November 23, 2024
ফিচার ৩মুক্তমত

যে সমাজে নির্ভরশীলতার নামে অক্ষমতার চর্চা হয়

নাবিলা সোনার ।। শৈশব থেকে শুরু করে যৌবন পর্যন্ত জীবনটা কেটে গেল শুনে শুনে যে, “এটা করতে পারবা না”, “ওখানে যেতে পারবানা”, “ওইটা শিখতে পারবানা”। যার ফলে দেখলাম, বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডি পেরোনোর পরেও আমি কিছু রান্না, ঘর গুছানো আর যে বিষয়টা নিয়ে পড়েছি, সেটা সম্পর্কে হাল্কা-পাতলা জ্ঞান ছাড়া জীবন-যাপনের জন্য তেমন কোনো দক্ষতাই নেই আমার। শুধু সেই জ্ঞানগুলো নিয়ে যখন ইউরোপে আসলাম, তখন সর্বপ্রথম অনুধাবন করলাম যে মা-বাবার অতি চিন্তা আর যত্নের চোটে আমি মোটামুটি অথর্ব একটা মানুষ আর এখানকার একটা ১০-১২ বছরের বাচ্চাও আমার চেয়ে বেশি স্বাবলম্বী।

একটু চোখ খুললেই দেখবেন যে, আমাদের দেশে বেশিরভাগ মানুষই কারো না কারো উপর নির্ভরশীল এবং এটা খুবই স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। ছোটবেলা থেকেই ছেলেরা এটা করবে, মেয়েরা ওটা করবে এরকম একটা বাধাধরা মানসিকতার সমাজে বড় হওয়ার ফলে যেটা হয় তা হলো, পুরুষেরা অর্থ উপার্জনের অযুহাতে রান্নাবান্না, তাদের সন্তানদের দেখভাল করার জন্য তার স্ত্রী ও মা-বোনদের উপর, নারীরা সংসার করার অযুহাতে অর্থের জন্য তার স্বামী, বাবা বা ভাইদের উপর, সন্তানেরা চাকরি বা বিয়ের আগ পর্যন্ত তাদের বাবা-মায়ের উপর, এবং বাবা-মায়েরা রিটায়ার্ড করার পর তাদের সন্তানদের উপর নির্ভরশীল। মানুষ হিসেবে সবরকম গুনাবলী নিয়ে জন্ম নিয়েও শুধুমাত্র এহেন সামাজিক গঠনের জন্য আমাদের দেশে প্রায় প্রত্যেকের জীবনের পুরোটা সময় কাটে কারো না কারো উপর ভর করে বেঁচে থেকে।

আমি বলছি না নির্ভরশীলতা খুব খারাপ কিছু। মানুষকে জীবিকার তাগিদেই একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু জীবনের মৌলিক চাহিদাগুলোর জন্য যখন আরেকজনকে আঁকড়ে ধরার প্রয়োজন হয়, তখন আমাদের দেশের মত পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এর মুল্য সবচেয়ে বেশি দিতে হয় নারীকে।

ধরুন, একজন অর্থ উপার্জনক্ষম পুরুষ হয়তো ঘরের কাজ, রান্নাবান্না কিছুই পারে না। সে রান্নাবান্না, ঘরের কাজের জন্য তার সঙ্গিনীর উপর নির্ভরশীল। এখন কোনো কারণে তার সঙ্গিনী তাকে ছেড়ে যায়, তাহলে তাকে রান্না করে দেওয়ার জন্য মা-বোন বা আত্মীয়স্বজন আছে। কেউ না থাকলেও শত শত ভাতের হোটেল আছে। সঙ্গিনীর বিরহে মনে কষ্ট পেলেও থাকা খাওয়ার কষ্টে সে পরবে না। অপরদিকে একজন নারী যদি তার পড়াশুনা, চাকরি বিসর্জন দিয়ে শুধু সংসারের কাজে মন দেয় স্বামী সব খরচ যোগাবে বলে, সে কিন্তু নিজে থেকেই তার কষ্ট আগাম ডেকে আনছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে এখনকার পৃথিবীতে অর্থ খুবই প্রয়োজনীয় একটা বস্তু। আপনি সেই অর্থ উপার্জনের পথ বন্ধ করে রাখলেন আর আপনার সঙ্গীরও মাথায় থাকলো যে আপনার তাকে ছেড়ে যাওয়ার জায়গা সীমিত। সে কিন্তু পান থেকে চুন খসলেই আপনাকে তুলাধুনা করতে বেশি চিন্তা করবে না। আর এই সমাজ পুরুষদের যেভাবে মাথায় তুলে রাখে, নারীদের সেভাবেই পায়ের তলায় রাখতে আনন্দ পায়। তাই আপনি নিজে যদি নিজের দেখভালের দায়িত্ব না নেন, খারাপ সময়ে কাউকে পাশে পাওয়া কিরকম দুরূহ ব্যপার, যে ওই পরিস্থিতিতে না পড়বে সে ছাড়া কেউ উপলব্ধি করতে পারবে না।

আমার ব্যক্তিগতভাবে মনে হয়, একটা মেয়ের সব কাজ করে দেওয়ার জন্য কেউ পাশে থাকুক আর না থাকুক, জীবন-যাপনের জন্য যেসব দক্ষতা থাকা প্রয়োজন সেসব শেখা উচিত এবং তাকে ছোটবেলা থেকেই সেগুলো শিখতে উৎসাহ দেওয়া উচিত। উপার্জনে সক্ষম হওয়া বটেই, পাশাপাশি সাইকেল চালানো, গাড়ি চালানো, ক্যারাতে, সাঁতার, নিজের মালপত্র নিজেই বহন করতে পারা, ব্যক্তিত্ব বজায় রেখে অপরিচিত মানুষের সাথে কথা বলা শিখে রাখা উচিত, যাতে কখনো কেউ শোনাতে না পারে যে সে পুরুষ ছাড়া অচল। যেন কেউ অনুভব না করায় যে নারী হওয়াটাই যেন এক রকমের অক্ষমতা! যেন কেউ তাকে অসহায় মনে করে সুযোগ না নিতে পারে।

আবার শুধু ডিগ্রি, উপার্জনক্ষম, স্বাবলম্বী হওয়ার সকল দক্ষতা থাকলেই হবেনা, নিজের ব্যক্তিত্ব, আত্মসম্মানবোধ সম্পর্কে সজাগ হওয়া উচিত এবং চাকরি বা সংসার যেটাই করেন না কেন কোনোটাতেই যাতে নিজের অস্তিত্ব হারিয়ে না যায় সেদিকে খেয়াল রাখা উচিত। আমার মা, খালা, ফুপুকে দেখেছি তারা যথেষ্ট যোগ্য আর উপার্জনক্ষম হওয়া সত্ত্বেও সংসারের বাইরে তাদের নিজেদের অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারেন না। যাই ঘটুক না কেন সেখান থেকে বের হবার মত তাদের মানসিক শক্তি বা ইচ্ছা কোনোটাই নেই। কিন্তু এই মায়ের জেনারেশনটাই বিয়ে সংসার নিয়ে পুরানো মানসিকতা ধরে রাখলেও, তাদের মেয়েদের পড়ানোর প্রতি নজর দিয়েছেন, ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার হবার স্বপ্ন দেখিয়েছেন হয়তো এজন্য যে তারাও চাইতেন, তাদের মত যেকোনো কিছু সহ্য করে তাদের মেয়েদেরও যাতে সারাজীবন কাটাতে না হয়। আমি তাদের কাছ থেকেই শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, “আর যাই কর আম্মু, পায়ের নিচের মাটি শক্ত করতে হবে।” এই একটা কথাই আমাকে এখন পর্যন্ত অনুপ্রেরণা দেয়।

পরিশেষে বলি, আপনি হয়তো নারীর শারীরিক গঠন, সন্তান ধারণ, পরিবার, সমাজের যুক্তি দিয়ে “নারী একটি লতানো পরজীবি, ইহাকে ঘরের ভিতর বস্তাবন্দী করে রাখাই কাম্য” প্রমাণ করতে চাইবেন। কিন্তু আমার এই পর্যন্ত দুনিয়া দেখার এবং ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা বলে, নারীরা মোটেও লতানো জীবি বা পরজীবী না। প্রত্যেকের যথেষ্ট ক্ষমতা রয়েছে পায়ের নিচের মাটি শক্ত করে মহীরুহ হয়ে বাঁচার জন্য। তাদের শুধু এই সমাজ পরজীবী হয়ে বাঁচতে বাধ্য করে।

 

[ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে প্রকাশিত মুক্তমত লেখকের নিজস্ব বক্তব্য]

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *