পর্ব-২৪: নারী অবমাননার প্রত্যুত্তর এবং কনয্যুমার ক্যাপিটালিযমের সমালোচনা
শিল্প সমালোচক, লেখক শার্লট মালিন্সের A Little Feminist History of Art বইটি বাংলায় অনুবাদ করছেন বিশিষ্ট অনুবাদক, শিক্ষক জি এইচ হাবীব। বইটির অনুবাদ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ হচ্ছে ফেমিনিস্ট ফ্যাক্টরে। আজ পড়ুন এর চব্বিশতম পর্ব। সব পাঠকের সুবিধার জন্য প্রতি পর্বের শুরুতে বইটির এবং লেখক শার্লট মালিন্সের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি দেয়া থাকবে।।
[নারীবাদী শিল্প আন্দোলনের শুরু ১৯৬০-এর দশকের শেষের দিকে। পুরুষ প্রাধান্যবিশিষ্ট রঙ্গমঞ্চে প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হওয়ার জন্যে সে সময় নারী শিল্পীরা তাঁদের কাজগুলোর জেন্ডারচ্যুতি ঘটাবার সংগ্রামে নামেন। এরপর থেকে সেই আন্দোলন শিল্প জগতে গোটা বিশ্বজুড়ে অন্যতম প্রধান ভূমিকা পালন ক’রে আসছে। ‘নন্দনতাত্ত্বিক ফরমালিযম’ ব’লে অভিহিত যুগের পর সামাজিকভাবে প্রাসঙ্গিক নানান ইস্যুতে কথা বলার জন্য ‘নারীদৃষ্টি’-র সাহায্যে নারী শিল্পীরা বিভিন্ন মাধ্যমে কাজ ক’রে জেন্ডার, পরিচয় এবং ফর্মের দিকে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চেয়েছেন, সমালোচনা করেছেন সাংস্কৃতিক প্রত্যাশাগুলোকে এবং নারীকে সনাতনী দৈনন্দিন ধারণায় আটকে ফেলার ব্যাপারটিকে। সমাজের দৃষ্টি ঘোরাতে চেয়েছেন সাম্যের জন্যে নারীর সংগ্রাম এবং নারীদেহকে পণ্য হিসেবে দেখবার মানসিকতা ও ক্রিয়াকর্মের দিকে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” (A Little Feminist History of Art) নামের ছোট্ট বইটিকে এই আন্দোলনের ফসল হিসেবে জাত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু শিল্পকর্মের সংক্ষিপ্ত কিন্তু সারগর্ভ ভূমিকা বলা যেতে পারে। ১৯৬০-এর দশক থেকে বর্তমান কাল অব্দি পঞ্চাশটি অসামান্য কাজ নারীর জীবন ও অভিজ্ঞতাকে তুলে ধরেছে। সেই সঙ্গে, ভিয্যুয়াল সংস্কৃতির ওপর নারীবাদী আদর্শ ও রাজনীতি যে প্রভাব ফেলেছে সেটাও এই কাজগুলো মেলে ধরেছে। “অল্প কথায় নারীবাদী শিল্প-ইতিহাস” নামের এই গ্রন্থটি জেন্ডার বৈষম্য, যৌনতা, গার্হস্থ্য জীবন, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা আর নারী দেহের মতো বিষয়গুলো খতিয়ে দেখা বিংশ শতকের সবচাইতে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, প্রভাবশালী ও টেকসই শৈল্পিক আন্দোলনগুলোর একটির আনন্দ উদযাপন।
শার্লট মালিন্স একজন শিল্প সমালোচক, লেখক এবং সম্প্রচারক। তিনি রেচল হোয়াইরিড, সেসিলি ব্রাউন, র্যাচেল লামসডেন, জেনি স্যাভিল, ক্যাথে ডে মনসাউক্স, স্যু অ্যারোস্মিদ, সুজ্যান কুন, স্যুযি হ্যামিলটন এবং পলা রেগোসহ বিভিন্ন নারী শিল্পীকে নিয়ে লেখালেখি করেছেন। তাঁর রচিত ও প্রকাশিত বিভিন্ন গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “লাইভ্স অভ দ্য গ্রেট আর্টিস্টস” (২০০৮) এবং “র্যাচেল হোয়াইহেড” (২০০৭)। তিনি বিবিসি রেডিও ফোর-এর “ফ্রন্ট রো” এবং “স্যাটারডে রিভিউ’’-র নিয়মিত প্রদায়ক]
অ্যানথিয়া হ্যামিলটন (Anthea Hamilton)
(জন্ম ১৯৭৮)
অ্যানথিয়া হ্যামিলটন’র শিল্পকর্ম Leg Chair (Cigarettes)- এর মধ্যে অস্বস্তিকর একটা ব্যাপার আছে। পার্সপেক্স-এর তৈরি কালো দুটো পা একটি কেন্দ্রীয় প্লিন্থকে ঘিরে আটকানো, এবং পা-দুটো বুড়ো আঙুলের ডগার ওপর অবিশ্বাস্যভাবে ভররক্ষা ক’রে আছে। ছড়ানো পা দুটোর মাঝে প্রমাণ আকারের চাইতে বড় দুটো সিগারেট কেন্দ্রীয় খুঁটির কাজ করছে।
Leg Chair (Cigarettes) হ্যামিলটনের দশটি ভাস্কর্যের একটি ধারাবাহিক কাজের অংশ যেগুলোর সবই তাঁর নিজের পায়ের কাট-আউট ভিত্তি ক’রে তৈরি। এবং তাঁর কাজে এটা বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে। জন ট্রাভোল্টা আর মার্চেন্ট আইভরি’র আ রুম উইদ আ ভিউ (১৯৮৫) চলচ্চিত্রকে তুলে ধরেও তিনি কিছু চেয়ার নির্মাণ করেছেন, এবং উপকরণ হিসেবে সামুদ্রিক আগাছা, রাইস কেক, রেকর্ডস এবং পোস্টকার্ড ব্যবহার করেছেন।
হামিলটন ভাস্কর্য গড়েন, ইন্সটলেশন এবং পারফরমেন্স করেন। আমরা কী ভাবি আর কোন কোন জিনিসপত্রের দিকে তাকাই সে-ব্যাপারে প্রশ্ন করার জন্যে তাঁর এসব কাজে শরীরের নানান ব্যাপার-স্যাপার থাকে। তিনি চান আমরা দর্শকরা যেন তাঁর শিল্পকে অনুভব করি, যেন একটা শারীরিক সাড়া পাই, তা সেটা “টারনার প্রাইজ” প্রদর্শনীতে হেঁটে বেড়ানো দৈত্যাকার নিতম্ব দেখেই হোক, বা সব্জির মতো সেজে এক লোককে পারফর্ম করতে (The Squash, দুটোই ২০১৬) দেখেই হোক। তাঁর Leg Chair সিরিযটি দৃশ্যত অ্যালেন জোনসের ভাস্কর্যে (এই যেমন, ১৯৬৯ সালে নির্মিত Chair-এ) নারী দেহের অবমাননাকর ব্যবহারের একটি একবিংশ শতকীয় প্রত্যুত্তর। এবং তা যৌনতা, ভোগবাদ এবং সমসাময়িক বাসনাগুলোর একটি একত্রীকরণ।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
Leg Chair (Cigarettes)
এক্রিলিক. ব্রাস, প্লাসটার এবং মোম
৮৫.৩ X ৯০.৩
পলিনা ওলোসকা (Paulina Olowska)
(জন্ম ১৯৭৬)
দি অ্যালকেমিস্ট রীতিমত একজন ছত্রাকবিদের স্বপ্ন। সেথানে ব্যাঙের ছাতা মেঝে ফুঁড়ে উঠছে, সাইড বোর্ডে অংকুরিত হচ্ছে। নারীটির মাথার পেছনে নানান নমুনার অলংকরণ ফ্রেমবন্দি হয়ে সারিবদ্ধভাবে শোভা পাচ্ছে । সেগুলোর সঙ্গে পুরুষাঙ্গের সাদৃশ্য নজরে না পড়া কঠিন, তবে ঝালর আর খাঁজগুলো নারীর যৌনতার কথাও বলে। নারীটি তাঁর বইটি ভাঁজ ক’রে ধরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে আপনার দিকে তাকিয়ে আছেন। তাঁর ভঙ্গিমার মধ্যে প্রাচীন-ঘরানাসুলভ আকর্ষণ বা সম্মোহন আছে, আর তাঁর চোখে রয়েছে কড়া মাত্রার অবসাদ।
পলিনা ওলোসকা প্রায়শই ইতিহাসের ভুলে-যাওয়া বা উপেক্ষিত চরিত্রদের ওপর দৃষ্টিপাত করেন। দি অ্যালকেমিস্ট-এ তিনি তাঁর সূচনাস্থল হিসেবে ইতালীয় স্থপতি কারলো মল্লিনোর গোপন কিছু আলোকচিত্র ব্যবহার করেছেন। মল্লিনোর ইরোটিক পোলারয়েডগুলো মাত্রই অল্প কিছুদিন হলো আবিষ্কৃত হয়েছে, ১৯৭৩-এ তাঁর মৃত্যুর পর। এবং সেসব ছবিতে প্রায়-নগ্ন নানান নারীকে মল্লিনোর ব্যক্তিগত অ্যাপার্টমেন্টে বিভিন্ন ভঙ্গিমাতে দেখা যায়। মহিলাটির আদি লঞ্জেরিটিকে ঢাকা দিতে ওলোসকা একটি পোশাক যুক্ত করেছেন, এবং চিত্রকর্মটি নানান বস্তু দিয়ে ভরে ফেলেছেন, যাতে দর্শকের স্থিরদৃষ্টিকে খানিকটা ভিন্ন পথে চালনা করা যায়, আর তার ফলে নারীটিকে খানিকটা কর্তৃত্ব ফিরিয়ে দেয়া যায়।
ওলোসকা সাবেক কালের বুননের নকশা বা মডার্নিস্ট সাময়িকপত্রগুলো থেকে বিভিন্ন প্রতিচ্ছবি নিয়ে ব্যবহার করাতে তাঁর চিত্রকর্মগুলোতে প্রায়ই একটা স্মৃতিভারাতুর মৃদু দীপ্তি থাকে। এসব প্রতিচ্ছবির বিষয়বস্তুকে তিনি নতুনভাবে মূল্যায়িত করেন। পশ্চিমের ভোক্তাভিত্তিক পুঁজিবাদ এবং সেটা যে নারীকে বস্তুতে পরিণত করে এই বিষয়গুলোকে তিনি সূক্ষ্মভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ক’রে দেখেন। তাঁর চিত্রকর্মগুলো স্থাপত্য, পারফরেমেন্স, এবং সেই সঙ্গে সাময়িকপত্র, আলাপচারিতা বা বক্তৃতা তথা টক, এবং প্রদর্শনীর একটি বৃহৎ পরিসরের অন্তর্ভুক্ত।
শিল্পকর্ম পরিচিতি:
The Alchemist ২০১৫
ক্যানভাসে তেল রং, অ্যারোসল রঙ এবং গ্র্যাফাইট
২২০ X ১৫০
[আগামী পর্বে সমাপ্ত]
পর্ব-১: শিরীন নিশাত ও যারিনা হাশমি- দ্রোহ আর স্মৃতিকাতরতা
পর্ব-২: মহাজাগতিক সৃজনকারী শক্তি ও নারীর স্বরূপে ফেরা
পর্ব-৩: শিল্পের নতুন বিষয় ও শিল্পীর শরীর
পর্ব-৪: শ্রম বৈষম্য এবং সন্তান পালনের দলিল
পর্ব-৫: নারীর প্রতীকী ইতিহাস এবং শিল্পকর্ম হিসেবে দেহ
পর্ব-৬: দেহ ভাস্কর্য ও চিরন্তন মাতৃসত্তার বিরুদ্ধচিত্র
পর্ব-৭: গার্হস্থ্য জীবন আর অন-স্ক্রীন নারীত্বের স্বরূপ উন্মোচন
পর্ব-৮: দেহাস্ত্র এবং অনিরপেক্ষ প্রতিচ্ছবি
পর্ব-৯: বোধ স্বতন্ত্র এবং ফিউশন অস্বস্তিকর
পর্ব-১০ নির্যাতন নিরন্তর ও পিতৃতান্ত্রিক বিশ্বে নারী হওয়ার জটিলতা
পর্ব-১১: ব্যক্তিগত ক্ষমতায়ন এবং কৃষ্ণাঙ্গ নারী সমকামীর অভিজ্ঞতা
পর্ব-১২: পেশল বাস্তবতা আর পূর্বকল্পিত জেন্ডার বিষয়ক মতামত
পর্ব-১৩: সঙ্গীতের মহাফেজখানা আর ঐতিহাসিক পেইন্টিং-এর ভিন্ন বয়ান
পর্ব-১৪: সাদা কার্ড বাদামি কার্ড আর নারীর চোখে নারী
পর্ব-১৫: দৈনন্দিনের একঘেয়েমি আর শিল্পে গেরিলাযুদ্ধ
পর্ব-১৬: আশ্রয়স্থল কিংবা কারাগার আর ফিমেল আর্টের অনুসন্ধান
পর্ব-১৭: নারীর দেহভাষা আর পুরুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধাচারণ
পর্ব-১৮: পরিচয় পুনরুদ্ধার এবং ইতিহাসে স্থান পুনর্দখল
পর্ব-১৯: সহজাত প্রবৃত্তিভিত্তিক শিল্প আর শিশু ও মাতার ভিন্ন যাত্রা
পর্ব-২০: দানবীয়তায় ঝোঁক আর মিথ্যে দিয়ে নিজেকে পুনরাবিষ্কার
পর্ব-২১: জেন্ডার ভিন্নতা ও নারীবাদের মূল্য পরীক্ষা
পর্ব-২২: প্রকল্প সমবায়ী এবং শারীরিক অনুভূতির শিল্পরূপ
পর্ব-২৩: নারী অধিকারের মানে এবং ‘দ্য আদার সাইড’