যালয়ের শিক্ষকও আছিলো। একটা বেদেশি এনজিও সরকাররে রাজী করাইছে। আমাগো সকলের লগে একলা একলা কথা কইলো আবার একসাথেও  অনেক কিছু কইলো। কয়েকদিন ধইরা হইলো। আমরা মন খুইলা সব কইলাম। কিছুদিন পরে বড় স্যার অন্য জায়গায় চইলা গেল আর তার জায়গায় আইলো এক বড় আপা। আমাগো ভাগ্য খুইলা গেল। যারা যারা ভাল ট্রেনিং করবে তাগোরে কাজের ব্যবস্থা কইরা ছাইড়া দিবে। আমি বিউটি পার্লারের কাজ শিখলাম। পার্লারে চাকরি  দেওয়ার জন্য একটা একটা নারী সংগঠনের জিম্মায়  আমারে ছাইড়া দিল। ছাড়া পাওয়ার আনন্দ – কি যে আনন্দ আফা। ১০ বছরের শিশু তখন ১৭ বছরের যুবতী।  আমার জন্য নিরাপদ একটা চাকরি পাইতে  একটু দেরি হইতেছিল। সেই সময় আমি এক নারী দালালের খপ্পরে পরলাম। চাকরি দিবো কইছে, আমি সেই লোভে এনজিওর শেল্টার থাইকা পলাইছি। দালালে নিইয়া আমারে এইখানে আইনা বিক্রি করছে।

শিখা কথা শেষ করে।

কারো মুখে কোন কথা নাই দু’জনেই চুপ করে থাকে। জোহরের আজানের শব্দে দু’জনেরই হুঁশ হয়। শিখা উঠে দাঁড়ায়। কেন যেন সুরমাও উঠে দাঁড়ায়। শিখা দরজা পর্যন্ত গিয়ে সুরমার দিকে ফিরে চায়, হঠাৎ এসে সুরমাকে জাপটে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে থাকে। সুরমা মমতা দিয়ে জড়িয়ে ধরে। দু’জন ভিন্ন সামাজিক অবস্থানের নারী  মুহুর্তেই “শুধুই নারী” হয়ে যায়!

বিকেলে মার্ক, জেসিকা আর সুরমাকে হোটেলে নামিয়ে টুটুল ময়মনসিংহের পথে রওয়ানা হয়। সুরমা হোটেলের রুমে ঢুকেই টিভি অন করে। গান বাংলায় আনুশেহ গাচ্ছেন-

“তোমার মনে বাস করে কারা ওমন জানোনা,

তোমার মনে বসত করে কয়জনা…..”

 বড্ড আনমনা হয়ে যায় সে।

(চলবে…)

পড়ুন দ্বিতীয় পর্ব- পর্ব-২: খানকিগো আবার দাফন কীসের?

পর্ব-৩: টাঙ্গাইলের পুণ্যভূমিতে পাপীষ্ঠাদের আর জায়গা হবে না

পর্ব-৪: ‘ভালো হইতে চাইছিলাম, দিলেন কই?’

পর্ব-৫: ‘আমরা তো খারাপ কাজ করি, তাই দোয়া চাই আল্লাহর কাছে’

পর্ব-৬: ‘পিন্দনের কাপড় খুইলা টাকা কামাই, পিন্দনেরই কাপড় কেনার লাইগা’

পর্ব-৭: ‘সমাজে যেমুন ব্যাডারা বউরে পিডায়, আমাগোও বাবুরা মারে’

পর্ব-৮: ‘সারাদিন ভালবাসলো, সন্ধ্যায় যৌনপল্লীতে নিয়া বেইচা দিয়া গেল’

পর্ব-৯: ‘‘এই যৌনপল্লীর মাইয়াগো উন্নতি করতে চাই”

পর্ব-১০: “একজন খদ্দের না পাইলে ভাত পাবো কোম্মে”

পর্ব-১১: ‘আমি ভালোবাসি মাইয়াগো, ব্যাডাগো সাথে শুইলে আমার গা গোলায়!’

পর্ব-১২: “এসএসসি’র নিবন্ধনের সময় মাইয়ারে নিজের বইলা স্বীকৃতি দিলো”

পর্ব-১৩: “যৌনপল্লী না থাকলে সমাজে কোন পরকীয়া, সুইসাইড থাকবে না”

পর্ব-১৪: টিকে থাকাই জীবন, বেঁচে থাকাই জীবন

পর্ব-১৫: যুদ্ধ, দুর্ভিক্ষ, বঙ্গবন্ধুরে মারল; এইসবের মইধ্যেও ওগো মাইয়া মাইনষের শরিল লাগে

শেষ পর্ব: আমার আকাশে পাখি হয়ে উড়বেন?