শরীর: দায় আমার, সিদ্ধান্ত কেন সবার?
অনন্যা শর্মা প্রমা।। ‘আমার শরীর, আমার সিদ্ধান্ত’- ফেমিনিস্ট আন্দোলনের জনপ্রিয় স্লোগান- মাই বডি মাই চয়েস। এর মানে হল আমার শরীর সম্পর্কিত সমস্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার আমার। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালও শরীর সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়াকে মানবাধিকার বলে উল্লেখ করেছে, তাদের ভাষায় সেটি- মাই বডি মাই রাইটস। মানে নিজের শরীরের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কোন ধরনের বৈষম্য, পারিপার্শ্বিক চাপ বা বাধ্যবাধকতা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। সিদ্ধান্ত গ্রহণের সক্ষমতা অর্জনের জন্য প্রথমে জানতে হবে নিজের শরীর সম্পর্কে। শরীর সম্পর্কে জানা মানে শুধু অ্যানাটমি জানা নয়। শরীর নিয়ে কী কী অধিকার আছে, কী ধরনের সামাজিক সাংস্কৃতিক ভাবধারা বিদ্যমান তাও জানতে হবে এবং অধিকার আদায়ে সোচ্চার হতে হবে।
পশ্চিমে নারীবাদের উত্থানকালে নারীবাদীরা এই স্লোগান ব্যবহার করেন যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যে নারীর অধিকার আদায় করতে। যৌন ও প্রজনন স্বাস্থ্যগত অধিকার বলতে যৌনস্বাস্থ্য ও অধিকার, প্রজনন স্বাস্থ্য ও অধিকারকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ অধিকারগুলোর মধ্যে রয়েছে- যৌনতা সম্পর্কে জানা, বয়ঃসন্ধিকালীন পরিবর্তন সম্পর্কে জানা, নিরাপদ যৌনমিলন, স্বেচ্ছায় গর্ভধারণ, নিরাপদ মাতৃত্ব ও গর্ভপাত, জন্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার ইত্যাদি। কিন্তু সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক প্রেক্ষাপটে নিত্যনতুন দিক সংযোজন হতে থাকে আন্দোলনটিতে। যেমন- দক্ষিণ এশিয়ার নারীবাদীরা এটি শুধুমাত্র প্রজনন স্বাস্থ্যের অধিকারে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তাঁরা এটি ব্যবহার করেছেন নারীর পোশাক বাছাই, বিয়ের সঙ্গী বাছাই, যৌনজীবন, সন্তান গ্রহণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে নারীর সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা বুঝাতে। নারী কোন পোশাক পড়বে, কোন পোশাক পড়লে তাকে শালীন বলা হবে, কোন পোশাক পড়লে ধর্ষিতা হতে হবে, কখন বিয়ে করবে, কাকে বিয়ে করবে, সন্তান কখন জন্ম দেবে, কয়টা সন্তান জন্ম দেবে, কি হবে তার শরীরের আদর্শ গড়ন এসব সিদ্ধান্ত নারীর উপর আরোপ করে দিচ্ছে সমাজ। অথচ নারীর শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার একমাত্র তার। যুক্তরাষ্ট্রে এ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছে সন্তানের অভিভাবকত্ব। যুক্তরাজ্যে এ আন্দোলন ব্যবহৃত হচ্ছে ধর্ষিতা নারীর সহযোগিতার জন্য।
নারীর শরীর নিয়ে শ্রেণিগত ভাবধারাও লক্ষ্যনীয়। অভিজাত শ্রেণির নারীর শরীর সৌন্দর্য আর প্রজননের চাদরে মোড়ানো। অন্যদিকে নিম্নবিত্ত সমাজে শারীরিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি কলকারখানায় কাজ করার শারীরিক সক্ষমতা অধিক বিবেচ্য। আবার এ শরীরের বর্ণবৈষম্যও কম নয়। বর্ণবাদের ধারায় শ্বেতাঙ্গ নারীর ফর্সা চামড়া হয়ে যাচ্ছে নারীর সৌন্দর্যের মানদণ্ড। সেক্ষেত্রে কৃষ্ণাঙ্গ নারীর একজীবনের যুদ্ধ শুধু সাদা চামড়ার সৌন্দর্য অর্জন করা। বড় বড় কোম্পানিগুলোও ব্যস্ত নিত্যনতুন রঙ ফর্সাকারী ক্রিমের বাজারজাতকরণে। পুঁজিবাদের ধারায় নারীর শরীর হয়েছে পণ্য আর এই পণ্যের ক্রেতা বিক্রেতা চায়ের দোকান থেকে শুরু করে কর্পোরেট হাউস পর্যন্ত ছোট বড় সবাই।
মেয়ে তুমি ফর্সা কেন নও, জিরো ফিগার কেন নও, তোমার এখনও বিয়ে কেন হচ্ছে না, বাচ্চা কেন হচ্ছে না- এ সমস্ত দায় তোমার। নারী তুমি যে সহিংসতার শিকার তার দায়ও তোমার শরীরের।
আমার দেশ, আমার সমাজ, আমার সংস্কৃতি নারীর শরীরের শুদ্ধতা রক্ষা করার এক অমোঘ নেশায় মত্ত। কতভাবে নারীদেহকে শুদ্ধ রাখা যায় তার প্রতিযোগিতা সর্বত্র। কিন্তু যারা নারীদেহ শুদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর তাদের নিজেদের চারিত্রিক কিংবা শারীরিক কোন শুদ্ধতাই যেন ধর্তব্য নয়। অভিজ্ঞতার আলোকে একটি ঘটনার আলোকপাত করছি। রুবিনা (ছদ্মনাম) হাওড়াঞ্চলের প্রত্যন্ত গ্রামের একটি মেয়ে। মা আর চার ভাইবোনের সংসারে সে সবার ছোট। তার বাবার মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরে বড় ভাই। নুন আনতে পান্তা ফুরানো পরিবারটিতে তার শিক্ষা গ্রহণের পথ সুগম হয় নি। যদিও তাকে স্কুলে ভর্তি করা হয়েছিল কিন্তু জন্ম থেকেই তার বাকপ্রতিবন্ধিতার কারণে সহপাঠীরা উত্যক্ত করত তাকে। অল্প কিছুদিনের মধ্যে তার স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েটি ধীরে ধীরে সেলাইয়ের কাজ রপ্ত করে নিল। ঘরের কাজকর্মেও বেশ পটু। তার বাড়ি ছাড়া আশেপাশের বাড়িতে কদাচিৎ যায় সে। তার মা মাঝে মাঝে চেয়ারম্যানের বাড়িতে ছুটা কাজ করে। এমনই এক দিনে তার ভাইয়ের এক বন্ধু বাড়িতে আসে। ছেলেটি প্রায়ই তাদের বাড়ি আসত তার ভাইয়ের সাথে। সেই সুবাদে এ বাড়ির সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল তার। কিন্তু সেদিন তার ভাই সাথে ছিল না আর বাড়িতে রুবিনা ছাড়া কেউ ছিল না। বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে গিয়ে মেয়েটিকে ধর্ষণ করে অজ্ঞান অবস্থায় ফেলে যায় সে। প্রচুর রক্তক্ষরণের পরেও ঘটনা যেন বেশিদূর জানাজানি না হয় তাই রুবিনাকে হাসপাতালে নেওয়া হয়নি। পরবর্তীতে গ্রামের সালিশে সিদ্ধান্ত হয় ৫০ হাজার টাকা যৌতুকসহ ধর্ষকের সাথে মেয়েটির বিয়ে হবে। জুম্মাবারে যথারীতি বিয়ে হল। বিপত্তি বাধল শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার পর। রুবিনাকে মেনে নেয়নি শ্বশুরবাড়ির কেউ। তাকে বলা হয় আরও ৫০ হাজার টাকা আর টেলিভিশন আনতে না পারলে তার মতো কলঙ্কিনী মেয়ের জায়গা হবে না এ বাড়িতে। এক সপ্তাহ ধরে তার উপর নির্যাতন চলে যৌতুকের জন্য। তাকে তার চরিত্রের কলঙ্ক মাথা পেতে নিতে হয়। বৈবাহিক রীতি অনুযায়ী স্বামীসহ সে তার বাবার বাড়িতে যাওয়ার পর তার স্বামী মিথ্যা কথা বলে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায় এবং এরপর আর কোন খোঁজখবর রাখেনি। যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তার শ্বশুর বাড়ি থেকে তাকে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। বিচার সালিশ করেও লাভ হয়নি কারণ ছেলেটি শহরে পালিয়ে গিয়েছিল। এ ঘটনার দায় এখনও রুবিনার উপরই বর্তায়। তার শরীরের দায় শুধুই তার, কিন্তু সিদ্ধান্ত সবার।
নারীর শরীরকে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে আধার বানানো হয়েছে, চালানো হয়েছে নিত্যনতুন ভাবধারার পরীক্ষণ। ধর্ম, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ফ্যাশন, পুঁজিবাদ সমস্ত কিছুই নারীর শরীর নিয়ে সিদ্ধান্ত দিয়ে গেছে এবং যাচ্ছেও। অথচ এই সিদ্ধান্ত নেয়ার একান্ত অধিকার আমার। নারীর শরীর নিয়ে যে অতিরঞ্জিত চর্চা সেই দুরভিসন্ধি ভাঙ্গতে হবে নারীকেই। সেজন্য চাই যথার্থ শিক্ষা, অধিকার আদায়ের মানসিকতা আর ট্যাবু ভাঙ্গার সাহস।
[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]