November 3, 2024
ফিচার ২মুক্তমত

বদলে যাক পিরিয়ডের গল্পগুলো

নূরেম মাহপারা।। কথাগুলো আমরা কম বেশি সবাই জানি। আমাদের প্রত্যাশার সঙ্গে বাস্তবতার পার্থক্যের কারণে কথাগুলো বারবার ফিরে আসে। কোন অবস্থার গতি-প্রকৃতি ধরতে হলে তুলনামূলক আলোচনার বিকল্প নেই।

পিরিয়ড শুরু হলে ব্রাজিল, কলোম্বিয়া ও পেরুর তিকুনা সম্প্রদায়ের মেয়েদের তিন মাস আলাদা ঘরে রাখা হয়। এই সময়টি পেলাজন নামে পরিচিত। এ সময় মেয়েটি নিজের সম্প্রদায়ের ইতিহাস, সংগীত ও সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে থাকে।

ফিজির স্থানীয় একটি সম্প্রদায়ের মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড হলে নারীর প্রতি সম্মান জানাতে তার অভিভাবক স্বজনদের জন্য তুনুদ্রা নামে বিশেষ ভোজের আয়োজন করে। দক্ষিণ ভারতে যা ঋতুকলা সংস্কার অনুষ্ঠান নামে পরিচিত— যেখানে মেয়েটি লাংগা ভনি নামে ঐতিহ্যবাহী পোশাক পরে। অতিথিরা তাকে উপহার দিয়ে যায়। উত্তর আমেরিকায় এই অনুষ্ঠানের নাম সূর্যদয় অভ্যর্থনা।

পূর্ব আফ্রিকার মালাউই শহরের মেয়েদের বলা হয়, ‘পিরিয়ডের দিনগুলোতে লবণ দিয়ে তরকারি রান্না করা যাবে না।’ মাছ, সবজি, ফল খাওয়াও এ সময় নিষেধ। নেপালের কিছু গ্রামে মেয়েদের ঘরের বাইরে আলাদা কুঁড়ে ঘরে দিন কাটাতে বাধ্য করা হয়।

হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে বিষন্নতায় ডুবে থাকার দিনগুলোতে, অকারণে কেঁদে ফেলার মুহূর্তগুলোতে যত্ন, স্নেহ, ভালোবাসার বদলে অধিকাংশ মেয়ের কপালে জোটে আদিকাল থেকে প্রবাহমান কুসংস্কারে মোড়া লৌকিকতার আড়ালের বৈষম্য আর তুচ্ছতাচ্ছিল্য! শুধু এই দিনগুলোতে তারা প্রাত্যহিক কাজকর্মের অযোগ্য। সমাজে বাঁচার অযোগ্য।

এ তো গেল মোটা দাগের হিসাব। মফস্বলের মধ্যবিত্ত, রক্ষণশীল একটি একান্নবর্তী পরিবারকে কাছ থেকে দেখা কিছু গল্প বলা যাক। সেখানে কষ্ট হয়তো আরও খানিকটা সুনির্দিষ্ট।

সঙ্গত কারণেই কবে, কখন, কোথায়, কীভাবে তাদের সঙ্গে আমার আলাপ তা প্রকাশ করছি না। নামগুলো ছদ্ম। গল্পগুলো সত্যি।

পিরিয়ড কী, কেন হয়, এ সময় শারীরিক ও মানসিক কী কী পরিবর্তন হয়, কত বছর বয়সে একটি মেয়ের প্রথম পিরিয়ড হয়— এই বিষয়গুলো আমাদের সবারই কম বেশি জানা। তারপরও পিরিয়ড নিয়ে লুকোচুরি শেষ হয়নি। হিসাব করলে দেখা যায়, একজন নারীর জীবনে প্রায় ৪৫০ বার এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটে। প্রতি মাসে গড়ে ১৭ দিন অন্য মানুষ হয়েও ‘স্বাভাবিক’ জীবন যাপন করতে হয়।

সুবহার মা কর্মজীবী। বাবা ব্যবসায়ী। তাই মায়ের চেয়ে বাবার সঙ্গে সম্পর্কটা বেশি ঘনিষ্ট। সুবহা বয়স যখন ১১ বছর, তখন গ্রীষ্মের ছুটিতে সে প্রথম পিরিয়ডের মুখোমুখি হয়। আগে পরিবারের কেউ তাকে এ বিষয়ে কখনো কিছু বলেনি। হঠাৎ রক্ত দেখে সুবহা ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে দাদির কাছে যায়। এরপর সে এক অথৈ সাগরে পড়ে। দাদি প্রথমে তার চাচিকে জানায়। সুবহাকে বোঝানো হয়, পিরিয়ড ব্যাপারটা খুবই অপবিত্র। সে রাতে তাকে আলাদা বিছানায় একা ঘুমাতে দেওয়া হয়।

মা তাকে বলে, ‘বাবাকে বলো না’। সুবহার বয়স এখন ২২ বছর। সেই স্মৃতি তাকে এখনো তাড়িয়ে বেড়ায়। পিরিয়ডের কদিন সব কিছু নোংরা মনে হয়। নিজেকেও। তখন থেকেই খেলার সাথী বাবার সঙ্গে প্রতি মাসে তার কদিনের দূরত্ব। বাবা ন্যাপকিন কিনে দিলেও এ বিষয়ে তাদের কখনো কথা হয় না।

আক্বিদার বয়স এখন ২৪ বছর। সে নিয়মিত নামাজ পড়ে। পিরিয়ডের দিনগুলোতে বাবা যখন বলে, আম্মু নামাজ পড়, তখন সে ঘরের ভেতরে দরজা বন্ধ করে লুকিয়ে থাকে। যেন বাবার মনে হয়, মেয়ে নামাজ পড়ছে। রমজান মাসে ওই কদিন রোজা না রাখলেও সবার সঙ্গে সেহেরি খেতে হয়। সবাইকে লুকিয়ে কিছু খাওয়ার সুযোগ পেলে ভালো, তাছাড়া না খেয়েই কেটে যায় দিন।

আফরোজা আক্তারের জীবনে এই গল্পের শুরু আরও আগে। জীবনে ৪০টি বর্ষা তার দেখা হয়ে গেছে। বড় ছেলে ফাইয়াজ একদিন দুপুরে তাকে রান্না ঘরে খেতে দেখে ফেলে। তার ধারণা হয়, মা তাহলে মিথ্যা বলে! রোজা না রেখে প্রতিদিন লুকিয়ে খাবার খায়! ফাইয়াজের মনে জন্ম নেওয়া এই ধারণা গোপন থাকেনি।

এই রক্ষণশীল পরিবারেই ইতিহাসের পাতা উল্টে একটি ভিন্ন গল্প উঠে আসে।

সতেরো বছর আগে তারিনের জন্মের সময় তার মায়ের মৃত্যু হয়। বাবার কাছেই তার বেড়ে ওঠা। নয় বছর বয়সে বাবা তাকে পিরিয়ড সম্পর্কে ধারণা দেয়। প্রথম যেদিন পিরিয়ড শুরু হয়, বাবাকে জড়িয়ে ধরে তারিন বলেছিল, ‘Baba, it has started. Let’s celebrate my womanhood’। দুজন রিকশা নিয়ে বেড়াতে বের হয়। দুপুরের খাবার রেস্টুরেন্টে বসে খেয়ে বাড়িতে ফেরে। সে উদযাপনে আড়ম্বর নেই। আছে নির্ভরতা, শান্তি। প্রতিটি সন্তানই মনে করে, বাবা পৃথিবীর সেই মানুষটি যার কাছে সব সমস্যার সমাধান আছে।

গবেষকরা যে ব্যথাকে হার্ট অ্যাটাকের সমপরিমাণ বলে মত দিয়েছেন, পিরিয়ডের সেই ব্যথা যেন হাসিমুখে সহ্য করতে না হয়। অস্বাভাবিকভাবে ‘স্বাভাবিক’ থাকার চেষ্টা না করতে হয়। বাবাকে যেন বলা যায়, আমার পিরিয়ড হয়েছে। মা যেন ছেলেকে বলতে পারে, এই বাবু হট ওয়াটার ব্যাগ নিয়ে আয় তো। সন্তান যেন মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, পিরিয়ড হলে আমাকে বলবে।

রক্ষণশীল এই পরিবারের গল্প আছে শত ঘরে। এ গল্প এবার বদলে যাক, এটুকুই প্রত্যাশা।

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]